অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ক্রমবিকাশ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর। 231005

অনার্স ৩য় বর্ষ

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ক্রমবিকাশ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।(নানা শাখা/পয়ার/অমিত্রাক্ষর)

যে ছন্দের আদিতে ও মধ্যে যুগ্মধ্বনি থাকলে তা সংশ্লিষ্ট উচ্চারণে একমাত্রা এবং শেষে যুগ্মধ্বনি থাকলে বিশ্লিষ্ট উচ্চারণে দুই মাত্রা ধরা হয়, সে ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বলে।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ক্রমবিকাশ : অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেন সর্বপ্রথম সার্থকভাবে এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ১৯২২ সালে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নামকরণ করেন। তারপর অনেক ছান্দসিক ব্যক্তি এ ছন্দকে নানা নামে নামকরণ করেছেন। যেমন- ড. সুকুমার সেন ‘তদ্ভব তানপ্রধান ছন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সমমাত্রার ছন্দ’, অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় -‘তানপ্রধান ধীরলয়’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘আদ্যা’, মোহিতলাল মজুমদার ‘বর্ণবৃত্ত পদভূমক’ প্রভৃতি নামকরণ করেছেন। বাংলা প্রধান তিনটি ছন্দের মধ্যে প্রসারগুণে অক্ষরবৃত্ত অদ্বিতীয়। এর মধ্যযুগীয় নাম পয়ার ছন্দ। এ পয়ার ছন্দ থেকেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উৎপত্তি ও বিকাশ লাভ করেছে। ৮ ও ৬ পর্বদ্বয়ে বিভক্ত ১৪ মাত্রার দুটি সমিল চরণ, প্রথম চরণের শেষে এক দাঁড়ি ও দ্বিতীয় চরণের শেষে দুই দাঁড়ি-এই ছিল উনিশশতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পয়ারের চেহারা। এই পয়ার জাতীয় অক্ষরবৃত্ত ছন্দই দীর্ঘকাল ধরে বাংলা পদ্যসাহিত্যের প্রধান অবলম্বন ছিল।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের শাখা-প্রশাখা : অক্ষরবৃত্ত ছন্দ অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ। এ ছন্দের গঠনরীত নানা বৈচিত্র্যের মালায় সজ্জিত। সেগুলোই এ ছন্দের শাখা-প্রশাখা যেমন : অক্ষরবৃত্ত ছন্দ গঠনের প্রধান অংশ জুড়ে আছে পয়ার। পয়ারকে আবার অনেক ভাগে বিভক্ত করা যায়। এ ছাড়া আছে ত্রিপদী, চৌপদী, গৈরিশ, মুক্তক, অমিত্রাক্ষর, সনেট, গদ্যছন্দ, একাবলী ইত্যাদি নানা রকমের ছন্দ। এগুলো মূলত অক্ষরবৃত্তছন্দের আঙ্গিকগত বা বহিরাঙ্গিক কাঠামোর নাম। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের শাখার মধ্যে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো অমিত্রাক্ষর ছন্দ। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র সফল মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ এ ছন্দে রচিত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে এ ছন্দের প্রবর্তন করেন।

অমিত্রাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্য :অমিত্রাক্ষর ছন্দের বৈশিষ্ট্য : অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রবহমানতা, মিলহীনতা, এবং যতিপাতের স্বাধীনতা। প্রবহমানতা হচ্ছে প্রতি পংক্তির মধ্যে এক একটি মনোভাব প্রকাশ না করে প্রয়োজনবোধে পরবর্তী পংক্তিগুলোতে তার ভাব প্রবাহিত করে দেওয়া। ভাবের এই পংক্তি লঙ্ঘনকে ‘প্রবহমানতা’ বলে। অমিত্রাক্ষর ছন্দের অন্ত্যমিল নেই, পূর্বের পংক্তির শেষ শব্দের সাথে পরবর্তী পংক্তির শেষ শব্দের যে মিল পয়ারে দেওয়া হয়, এ ছন্দে তা অবসান ঘটানো হয়েছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দে যতিপাতের স্বাধীনতা আছে। পয়ার এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দে যতি এক স্থানে পড়লেও ছেদ পড়ে ভিন্ন স্থানে। যতি ও ছেদ স্থাপনের এই অসম ব্যবস্থার কারণেই অমিত্রাক্ষর ছন্দে প্রবহমানতা আসে। এই ছন্দ পয়ারভিত্তিক বলে এর প্রতি পংক্তিতে মাত্রা সংখ্যা চৌদ্দ এবং দুটি করে পর্ব থাকে। তবে পয়ারের মতো অমিত্রাক্ষর ছন্দে একটি ভাব চৌদ্দ মাত্রার ভেতর সীমাবদ্ধ নয়। পংক্তির চৌদ্দ মাত্রা ছাড়িয়েও এতে অর্থ রুপায়িত হয়। এই ছন্দে অনুপ্রাস এবং নিত্যনতুন ক্রিয়াপদের ব্যবহার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য :

১.অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মূল পর্ব দুটি-আট ও ছয় মাত্রার।
২. এ ছন্দে শব্দের আদি ও মধ্যের যুগ্মধ্বনি ঠাসা বা সংশ্রিষ্ট উচ্চারণে একমাত্রার এবং শেষের যুগ্মধ্বনি বিশ্লিষ্ট উচ্চারণে দুই মাত্রার।
৩.এ ছন্দে সাধুভাষার ব্যবহার বেশি।
৪.এ ছন্দে লয় ধীর বা মধ্যম।
৫.এ ছন্দে চরণস্থ পর্বসমূহে অক্ষর ধ্বনিকে আচ্ছন্ন করে একটা অতিরিক্ত সুরের তান নিয়ত প্রবাহমান।
৬.এ ছন্দ যেহেতু অক্ষর সর্বস্ব; তাই এর অক্ষর গুণে মাত্রা ঠিক করলেই চলে।
৭.এ ছন্দে আদি ও মধ্যের যুগ্মধ্বনি বা বদ্ধাক্ষর চার জায়গায় দ্বিমাত্রিক।
৮.এ ছন্দে তানের প্রবাহে এর অন্তর্গত যুক্ত ব্যঞ্জনের মাত্রা সংকুচিত হয়ে একমাত্রা হয়।
৯.এ ছন্দের ভাব ও ভাষা গভীর, গম্ভীর, বিপুল এবং বিশাল।
১০.এ ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সাধারণ শোষণশক্তি যার ফলে যুক্তাক্ষরবিহীন পর্বকে যুক্তাক্ষরবহুল করলেও এর মাত্রা সংখ্যার কোন তারতম্য হয় না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *