চোখের বালি উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর।

চোখের বালি

চোখের বালি উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা কর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) প্রধান পরিচয় কবি হলেও উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তিনি একই ভাবে শিল্পী সত্ত্বার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর‘চোখের বালি’ (১৯০৩) উপন্যাসটি বাংলা উপন্যাসের পালাবদলে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে। বিনোদিনী এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নায়িকা চরিত্র। এ চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে অন্যান্য চরিত্র ও উপন্যাসের মূলকাহিনী গড়ে ওঠেছে। বিনোদিনী আশালতাকে এ উপন্যাসে চোখের বালি বলে ডাকতো। প্রশ্ন মোতাবেক এখন আমরা ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করতে চাই।

যে কোন বিষয়ের নামকরণ গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্য বা শিল্পের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘চোখের বালি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি অন্যতম উপন্যাস। এ উপন্যাসের কাহিনি লেখক মোট ৫৫টি অনুচ্ছেদে ভাগ করে বর্ণনা করেছেন। বিনোদিনী, মহেন্দ্র, বিহারী, আশালতা এই চারটি চরিত্র এ উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ উপন্যাসের নামকরণ ‘চোখের বালি’ রেখে তাঁর বিচক্ষণ চিন্তন ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন আমরা উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ করে এর নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করব।

বিনোদিনী এই উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। উপন্যাসের দশম পরিচ্ছেদে বিনোদিনীর আবির্ভাব। বিনোদিনীর পরিচয়-সে হরিমতির সুদর্শনা কন্যা। তার রূপআছে, গুণ আছে, আর আছে দেহভরা যৌবণ। বিয়ে হয় বিপিন নামের এক ঘাটের মরার সঙ্গে। স্বামী অল্পদিনেই রোগে মারা যায়। বিনোদিনী বিধবা হয়, এক সময় রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে কোলকাতার বাসায় নিয়ে আসে।্ মহেন্দ্র আশার সুুখের দাম্পত্য জীবন দেখে বিনোদিনী বেশি ক্ষিপ্ত হয়। রূপে, গুণে, শিক্ষায়, কর্মে সর্বক্ষেত্রে বিনোদিনী শ্রেষ্ঠতর।তবুও বিনোদিনী এসুখ ভোগ থেকে বঞ্চিতা।তাই বিনোদিনীর সমস্ত রাগ মহেন্দ্রের উপর। বিনোদিনী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে-লেখকের ভাষায়-“এত ঔদাসীন্য কিসের। আমি কি জড় পদার্থ। আমি কি মানুষ না। আমি কি স্ত্রীলোক নই।” চোখের বালি’ চরিত্র প্রধান উপন্যাস। চরিত্রের নানা রকম গতিপ্রকৃতি এখানে বিশ্লেষিত হয়েছে। তেইশতম অনুচ্ছেদ বিনোদিনী চরিত্রের টার্নিং পয়েন্ট। বিনোদিনী মহেন্দ্রের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে আর মনের ক্যাম্পাসে বিহারীর মূর্তি গড়ে তোলে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখে শুনতে পায় যে, মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ভালবাসেনা, আর বিহারী আশাকে ভালবাসে। এমন কথা স্পষ্ট শুনে বিনোদিনীর মাথায় খুন চড়ে যায়। তাই বিনোদিনীর বেদনামিশ্রিত উক্তি- “সকলেই ভালোবাসে এই লজ্জাবতী ননির পুতুলটিকে।”

একটি চরিত্রের সাথে আর একটি চরিত্রের সম্পর্ক এ উপন্যাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ করে নর-নারীর সম্পর্ক। বিনোদিনী আশার দাম্পত্যজীবনের সুখ দেখে মনে মনে ঈর্ষা করে আর প্রকাশ্যে আশালতাকে চোখের বালি বলে ডাকে। এই হলো বিনোদিনী আশালতা চরিত্রের বিশেষ দিক। অন্যদিকে বিনোদিনী মহেন্দ্রকে ঈর্ষা করে। কেননা মহেন্দ্র চরিত্রের জেদের কারণে বিনোদিনীর কপালে আজ এতো দুঃখ্ বিনোদিনী চরিত্র একদিকে মহেন্দ্রকে শিক্ষা দিতে চায়, অন্য দিকে বিহারী চরিত্রটিকে ভালোবাসে। এই হলো ত্রিভূজ / চর্তুভুজ প্রেমের জটিল বিন্যাস। আবার বিহারী চরিত্রটিও বিনোদিনীকে ভালো না বেসে মহেন্দ্রের বিবাহিত স্ত্রীকে ভালোবাসে। এই ভাবে একে অপরের সাথে এমন একটি জটিল মনস্তাত্ব্কি সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই তো হলো নায়ক ও নায়িকা চরিত্রের নানামুখী টানাপোড়েন।

আবার অন্যদিকে এই উপন্যাসে রাজলক্ষ্মী ও অন্নপূর্ণা নামে আরো দুটি বয়স্কা নারী চরিত্র রয়েছে। এই দুটি চরিত্রের মধ্যে নানা রকম মানসিক টানাপোড়েন দেখতে পাওয়া যায়। আশালতা সংসারের কাজকর্মে তেমন দক্ষতা নেই। আবার মহেন্দ্রের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। দিনের বেলা মহেন্দ্রকে নিয়ে ঘরে বসে গল্প করে, এগুলো দেখে রাজলক্ষ্মীর মনে আগুন জ্বল, সে অন্নপূর্ণার কাছে এ বিষয়ে নালিশ জানায়, এই বিষয় নিয়ে অন্নপূর্ণা ও রাজলক্ষ্মীর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। অন্নপুর্ণা রাজলক্ষ্মীর উপর অভিমান করে সংসার ছেড়ে কাশি চলে যায়। এইভাবে এ উপন্যাসে একটি চরিত্রের সঙ্গে অন্য একটি চরিত্রের নানামুখী টানাপোড়েন দেখতে পাওয়া যায়্ । আর এ সমস্ত কারণেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসের সব চরিত্রের গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করে এ উপন্যাসের নামকরণ করেছেন ‘চোখের বালি’।

মন্তব্য : উপসংহারে বলতে চাই- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন বড় মাপের শিল্পী। তিনি চরিত্রগুলোর গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করে উপন্যাসের নামকরণ করেছেন। ‘চোখের বালি’ একটি চরিত্র প্রধান উপন্যাস। নারী-পুরুষ নিবিশেষে একটি চরিত্রের সাথে আর একটি চরিত্রের সম্পর্ক নির্ণয় এবং চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ এ উপন্যাসের প্রধান দিক। বিহারী-মহেন্দ্র পরস্পর বন্ধু। কিন্তু উপন্যাসের এক পর্যায়ে এরা একে অপরের শত্রুতে পরিণত হয়েছ্ ে। আবার বিনোদিনী-আশালতা প্রথম দিকে সখি বলে মনে হলেও অবশেষে আশা বুঝতে পেরেছে যে বিনোদিনী তার কতটুকু সর্বনাম করেছে। অন্নপূর্ণা আর রাজলক্ষ্মী, এই দুই নারীর সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর হলেও শেষ পর্যায়ে তারা একে অপরের কাছে চোখের বালিতে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এই উপন্যাসের গুরুত্বপুর্ণ ৬টি চরিত্রের গতিপ্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করে ‘চোখের বালি’ নামকরণ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সার্থক হয়েছে। নামকরণের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

About সালেক শিবলু

বিএ অনার্স, এমএ (প্রথম শ্রেণি) এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

View all posts by সালেক শিবলু