প্রমথ চেীধুরীর সবুজপত্র প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য আলোচনা কর। 231105

‘সবুজপত্র’ প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য আলোচনা কর। (বাংলার প্রকৃতির স্বরুপ / নামকরণ কেন সবুজপত্র / সবুজকে রক্ষা ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে লেখক কী পরামর্শ দিয়েছেন / সবুজকে জোর করে পাকাতে গেলে কী হয়)

উপস্থাপনা : বাঙলা গদ্যসাহিত্যে প্রমথ চেীধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) একজন শক্তিমান প্রাবন্ধিক। তিনি বাংলা সাহিত্যে অনেক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গুলোর মধ্যে ‘তেল নুন লাকড়ী’, ‘বীরবলের হালখাতা’, ‘সনেট পঞ্চাশৎ’, ‘নানা চর্চা’ ইত্যাদি। তিনি বাংলা গদ্যসাহিত্যে এক নতুন ভাষারীতি প্রবর্তন করেন, এটা বীরবলী রীতি নামে পরিচিত। মানুষের মুখের কথাকে তিনি লিখিত গদ্যভাষায় স্থান দিয়েছেন। এতে ভাষা আরও উন্নত ও সুন্দর হয়েছে। তিনি ‘বীরবল’ ছদ্মনামে লিখতেন, এবং তার লিখিত ভাষার একটি আলাদা স্টাইল ছিল। তিনি চলিত ভাষাকে সাহিত্যে প্রবর্তন করেন। তাঁর প্রবন্ধ সংগ্রহে ‘সবুজ পত্র’ নামে একটি প্রবন্ধ রয়েছে। নি¤েœ প্রবন্ধটির মূল বক্তব্য আলোচনা করা হলো-
‘সবুজপত্র’ একটি ছোট্ট প্রবন্ধের নাম। আবার এই নামে একটি সাহিত্য প্রত্রিকাও রয়েছে। প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় ১৯১৪ সালে এ সাময়িক পত্র প্রকাশ হয়। এই সাময়িক পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক উন্নতি সাধন করেছেন। বাংলা ভাষায় চলিতরীতি প্রবর্তন করেছেন। ‘সবুজপত্র’ নামক প্রবন্ধে তিনি নিজস্ব সম্পাদনায় প্রকাশিত সাময়িকপত্রের উদ্দেশ্য, নামকরণ, তাছাড়া বাংলাদেশের তারণ্য ও প্রকৃতিক পরিবেশ প্রসঙ্গে আলোচনা করেছেন। তার লেখার ভাষা অত্যন্ত সাবলীল, সহজ, সুন্দর, গোছালো। তিনি বক্তব্যকে সহজেই পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে পারেন।
‘সবুজ পত্র’ নামক প্রবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরে লেখক ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকা প্রসঙ্গে বলেছেন যে, এই পত্রিকাটি সহজ-সরল ভাষায় লেখা হয়। সাধারণ মানুষ, স্বল্প শিক্ষিত মানুষ, খুব সহজেই এ পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে পারবে। এ জন্য বিশেষ কোন জ্ঞান বা পা-িত্যের প্রয়োজন নেই। কিন্তু সমালোচকেরা ইচ্ছা করেই এ পত্রিকার সমালোচনা করে। তারা বাঁকাভাবে দেখে। কিছু মানুষের স্বভাবই হলো যে, কোন বিষয়ের নেতিবাচক দিক খুঁজে বের করা। ‘সবুজ পত্র’ প্রবন্ধে লেখক এ সমস্ত সমালোচকের জবাব দিয়েছেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে। ‘সবুজ পত্র’ পত্রিকার নামকরণ প্রসঙ্গে লেখক একটি বিশেষ রঙ বেছে নিয়েছেন, সেটা হলো সবুজ। আমরা সবাই জানি মৌলিক রং মোট ছয়টি। তবে লেখক সবুজ রঙকে নির্বাচন করেছেন। সবুজ রঙের মধ্যে তিনি যৌবনধর্মকে পেয়েছেন। তারুণ্য বা যৌবন যে কোন সমাজের যে কোন কাজের জন্য প্রয়োজন। প্রাবন্ধিক যৌবনকে পছন্দ করেন, মনে-প্রাণে ভালোবাসেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, তার‌্যণই আমাদের দেশ বা সমাজব্যবস্থাকে ইতিবাচক পরিবর্তন করতে পারে। আর তারুণের সব গুণাবলি সবুজ রঙের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। এ কারণেই লেখক এ প্রবন্ধের নাম রেখেছেন ‘সবুজ পত্র’। তাছাড়া প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা; এর প্রকৃতি সব সময় সবুজ, সব ঋতুতে সবুজ, বাংলা চিরদিন সবুজ, চিরকাল সবুজ; টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, হিমালয় থেকে সুন্দরবন যতদূর যাওয়া যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। আর এ সবুজের প্রভাব পড়ে জনমানসের উপর। তাই আমাদের সমাজেও মানুষের মনেও সবুজের মতো তারুণ্য বিদ্যমান থাকে। প্রাবন্ধিক এ তারণ্য বা যৌবনকে ভালোবেসে এ প্রবন্ধের নাম ‘সবুজ পত্র’ করেছেন। কবিরা বাংলার এ প্রকৃতিকে নিয়ে কত সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করেছেন। তাই প্রকৃতি শুধু কবির মনকেই প্রভাবিত করেনি, করেছে আপামর সাধারণ মানুষকে।

প্রাবন্ধিক একজন সচেতন শিল্পী । তিনি আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে বর্তমান প্রবন্ধে তাঁর মতামত উপস্থাপন করেছেন। তিনি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক বলেছেন যে শিক্ষার বিধি হচ্ছে ‘অপরের মতো হও, আর তার নিষেধ হচ্ছে নিজের মতো হোয়ো না’। এখানে তিনি বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। বিদ্যালয় হলো শিক্ষার ক্ষেত্র। কিন্তু সেখানে তরুণদের মেধা বিকাশের কোন সুযোগ নেই। নিজেকে চেনার কোন সুযোগ নেই্। বরং সব সময় ছাত্রদেরকে অপরের মতো হতে পরামর্শ দেয়া হয়। প্রত্যেকটি মানুষেরই নিজ নিজ প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু এ প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দেওয়া হয় না; বরং তার উপর জোরপূর্বক এমন বিষয় এমনভাবে চাপিয়ে দেওয় হয়, যাতে মেধা কিাশের পরিবর্তে আর লুপ্ত হয়। এবং তাদের স্বধর্ম ও স্বস্বভাব নষ্ট হয়। এ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক মন্তব্য ‘সমাজের ধর্ম হলো প্রত্যেকের স্বধর্ম নষ্ট করা’।
সবুজকে অন্ধ ঘরে বন্দি করে রাখলে সবুজ তার স্বাভাবিক ধর্ম হারিয়ে ফেলে। সবুজ রঙ তার সবুজত্ব হারিয়ে হলুদ বা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সবুজের ধর্ম হলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সবুজ হয় অমৃত লাভ করবে না হয় মৃত্যুকে বরণ করবে। সবুজকে কাঁচা মনে করে জোর করে পাকাতে গেলে সব নষ্ট হবে। তারণ্যের একটি স্বাভাবিক ধর্ম আছে। তার নিজের ভিতরে প্রাণ শক্তি আছে। আমরা যদি এ প্রাণশক্তির চর্চা করি এবং স্বধর্মকে বিকশিত হতে দেই, তাহলে সবুজ বা তারুণ্য নিজের মতো করে ফলে-ফুলে বিকশিত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধনের উপযোগী হতে পারবে। আর এ জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস।
সমাপ্ত : উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী একজন গভীর চি›তাশীল শিল্পী। তিনি স্বল্প পরিসরে ‘সবুজ পত্র’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। কিন্তু এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু অত্যন্ত ব্যাপক ও বিশাল। তিনি ‘সবুজ পত্র’ নামক সাহিত্য পত্রিকার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন। বর্তমান সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার নানা সমস্যা ও সমাধানের উপায় সম্পর্কে তিনি যুক্তিনিষ্ঠভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। সবুজ রং দ্বারা তারুণ্যকে বুঝিয়ে এ তারুণ্যের সঠিক গঠন ও সুষ্ঠু স্বাভাবিক শিক্ষার মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের প্রতয় ব্যক্ত করেছেন। বিষয়বস্তু নির্বাচন, বক্তব্য উপস্থাপন, শৈল্পিক বিচারে, যৌক্তিক পরিণতিতে ‘সবুজ পত্র’ একটি অসাধারণ প্রবন্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *