দোভাষী পুঁথিসাহিত্য এর উদ্ভব ও বিকাশ । 221003

দোভাষী পুঁথিসাহিত্য

দোভাষী পুঁথিসাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ। অথবা, (অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবিওয়ালা ও শায়েরের উদ্ভবের কারণসমূহ নিরূপণ করে উভয় ধারার প্রধান প্রধান রচয়িতার পরিচয় দাও।)

অষ্টাদশ শতাব্দীতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের পটভূমিতে কবিওয়ালা ও শায়েরের উদ্ভব ঘটে। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ভারতে মুঘলশক্তির পতন শুরু হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের ফলে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে, ইংরেজরা পরোক্ষভাবে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করে। আঠার শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছর কালান্তর চলছিল। কালান্তরের যুগে সাহিত্য-সাংস্কৃতিতে উন্নতির লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, বরং ভাব-ভাষা-রীতি-রুচির দিক দিয়ে আরও অবনতি ঘটে। শাসক শ্রেণির দুর্বলতা, নেতৃত্বশূন্যতার ফলে সমাজে নৈরাজ্য, নীতিহীনতা স্বৈচ্ছাচার বৃদ্ধি পায়। এমন সামাজিক অবস্থায় মহৎসাহিত্য রচিত হয় না, পূর্বের ধারা রস – রুচি-আদর্শের দিক দিয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে হিন্দুসমাজে কবিগান এবং মুসলমান সমাজে পুঁথিসাহিত্যের সূত্রপাত ঘটে। হিন্দু সমাজে কবিগানের প্রসার ঘটেছিল আর মুসলমান সমাজে শায়েররা অলৌকিকতায়পূর্ণ দোভাষী পুঁথিসাহিত্য রচনা করেন। নিম্নে কবিওয়ালা শায়েরদের রচিত সাহিত্য ধারার পরিচয় তুলে ধরা হলো :

কবিওয়ালা সাহিত্যধারা :
‘কবি’ শব্দের সাথে বৃত্তিবাচক ‘ওয়ালা’ প্রত্যয় যোগে ‘কবিওয়ালা’ শব্দের উৎপত্তি। যারা কবিতাকে জীবিকার উপায় হিসেবে গ্রহণ করেন তারাই কবিওয়ালা। জনতার আসরে তাৎক্ষণিকভাবে সুর – ছন্দ যোগে কবিতা রচনা করে গানের মাধ্যমে পরিবেশন করা হয়। কবিগণ জনতাকে তুষ্ট করেন, বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ পান। বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে এ এক অভিনব কাব্যনুশীলন। এ গান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :

ইংরেজের নতুনসৃষ্ট রাজধানীতে পুরাতন রাজসভা ছিল না, পুরাতন আদর্শ ছিল না। তখন কবির আশ্রয়দাতা রাজা হইল সর্বসাধারণ নামক এক অপরিণত স্থুলায়তন ব্যক্তি, এবং সেই হঠাৎ রাজার সভার উপযুক্ত গান হইল কবির দলের গান। জনতাই কবিগানের পৃষ্ঠপোষক ও রস – আনন্দভোগী। এতে লিখিত সাহিত্যের সৃজনশীলতা ও শিল্পসুষমা থাকতে পারে না। কথার চটক আর অলংকারের চাতুর্য দ্বারা গানকে মনোমুগ্ধকর ও শ্রুতি সুখকর করে তোলার দিকে কবিগণ জোর দেন। কবিওয়ালা গানের মুখ্য বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণের লোকিক প্রেম। এছাড়া হরগৌরী ও রামগীতার লীলা এ গানের বিষয়বস্তু হয়েছে।

আঠার শতকে এ ধারার প্রধান কবি ছিলেন গোজণা গুঁই, রাম বসু (১৭৩৪ – ১৮০৫), নৃসিংহ (১৭৩৮ – ১৮০২) হরু ঠাকুর (১৭৩৮ – ১৮২২), নিতাই বৈরাগী (১৭৪৭ – ১৮২১), নিধুগুপ্ত (১৭৫৫ – ১৮৫২), কালী মির্জা (১৭৫০ – ১৮২৫) প্রমুখ। এঁরা সবাই স্বভাব কবি ছিলেন। কবিগান, দাঁড়া কবিগান, আখড়াই, হাফ – আখড়াই, খেউড় টপপা, তরজা ইত্যাদি ধারায় কবিওয়ালা গান রচিত হয়। হরু ঠাকুর ‘কবির লড়াই’ -এ অংশগ্রহণ করতেন, প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রাম বসু ও কেষ্টামুর্চি। নিতাই বৈরাগীর ভাষা সহজ, প্রকাশভঙ্গি ছিল অনায়াস ও অনর্গল। নিধুগুপ্ত টপ্পা গায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। টপ্পা আদিরসাত্মক প্রণয়গীতি। তিনি খেউড় ও হাফ – আখড়াই রচনা করতেন। কবিওয়ালা গানের জন্মভূমি কলকাতার শহর পরে তা গ্রামেও জড়িয়ে পড়ে। প্রথমে হিন্দু কবির পরে মুসলমান কবির আবির্ভাব হয়। ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রথম লক্ষণ অশ্লীলতা ও নীতিহীনতা – কবিওয়ালা গানের ভাবে, রসে, ভাষায় ভঙ্গিতে ব্যতিক্রম ছাড়া এই বৈশিষ্ট্য পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।

শায়েরের পরিচয় :
অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয়ের যুগে হিন্দু কবিগণ যখন কবিগান, তর্জা, পাঁচালী প্রভৃতি রীতির কাব্য রচনায় ব্যাপৃত ছিলেন, সেই সময় বাঙালি মুসলমান কবি তথা শায়েরগণ এক ভিন্ন ধরনের কাব্য রচনায় নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা ফারসি-উর্দু মিশ্রিত দোভাষী রীতিতে সাহিত্য রচনা করেছিলেন। এ সাহিত্য দোভাষী পুথিসাহিত্য নামে পরিচিত। শায়েরী সাহিত্যকে বিষয়ানুসারে চারটি ধারায় ভাগ করা যায় ।

১. প্রণয়োপাখ্যান জাতীয়
২. যুদ্ধ সম্পর্কিত – যথা জঙ্গনামা, সোনাভান, আমীর হামজা প্রভৃতি।
৩. পীরের পাঁচালী – যেমন : সত্যপীরের পুথি, কাজী কালু , চম্পাবতী প্রভৃতি।
৪. ইসলাম বিষয়ক – যেমন : নবীবংশ, কাসাসুল আম্বিয়া, হাজার মশলা প্রভৃতি।

এই ধারার প্রথম কবির মর্যাদা দেওয়া যায় ‘রায়মঙ্গল’ রচয়িতা কৃষ্ণরাম দাসকে। এ ধারার কবির সংখ্যা ২৫০ -এর অধিক, কাব্যের সংখ্যা কয়েক শত বলে অনুমান করা হয়। এই পুঁথিগুলি প্রধান ভাবে ‘বটতলার পুঁথিনামে পরিচিত। এ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি শাহ গরীবুল্লাহ। তাঁর রচিত – ‘ইউসুফ – জোলেখাঁ, ‘আমীর হামজা’, ‘জঙ্গনামা’, ‘সোনাভান’ এবং ‘সত্যপীরের পুঁথিতে’ শায়েরী সাহিত্যের চারটি ধারারই পরিচয় পাওয়া যায়। এ সাহিত্যের অন্যতম কবি সৈয়দ হামজা, তাঁর রচিত প্রথম কাব্য ‘মধুমালতী’। এছাড়া তিনি গরীবুল্লাহর ‘আমীর হামজা’ কাব্যটি সমাপ্ত করেন। তিনি ‘জৈগুনের পুঁথি’ ও ‘হাতেম তাই’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন। উনিশশতকেও এই পুঁথিসাহিত্যের ধারা প্রবহমান ছিল। এ সময় মুহম্মদ দানেশ রচনা করেন ‘চাহার দরবেশ’ ‘হাতেম তাই’ প্রভৃতি পুথি । পরবর্তীতে এ সাহিত্যের ধারা শুকিয়ে গেছে। প্রধানত প্রতিভাবান কবির অভাব, ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবে নতুন সাহিত্যের উদ্ভব, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসার অভাবে এ সাহিত্য ধারা দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়েছে।

উপসংহারে বলব, যুগ ও জীবন বাস্তবতার কারণেই কবিওয়ালা ও শায়েরের উদ্ভব ঘটে। উভয় ধারার সাহিত্যেই শিল্পমানে দূর্বল। তবে ঐতিহাসিক কারণে এগুলো গুরুত্ববহ। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনায় এ সাহিত্যের মূল্য রয়েছে। ভারতচন্দ্রের মৃত্যু এবং ঈশ্বরগুপ্তের আবির্ভাব -এই মধ্যবর্তী সময়ের শুন্যতা কবিওয়ালা ও শায়েরের মাধ্যমেই পূরণ হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে উভয় ধারায় সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।

About সালেক শিবলু

বিএ অনার্স, এমএ (প্রথম শ্রেণি) এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

View all posts by সালেক শিবলু