সাধু ও চলিত ভাষা বলতে কি বুঝ। সাধু ও চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।211003

সাধু ও চলিত ভাষা
সাধু ও চলিত ভাষা বলতে কি বুঝ? সাধু ও চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার মতো বাংলা ভাষার বিভিন্ন রীতি, রূপ ও প্রকাশভঙ্গি বিদ্যমান। সাধুরীতি ও চলিত রীতি প্রতিটি রীতিই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্ল। বাংলা গদ্যের সূচনা পর্ব থেকেই সাধু ও চলিত রীতির প্রবর্তন হয়।

সাধুরীতি : বাংলা গদ্য সাহিত্যে ব্যবহৃত সংসকৃত শব্দ বহুল সুষ্টু, মার্জিত, সর্বজনবোধ, অথচ য়িম বদ্ধ ও কৃত্রিম ভাষারূপ হল সাধুভাষা। উনিশ শতকে গড়ে উঠা লিখিত গদ্যরূপ সাধুভাষা নমের পরিচিত হয়। রায়মোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ গদ্য শিল্পী সাধুভাষার মাধ্যমে তাদের সাহিত্য কীর্ত প্রতিষ্ঠিত করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন : ‘সাধুভাষা মাজাঘষা, সংসকৃত ব্যাবকরণ অভিধান থেকে ধর করা অলংকারে সাজিয়ে তোলা।’

সাধুভাষার বৈশিষ্ট্য :
০১. সাধুভাষায় তৎসম বা সংসকৃত শব্দের প্রাধান্য বেশি। যেমন : নিরীক্ষণ, বিদাকর প্রভৃতি।
০২. সাধু ভাষায সুন্ধি ও সমাসবদ্ধ দীর্ঘ শব্দের প্রধান্য বেশি। যেমন : চতুর্থাংশ, বাজাজ্ঞা প্রভৃতি।
০৩. এ ভাষায় অনুসর্গ, অসমাপিকা ক্রিয়া, সমাপিকা ক্রিয়া এবং সর্বনাম পদ পূর্ণাঙ্গ রূপে ব্যবহৃত হয়।
যেমনা: হইতে, করিলে, বদলাইয়া, হইবেন, শনিলেন প্রভৃতি।
০৪. সাধু ভাষায় পদ বিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত, সুনির্দিষ্ট; অর্থাৎ বাক্যে প্রথমে উদ্দেশ্য ও পরে বিধেয় থাকে এবং ক্রিয়াপদ
সাধারণত বাক্যের শেষে থাকে। যেমন: সম্মুখে এক ক্ষুদ্র প্রান্তর দেখিতে পাইলাম।
০৫. সাধু ভাষা মার্জিত, সর্বজনবোধ্য কিন্তু বহুলাংশে কৃত্রিম।
০৬. সাধুভাষা আভিজাত্য ও গাম্ভীর্যের প্রতীক।
০৭. সাদুভাষা নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতায় অনুপযোগী।
০৮. এ ভাষায় বহুভাষণ ও বাগাড়ম্বর লক্ষিত হয়।
০৯. সাধু ভাষায় সংসকৃত অব্যয়ের ব্যবহর হয়। যেমন: যদ্যপি, সমীভবন ইত্যাদির ব্যবহার নেই।
১০. সাধু রীতিতে ঋনাত্বক শব্দ, অপনিহিতি, স্বরসঙ্গতি, অভিশ্রুতি, সমীভবন ইত্যাদির ব্যবহার নেই।

চলতিরীতি : কলকতা অঞ্চলের কথ্যভাষা যখন দেশের বেশির ভাগ শিক্ষিত মানুষের ভাষা প্রয়োগের সাধারণ মাধ্যমে পরিণত হল, কতণ তাতে সাহিত্য বচনর আর কোন বাধ থাকল না। এ কক্ষ ভাষার মাধ্যমে য়ে ভাষা সৃষ্টি হল, তাই পরিনামে চলিত ভাষা নমে অভিহিত হয়। উনিশ শতকের শেষভাগে নাটক, উপন্যাস ও গল্পের সংলাপে চলিত ভাষর প্রয়োগ হতে থাকে। প্রথম চৌধুরী এ ভাষকে সাহিত্য ভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: ‘চলিত ভাষার আটপৌরে সাজ নিজের চরকায় কাটা সুতো দিয়ে বোনা।’

চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য :
০১. চলিত ভাষায় তদ্ভয, দেশি বিদেশি শব্দ বেশি।
০২. এ ভাষায় অসমাপিকা ক্রিয়া, সমাপিকা ক্রিয়া, সবর্নাম পদ ও অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়।
০৩. চলিত ভাষায় সন্ধি ও সমাসবদ্ধ শব্দ ভেঙ্গেঁ সহজ করে লেখার প্রবণতা দেখা যায়। এতে ভাষা হালকা ও সহজ হয়।
০৪. চলিত ভাষায় পদবিন্যাস ও বাক্যের গঠন প্রকৃতি বিশেষ রকমের।
০৫. চলিত ভাষায় ঋনাত্বক শব্দ এবং শব্দদ্বৈতের ব্যবহার ও প্রাধান্য বেশি।
০৬. চলিত রীতিতে বিভক্তির সংক্ষিপ্ত রূপ ব্যবহৃত হয়। যেমন : দিয়ে, হতে প্রভৃতি।
০৭. চলিত রীতিতে তদ্ভব অব্যয় পদ ব্যবহৃত হয়। যেমন : যদি, তুবও, আগে প্রভৃতি।
০৮. চলিত ভাষায় অপনিহিতি, স্বরসঙ্গঁতি, অভিশ্রুতি, ও সমীভবনের প্রয়োগ বেশি।
০৯. এ ভাষার রীতি ব্যাকরণ সম্মত না হওয়ায় এর কাঠামো পরিবর্তনশীল।
১০. চলিত ভাষা বক্তৃতা, আলাপ চারিতা ও নাট্যসংলাপে উপযোগী।
এ ভাষাকে শিক্ষিত ভদ্রসমাজ মৌখিক ও লেখা ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

সাধু ও চলিত ভাষা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *