চোখের বালি উপন্যাস অবলম্বনে বিনোদিনী চরিত্রটি আলোচনা কর। 21

চোখের বালি  উপন্যাস অবলম্বনে বিনোদিনী চরিত্রটি আলোচনা কর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) প্রধান পরিচয় কবি হলেও উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তিনি একই ভাবে শিল্পী সত্তার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর‘ চোখের বালি’ (১৯০৬) উপন্যাসটি বাংলা উপন্যাসের পালাবদলে পথিকৃতের ভূমিকা পলন করেছে। বিনোদিনী এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নায়িকা চরিত্র। এ চরিত্রটিকে কেন্দ্র করে অন্যান্য চরিত্র ও উপন্যাসের মূলকাহিনি গড়ে ওঠেছে। প্রশ্ন মোতাবেক এখন আমরা বিনোদিনী চরিত্রটি বিশ্লেষণের প্রয়াস পাব।

উপন্যাসের দশম পরিচ্ছেদে বিনোদিনীর আবির্ভাব। বিনোদিনীর পরিচয়-সে হরিমতির সুদর্শনা কন্যা। তার রূপআছে, গুণ আছে, আর আছে দেহভরা যৌবন। বিনোদিনী দরিদ্র পিতার কন্যা হলেও মেম সাহেবের কাছে পড়াশুনা শিখেছে,্ বিয়ে হয় বিপিন নামের এক ঘাটের মরার সঙ্গে।স্বামী অল্পদিনেই প্লীহা রোগে মারা যায়। বিনোদিনী বিধবা হয়্,এক সময় রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে কোলকাতার বাসায় নিয়ে আসে।্ মহেন্দ্র আশার সুুখের দাম্পত্য জীবন দেখে বিনোদিনী যতটুকু তৃপ্ত হয়, তারচেয়ে বেশি ক্ষিপ্ত হয়। রূপে, গুণে, শিক্ষায়, কর্মে সর্বক্ষেত্রে বিনোদিনী শ্রেষ্ঠতর। তবুও বিনোদিনী এসুখ ভোগ থেকে বঞ্চিতা। তাই বিনোদিনীর সমস্ত রাগ মহেন্দ্রের উপর।

বিনোদিনী সুন্দরী, যুবতীবিধবা, মার্জিত, রুচিশীল, শিক্ষিত ও আধুনিক। এ প্রসঙ্গে লেখকের ভাষ্য-“জোড়াভুরু ও তীক্ষ্ম দৃষ্টি, তাহার নিখুঁত মুখ ও নিটোল যৌবণ।” এ নিটোল যৌবণ স্বামী সোহাগ ও ভালবাসা বঞ্চিত। বিনোদিনী কৌশলী নারী চরিত্র। ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ এ রকম। বিনোদিনী আশাকে ‘সই’ বলে, যাবতীয় কাজ করে দেয়, তারপর আশাকে সুসজ্জিত করে মহেন্দ্রের কাছে পাঠায়। বিনোদিনী কল্পনায় আশার পিছু পিছু ম্গ্ধু মহেনের অভিসারে জনহীন কক্ষে প্রবেশ করে। আশার ভালবাসার গল্প শুনে নিজেকে আশার স্থানে কল্পনা করে এক ধরণের সুখ অনুভব করে আবার ঈর্ষায় জ্বলে যায়। এ প্রসঙ্গে বিনোদিনীর উক্তি- “তোমাদের ভালবাসার কথা শুনিলে আমার ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে না ভাই।”

চোখের বালি চরিত্র প্রধান উপন্যাস। চরিত্রের নানা রকম গতিপ্রকৃতি এখানে বিশ্লেষিত হয়েছে। উনিশতম পরিচ্ছেদে আমরা বিনোদিনীর দ্বাদ্বিক মানসিকতার পরিচয় পাই। বিনোদিনীর ভাষায়- “কোন নারীর কি আমার মতো এমন দশা হইয়াছে। আমি মরিতে চাই কি মারিতে চাই, তাহা বুঝিতেই পারিলাম না।” সেবা পরায়ণতা নারী চরিত্রের একটি বিশেষ দিক। দুঃখের সময় বিনোদিনী তাকে বুকে জড়িয়ে রাখে, মায়া-মমতায় ঘেরা বিনোদিনীর মন। উনিশতম পরিচ্ছেদে দেখা যায়-আশা মহেন্দ্রের বিরহে কাঁদছে। আর বিনোদিনী সখির চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। লেখকের ভাষায়।-“সেবায় সান্ত¦নায়, নিঃস্বার্থ সখী প্রেমে সে মর্তবাসিনী।” সতেরতম অনুচ্ছেদে দমদমের বাগানে মহেন্দ্র বিনোদিনী বিহারী আশা চড়িভাতি করে। এ দিন বিনোদিনী বিহারীকে নতুন করে আবিষ্কার করে। বিনোদিনী হৃদয়ে লুকায়িত শত কথা হৃদয় খুলে বিহারীকে শোনায়। বিনোদিনী বুঝতে পারে মহেন্দ্রের সঙ্গে প্রেম করা যায় কিন্তু বিহারী তার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল।

বিনোদিনী মহেন্দ্রের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে আর মনের ক্যাম্পাসে বিহারীর মূর্তি গড়ে। বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখে শুনতে পায় যে, মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ভালবাসেনা, আর বিহারী আশাকে ভালবাসে। এমন কথা স্পষ্ট শুনে বিনোদিনীর মাথায় খুন চড়ে যায়। সবদিক থেকে বিনোদিনী অবহেলিত, বঞ্চিত। বিনোদিনী ইংরেজি শিক্ষিত,আধুনিক রুচি সম্পন্ন, প্রখর আত্মসচেতন নারী চরিত্র। প্রেম তার নারীত্বের অহংকার। প্রেমের পথে বাঁধা আসলে দেবী দুর্গার মতো দশ হাত দিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা ধ্বংস করতে চায়। মহেন্দ্র ও বিহারী দুই পুরুষের দৃষ্টি শক্তির তীব্র সমালোচনা করে এভাবে- “তোমরা কী দেখিয়া, কতটুকু দেখিয়া ভোল। নির্বোধ! অন্ধ!”

প্রেম বঞ্চিতা বিনোদিনী সর্বনাশা প্রেম খেলায় যেতে ওঠে। মহেন্দ্র, বিহারী সবাইকে উচিৎ শিক্ষা দিতে চায়। বিনোদিনী মায়াবিনী, নারীত্বের মায়াজাল বিস্তার করে। বিনোদিনী সবকিছু ভুলে গ্রামের বাড়িতে আসে। কিন্তু শান্তি পায় না। চাতক পাখির মত বিহারীর চিঠির প্রত্যাশায় থাকে। বিনোদিনী মহেন্দ্রকে নিয়ে পুতুলের মত খেলে, খেলাশেষে ছুঁড়ে ফেলে। পক্ষান্তরে বিহারীর কাছে কাঙালিনীর মতো প্রেম নিবেদন করে কিন্তু শান্ত প্রকৃতির বিহারী প্রথমে বিনোদিনীর প্রেমকে স্বীকৃতি দেয়নি। বিহারী বিনোদিনীর জীবনসর্বস্ব। তাই বিহারীর কাছে ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ একটা কিছু প্রার্থনা করে, বিনোদিনী বিহারীর গলা বাহুতে বেষ্টন করে তার অতৃপ্ত ওষ্ঠধর এগিয়ে দেয়, আর বিহারী আস্তে আস্তে বিনোদিনীর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিহারী নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি। প্রকাশ্যে মহেন্দ্রের সামনে বিনোদিনীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বিনোদিনী অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।

উপসংহারে বলতে চাই- বিনোদিনী চরিত্রে সবধরণের মানবিক গুণাবলি বিরাজমান। তার বহুমুখী চারিত্রিক প্রতিভার গুণে রাজলক্ষ্মী তাকে স্নেহ করেছ, মহেন্দ্র তার প্রেমে ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়েছে, বিহারীর কাছে সে দেবীত্বের আসন পেয়েছে। আর আশা তাকে সখী হিসেবে বরণ করেছে। সবকিছু মিলিয়ে বিনোদিনী কেবল উপন্যাসে ন্যায়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একটি মাইলফলক নারী চরিত্র।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

Scroll to Top