চাঁদের অমাবস্যা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস || টার্ম পেপার 2022

টার্ম পেপার
বাংলা বিভাগ
এম.এ শেষ বর্ষ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
টার্ম পেপার : ২০১৬

টার্ম পেপার
‘চাঁদের অমাবস্যা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস

উপস্থাপনায়
মো. সালেকুজ্জামান
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩০০১
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
তত্ত্বাবধায়ক
জনাব মো. আমজাদ
সহযোগী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

ঘোষণাপত্র

 

 

 

 

আমি এই মর্মে ঘোষণা করছি যে ‘‘চাঁদের অমাবস্যা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস শীর্ষক গবেষণা পত্রটি আমার নিজস্ব রচনা। ইতঃপূর্বে এই গবেষণা কর্মটি বা এর অংশ বিশেষ অন্য কোথাও প্রকাশিত হয়নি।

 

 

 

 

মো. সালেকুজ্জামান
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩০০১
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

মুখবন্ধ

 

 

 

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী, মৌলিক ও বিস্ময়কর, সৃজন প্রতিভার অধিকারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিখ্যাত সাহিত্য সমালোচক ও ঐতিহাসিক ড. সুকুমার সেন রবীন্দ্র- প্রসঙ্গে বলেছেন-“বিশ্ব সৃষ্টির নব্বয়ে সংযোগী এমন কবি বাঙ্গালা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে একজনই আবির্ভূত হয়েছেন’’।

তাই ‘‘চাঁদের অমাবস্যা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস বিষয়টি বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট গবেষণা হওয়ার দাবি রাখে । এর অংশ হিসেবে এম.এ শেষ বর্ষের পাঠ্যসূচির অর্š—ভূক্ত টার্ম পেপার প্রস্তুত কর্মটি একটি ক্ষুদ্র গবেষণা হলেও বাংলা বিভাগের প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত। টার্ম পেপার গবেষণার জন্য আমার নির্ধারিত বিষয় হলো ‘শেষলেখায় রবীন্দ্র-জীবন দর্শন’ এই গবেষণা কর্মটি ধারাবাহিকতা বা যথার্থতার প্রশ্নে কতটা উত্তীর্ণ হয়েছে বা হয়নি তার চেয়ে বড় কথা গবেষণার মাধ্যমে শেষলেখায় রবীন্দ্র-জীবন দর্শন খুঁজে পেয়েছি। তবুও সকল দিক বিবেচনা করলে গবেষণা কর্মটি যথাযোগ্য মূল্যায়ন হবে বলে আমার বিশ্বাস।

 

 

মো. সালেকুজ্জামান
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩০০১
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

 

 

 

 

একজন শিক্ষার্থীর কাছে একটি গবেষণা কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা কঠিন একটি বিষয়। এজন্য প্রয়োজন নির্দেশনা ও পরামর্শ। পাঠ্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে এম.এ শেষ বর্ষের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার্থীদের আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে একটি গবেষণাধর্মী টার্ম পেপার প্রস্তুত করতে হয়। আমি প্রথমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি টার্ম পেপার প্রস্তুত কমিটির সভাপতি ও বাংলা বিভাগের সম্মানিত বিভাগীয় প্রধান জনাব প্রফেসর মহা: আব্দুর রাজ্জাক স্যারের প্রতি ।

তারপর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমার এই গবেষণা কর্মের তত্ত্বাবধায়ক আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মো. আমজাদ হোসেন স্যারের প্রতি; যিনি আমার টার্ম পেপারের শিরোনাম নির্ধারণ করেদেন। আমাকে প্রয়োজনীয় সকল পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে এই গবেষণার কাজটি সফল করতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছেন, এর জন্য আমি আবার তাঁকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

 

 

মো. সালেকুজ্জামান
বাংলা বিভাগ, এম.এ শেষ বর্ষ
রোল নম্বর : ১৩০০১
শিক্ষাবর্ষ: ২০১৩-১৪
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

 

তত্ত্বাবধায়কের ঘোষণা

 

 

 

‘আমি এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা এর বাংলা বিভাগের এম. শেষ বর্ষের ছাত্র মো. সালেকুজ্জামান কর্তৃক ‘শেষলেখায় রবীন্দ্র-জীবন দর্শন’‘চাঁদের অমাবস্যা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস শীর্ষক গবেষণাপত্রটি একটি গবেষণা মূলক কাজ। এই গবেষণা পত্রটি আমি পড়েছি। এই গবেষণা লব্ধ বিষয়ের প্রতি আমি সন্তুষ্ট । এই গবেষণাটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে বাংলা বিভাগের এম.এ শেষ বর্ষ এর চূড়ান্ত পরীক্ষার স্বার্থ পূরণার্থে গবেষক আমার তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করেছে’ ।

 

 

 

 

 

 

তত্ত্বাবধায়ক
মো. আমজাদ হোসেন
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

 

 

অনুমোদনপত্র

 

 

 

মো. সালেকুজ্জামান কর্তৃক ‘‘চাঁদের অমাবস্যা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর একটি মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস’ শীর্ষক গবেষণাপত্রটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ শেষ বর্ষের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পাঠ্যক্রমের সম্পূরক হিসেবে অনুমোদন করা হল ।

 

 

 

 

 

 

 

 

তত্ত্বাবধায়ক
মো. আমজাদ হোসেন
অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা

 

 

সূচিপত্র

 

শিরোনাম পৃষ্ঠা

১. ভূমিকা ০৭

২. প্রারম্ভিক জীবন ০৮

৩. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস তুলনামূলক বিচার ১০

৪. চাঁদের অমাবস্যা ১৩

৫. মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ১৬

৬. সার-সংক্ষেপ ২৬

৭. তথ্যসূত্র ২৭

 

 

 

 

ভূমিকা

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। উদার নৈতিক চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাই তাঁকে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন শুধু তাই নয় তাঁর জীবন হয়েছে সুন্দর, সার্থক ও কলুষমুক্ত।

তিনি ধার্মিক ছিলেন কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। ধর্মান্ধতা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব, শিল্পতত্ত্ব, দর্শন, মনোবিজ্ঞান সহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রেই বিচরণ করতে আনন্দ পেতেন। স্বল্পভাষী, অসামান্য মেধাবী এবং শাণিত বুদ্ধিসম্পন্ন এই ব্যক্তিত্বের খুব কাছাকাছি যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই একবাক্যে উচ্চারণ করেছেন : “তিনি ছিলেন এমন এক উন্নত মানসিকতার প্রতিনিধি যিনি হাল ঠিকানায় দুরন্ত প্রবাসী, স্থায়িত্বে স্বভূগোলী নিশ্চয়তা।” অর্থাৎ প্রবাসে থেকেও স্বদেশের নিকটতম স্বজন ছিলেন তিনি। স্বদেশের প্রতি আত্মিক টানেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো তাঁকে প্রবাসেও অস্থির করে তুলেছিল। তিনি প্রকাশ্যে এবং গোপনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে।

 

প্রারম্ভিক জীবন

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা, মা নাসিম আরা খাতুন ও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়।

তার পিতৃমাতৃ বংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড় মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতী হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং ওয়ালীউল্লাহর বড় মামী ছিলেন নওয়াব আব্দুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক।

শিক্ষা

পারিবারিক পরিমণ্ডলের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মনন ও রুচিতে প্রভাব ফেলেছিলো। পিতার বদলির চাকরির সুবাদে ওয়ালীউল্লাহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অংশ দেখার সুযোগ লাভ করেন। ওয়ালীউল্লাহর শিক্ষাজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি একাধিক মাসিকপত্রে লেখালেখির সাথে জড়িত ছিলেন। পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের সাথে জড়িত থাকার সূত্রে কর্মজীবনের বড় একটা সময় তিনি বিদেশে কাটান। ১৯৫৫ সালে তিনি ফরাসি আন ম্যারি-র সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।

কর্মজীবন

কর্মজীবন ছাত্র অবস্থাতেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। বাধ্য হয়ে নয়, স্ব-ইচ্ছায়। তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা সৈয়দ নসরুল্লাহ এমএ ও বিএ পাশ করেছিলেন। তার পক্ষেও খুব স্বাভাবিক ছিলো এমএ পড়াটা। কিন্থ হয়নি। ১৯৪৮ সালে তিনি ইংরেজি দৈনিক দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় চাকুরি নেন। এ বছর তার পিতাও প্রয়াত হন (২৬ জুন)। তার তিনমাস আগে, মার্চ মাসে, তার প্রথম গ্রন্থ নয়নচারা গল্পগ্রন্থ বের হয়। নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেছিলেন ১৯৪১-৪২ সাল নাগাদ। এমন মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে,তিনি ভবিষ্যতে লেখকবৃত্তি বেছে নিতে চেয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরই তিনি দ্য স্টেটসম্যান এর চাকুরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা চলে আসেন এবং সেপ্টেম্বরে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদকের চাকুরি নেন। কাজের ভার কম ছিলো,তাই লালসালু উপন্যাস লেখায় হাত দিলেন নিমতলীর বাসায়। পরের বছরই এ উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে কমরেড পাবলিসার্স।

করাচি কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক হয়ে ঢাকা ছাড়েন ১৯৪৮ সালে। সেখান থেকে নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসে তৃতীয় সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস-আতাশে হয়ে যান ১৯৫১ সালে। অতঃপর একই পদে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বদলি ১৯৫২ এর শেষের দিকে। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় ফিরে এলেন তথ্য অফিসার হিসেবে ঢাকাস্থ আঞ্চলিক তথ্য-অফিসে। ১৯৫৫ সালে পুনরায় বদলি করাচির তথ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার তথ্য পরিচালকের পদাভিষিক্ত হয়ে, ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে, দেড় বছর পর পদটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে জাকার্তার পাকিস্তানি দূতাবাসে দ্বিতীয় সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস-আতাশে হয়ে রয়ে গেলেন ১৯৫৮ এর ডিসেম্বর অবধি। এরপর ক্রমান্বয়ে করাচি-লন্ডন-বন, বিভিন্ন পদে ও বিভিন্ন মেয়াদে। ১৯৬১ সালের এপ্রিলে ফার্স্ট সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস-আতাশে হিসেবে যোগ দিলেন পারীর দূতাবাসে। একনাগাড়ে ছ’বছর ছিলেন তিনি এ শহরে। দূতাবাসের চাকুরি ছেড়ে চুক্তিভিত্তিক প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট পদে যোগ দেন ইউনেস্কোতে, ১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট, চাকুরিস্থল ছিলো প্যারিস শহরেই, ইউনেস্কো সদরদপ্তরে। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইউনেস্কোতে তার চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়েছিলো। অবসরগ্রহণের নিয়ম হিসাবে পাকিস্তান সরকার ইসলামাবাদে বদলি করে কিন্তু তিনি প্যারিসেই থেকে গিয়েছিলেন।

বিবাহ ও সন্তানাদি

তার স্ত্রী ফরাসিনী আন্-মারি লুই রোজিতা মার্সেল তিবো। তাদের আলাপ হয়েছিলো সিডনিতে। ওয়ালীউল্লাহ যেমন পাকিস্তানি দূতাবাসে, অ্যান-মারি তেমনি ছিলেন ফরাসি দূতাবাসে। দেড়-দু বছরের সখ্য ও ঘনিষ্টতা রূপান্তরিত হয় পরিণয় বন্ধনে। ওয়ালীউল্লাহ তখন করাচিতে। সেখানেই ১৯৫৫ সালের ৩ অক্টোবর তাদের বিয়ে হয়। ধর্মান্তরিতা বিদেশিনীর নাম হয় আজিজা মোসাম্মত নাসরিন। নবলব্ধ নামকে বিয়ের কাবিননামাতেই বিসর্জন দিয়েছিলেন দু-জনে। তাদের দু সন্তান। প্রথমে কন্যা সিমিন ওয়ালীউল্লাহ, তার পরে পুত্র ইরাজ ওয়ালীউল্লাহ।

জীবনাবসান

অত্যন্ত অকালে প্রয়াত হন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে, ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর ফ্রান্সের প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয়, গভীর রাতে অধ্যয়নরত অবস্থায় মস্তিষ্কের রক্তরণের ফলে তার মৃত্যু হয়। পারী’র উপকণ্ঠে তারা একটি ফ্যাট কিনেছিলেন, সেখানেই ঘটনাটি ঘটে এবং ওখানেই সমাহিত করা হয় তাকে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস তুলনামূলক বিচার

ভাষার মায়া, শব্দের পর শব্দ, বাক্যের বিস্তার-যতি বিন্যাসের আড়ালে আশ্চর্য এক কুহক সৃষ্টি করেন সমাজ ও মানুষের বহিরাবরণ, অন্তর্ভুবনের ছবি আঁকায় পারদর্শী কথাশিল্প সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। মাত্র তিনটি উপন্যাসে যিনি বাংলা কথাসাহিত্যকে আমূল বদলে দিলেন। অনেক ঘটনা, নাটকীয়তা, উত্তেজনা ও দৃশ্যের সরল বর্ণনার ভিতর বাংলা সাহিত্যের যে রীতি ছিল, সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যকে ভিন্ন একটি অবয়ব দান করেন। তার রচনায় মানুষের বাস্তবজগতের পারিপাশ্বর্কি ছায়া দৃশ্যের তুলনাই মানুষের মনে প্রতিনিয়ত যে বাক বদলের খেলা চলে, অন্তর্জগতের দিক নির্দেশহীন গতি প্রবাহের মুহুর্মূহু পরিবর্তনশীল প্রকৃতি তিনি অঙ্কন করেছেন নিপুণ হাতে। সমাজের অতি সাধারণ মানুষের যে গল্প তিনি বলেছেন, তাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কোনো অতিনাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা করেননি। প্রতি মুহূর্তে মানুষ যে কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অজ্ঞতার বৃত্তে আবদ্ধ থেকে ঘটনাহীন একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর জীবন-যাপন করে, তার ছবি এঁকেছেন। আবার এই ঘটনাহীন মানবজীবনই যে প্রতিমুহূর্তে ঘটনা ও বাক তৈরি করে যাচ্ছে তার কথাই মূর্ত হয়েছে বার বার।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসগুলোর মূল সুর কিন্তু এক। অর্থাৎ জীবন জিজ্ঞাসা প্রতিকূল পরিবেশে নিজের বিশ্বাস ও বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া স্বকীয় অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো ও আপন সত্তার স্বরূপ উদঘাটন করে যাওয়া। ভণ্ড মজিদ, যুবক শিক্ষক আরেফ আলী, কফিল উদ্দীন উকিল, মুহাম্মদ মুস্তফা, স্কুল মিস্ট্রেস, খাদে আলী, দরবেশ কাদের তারা প্রত্যেকেই কিন্থ নিজের কৃতকর্মের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চেয়েছেন, নিজেদের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন। যদিও তাদের মধ্যে প্রতিনিয়ত পরশ্রীকাতরতা, স্বার্থপরতা, হিংসাপরায়ণতা মহানুভবতা, পলায়নপর মনোবৃত্তি, বিদ্রোহ, মমত্ববোধ প্রেম ও সহানুভূতির মিশ্রণে দায়বোধ, প্রতিশোধ পরায়ণতা, দুর্বল মনোবৃত্তি, স্মৃতিবিভ্রম ও অসহায়ত্বের নগ্ন প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। তিনি মানুষ ও সমাজের উপরিতলের কেন্দ্র ও প্রান্তে ছুটে যাননি এবং মানুষের অন্তর্লীন রহস্য, গূঢ় অভিব্যক্তিকে অনুসন্ধান করেছেন। তার উপন্যাসের বিশেষ বৈশিষ্ট্য নির্লিপ্ত ভঙ্গি, নৈর্ব্যত্তিক অবস্থান, উপন্যাসের চরিত্র ও তার প্রতিপার্শ্ব তৈরি করা। এই অর্থে যে উপন্যাসগুলোর খল চরিত্র অথবা নায়ক যেই হোক না কেন;’ তিনি কিন্তু তাদেরকে আরোপিতভাবে উপস্থাপন করেননি। এই বৈশিষ্ট্য যদিও তার প্রতিটি উপন্যাসেই কম বেশি লক্ষণীয়, তবে লালসালু উপন্যাসটিই এ ক্ষেত্রে অধিকতর সফল।

তাঁর উপন্যাসের লাইনকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেছেন যাতে কোথাও কোথাও লাইনকে পাঠকের নিকট কবিতার লাইনের মতো বিভ্রম তৈরি করে। অর্থাৎ তার গদ্য ভাষা কাব্য ভাষার মতো রহস্য, ইমেজ উপমা, চিত্রকল্প শব্দের কারুকাজে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে তিনি কেবল ভাষা তৈরি করেছেন, তাই নয়, ভাষা দিয়ে দৃশ্যের পর দৃশ্য প্রলম্বিত ছবি এঁকেছেন। ভিটগেনস্টাইন যাকে শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা বলেন। তার বাক্য বিন্যাস, শব্দের কুহক মায়া, অপর দুই উপন্যাসে আরও বেশি লক্ষণীয়।

চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদোর তুলনায় লালসালু কিছুটা সরল ভাষা ভঙ্গিতে রচিত। উপন্যাসগুলোর একটি সরল সাদৃশ্য হলো মানুষের নিচতা, শঠতা ও গোপন পাপাচার। তিনটি উপন্যাসের সূচনাই কিন্তু গোপন পাপাচার ও নৈতিক স্খলন থেকে শুরু হয়। চাদের অমাবস্যা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। কিন্তু আখ্যানটির সূচনা কিন্তু দরবেশ কাদেরের গোপন প্রণয় সৃষ্ট নৈতিক স্খলন ও ভয় থেকে। গোপন প্রণয়ন প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে অসতর্কতাবশত সে হত্যাকাণ্ডের মতো একটি জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আখ্যানে দেখা যায় ঘটনাক্রমে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী যুগপৎভাবে দ্বিধাগ্রস্ত অসংলগ্ন ও ভয়কাতর হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে তার অসহায়ত্ব, দারিদ্র্য, আশ্রয়চ্যুতি, কৃতজ্ঞতা, তার নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দায়িত্ববোধের জায়গায় এক বিচিত্র অনুভূতি তার ভিতর ভর করে। সে ভিতরে ভিতরে কুকরে ওঠে। সর্বান্তকরণে সে তার বিশ্বাস দিয়ে অনুভূত হয়ে চেয়েছিল ঘটে যাওয়া সমগ্র ঘটনাই একটি দুর্ঘটনা, কিংবা প্রকৃতির নিষ্ঠুর খেয়াল মাত্র। কিন্তু দৃশ্য পরস্পরা একজন খামখেয়ালী, অমিতচারী, মুখোশধারী, ঘৃণ্য কামুক ও খুনিকে তার সামনে নিয়ে আসে। সমস্ত আশ্রয় ভাবনা, কৃতজ্ঞতার আপাত মূল্যবোধ ভেঙে সে ভিতর থেকে একজন দৃঢ়চেতা মানুষ হয়ে ওঠে। যেখানে আপাত বুদ্ধিমনস্ক মানুষের উপস্থিতি পাওয়া যায় না। আমরা দেখি সে তার পরিণতি সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত থাকলেও লোক প্রলোভন শেষ পর্যন্ত তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলেনি। উপন্যাসে দৃশ্য পারস্পরিকতা এমনভাবে বিন্যাস করেছেন। যাকে যে কেউ জাদুবাস্তবতা বলে ভুল করতে পারেন। কারণ আমরা বাঁশঝাড়ে পাতার খসখস শব্দ, হঠাৎ দৃশ্য, মানুষ অন্তর্নিহিত হয়ে যাওয়া, কিংবা নির্জন রাতে চাদের আলো-ছায়ায় বাতাসে কম্পমান কলাপাতাকে মানুষের আদল ভেবে ভুল করার ভিতর কোনো অলৌকিকতা নেই। এর সবকিছু ব্যক্তি মানুষের মনের দুর্বল মুহূর্তের অনুভূতি মাত্র। আবার নদীর বালুচরে কোনো রকমে লাশকে পুঁতে রাখলে যে কোনো মুহূর্তে জলের আঘাতে ভেসে যেতে পারে। তার ভিতর কোনো অতিলৌকিক ঘটনা নেই, যা আছে তা হলো ভাষার যাদুকরী বর্ণনা, দৃশ্যের কুহক দেখার ও কল্পনার বিভ্রম। এখানে লেখক কিন্থ অত্যন্ত সফলভাবে পাঠকের মনোজগতে আশ্চর্য এক কথনভঙ্গির মায়াকুহক তৈরি করতে সম হয়েছেন। উপন্যাসটি যত না জাদুবাস্তবতার রূপায়ন। তার চেয়ে বেশি করে মানুষের অন্তর্জগতে প্রতিনিয়ত যে দ্বন্দ্ব চলে তার একটি সরলভঙ্গির দৃশ্যায়ন। সামন্ত্রতান্ত্রিক জীবন ও ধর্মবোধ, গ্রামীণ আনুগত্যপ্রবণ জীবন প্রবাহ, পরান্মুখ সমাজ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক দূরবস্থার শিকার হয়ে নৈতিক স্খলনের পথে পা বাড়ানো ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের প্রতি দুনির্বার আকর্ষণের প্রতি একটি সুতীব্র কামনার শিল্পশৈলী। একই সঙ্গে আমরা দেখি ভ্রাতৃস্নেহের কাছে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ন্যয়পরায়ণতা পরাভব স্বীকার করে। উপন্যাসে আরেফ আলী নিরুত্তেজ প্রায় মেরুদ-হীন একজন মান্যুষ নামের প্রাণী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে পৌরুষের পরিচয়কেই বড় করে তোলে। বিস্তৃত গল্প না বলেও লেখক কিন্থ মানুষের প্রবণতা তার অন্তিম গতিপ্রকৃতিকেই চিহ্নিত করেছেন।

সবমিলে উপন্যাসটি তুলনামূলকভাবে মনস্তাত্ত্বিক। উপন্যাসে যত না ঘটনার বিস্তার তার চেয়ে বেশি মনোজগতের ভিতর তার দ্বান্দ্বিক আলোড়ন। উপন্যাসে মূলত তিনটি স্তরের মাত্রায় আখ্যানের কাহিনী বিন্যাস ঘটে। অর্থাৎ একজন কত্থক আর একজন কত্থক অন্যের যে কাহিনী বলে যাচ্ছেন তিনি তা বিবৃত করেছেন।

‘চাঁদের অমাবস্যা’

‘চাঁদের অমাবস্যা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দ্বিতীয় উপন্যাস, প্রকাশ পেয়েছিল ঢাকা থেকে ষাটের দশকে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিশ্বমানের আধুনিক কথাশিল্পী। পূর্ব বাংলার কথাসাহিত্যকে তিনি বিশ্বমানসম্পন্ন আধুনিকতায় রূপ দেন। কথাশিল্পীর এই উপন্যাসের মধ্যে অস্তিত্ব-সংকটের লড়াই আছে যেমন, তেমনি মনস্তাত্ত্বিক জগতে বর্ননা তা পাঠকে বাস্তব অবাস্তবের এক ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে পূর্ব বাংলার অবরুদ্ধ শৃঙ্খলিত সমাজের ভেতরগত গূঢ় চিত্র অঙ্কন করেছেন স্বৈরাচার পিষ্ট সমাজের মানুষের মনোবৈকলিক সংকটের চেহারা উন্মোচন করেছেন । ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের নায়ক একজন স্কুলশিক্ষক নাম আরেফ আলী, ঔপন্যাসিক তাকে যুবক শিক্ষক বলে বারবার অভিহিত করেছেন।

যুবক শিক্ষক অতিশয় দরিদ্র, চাঁদপারা গ্রামে তার বাড়ি; হাতের তালুর মতো একটু জায়গা-জমি আছে তাদের। বিধবা মা সংসারে আর কেউ নেই শাক-সবজির জমিটুকু বিক্রি করে উচ্চশিক্ষার অভিলাষ পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

তাই সদ্য প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলে সে চাকরি নিয়েছে । গ্রামের জোতদার বড় দরবেশ সাহেব স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন । তার বাড়িতেই লজিং মাস্টার হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে যুবক শিক্ষক।
যুবক শিক্ষকের কোনো খরচ নেই, কেননা আশ্রয়দাতাদের বাড়িতে খায়, থাকে বেতন যা পায়, তা পাঠিয়ে দেয় বিধবা মাকে।

এক গভীর পূর্ণিমা রাতে যুবক মাস্টার বড় বাড়ি সংলগ্ন জঙ্গলের মতো ঘরের পেছনে এক ঝোঁপের পাশে একটি জাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে প্রাকৃতিক কাজ সারার জন্য। হঠাৎ দেখতে পায় বড় বাড়ির দাদা সাহেবের ছোট ভাই কাদের দরবেশ হেঁটে যাচ্ছে একা একা ভরা জোছনার ভেতর দিয়ে। যুবক মাস্টার কৌতূহলী হয়ে ওঠে এবং সে কাদেরকে অনুসরণ করতে থাকে।

দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয় যুবক মাস্টারকে। রাতের জোছনা ভরা, রূপালি চাঁদের ঢেউ খেলানো প্রকৃতি চষা ক্ষেত, গৃহস্থের বসতবাড়ি, ভিটেবাড়ি পেরিয়ে কাদের দরবেশ নদীর পাড়ে এক গভীর বাঁশবনের ভেতর চলে যায়। এর মধ্যে যুবক মাস্টার কাদেরের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে তাকে হারিয়ে ফেলে। একটা অনতিদীর্ঘ সময় পর সেও হাজির হয় ওই বাঁশবনে। দেখতে পায় এক বীভৎস দৃশ্য : ‘শীতের উজ্জ্বল জ্যোতস্না রাত, তখনো কুয়াশা নামে নাই, বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়, সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। পায়ের ওপর একঝলক চাঁদের আলো”

এই পাশবিক দৃশ্য দেখে তার মত যুবক শিক্ষকের অস্তিত্বের মধ্যে প্রলয়কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। সে হতভম্ভ, বিভ্রান্ত, বিমূঢ় ও বিপণন দশায় উপনীত হয়। তার অস্তিত্বের মধ্যে মারাত্মক সংকট দেখা দেয়। সে একটা মরণাপন্ন মুমূর্ষু দশায় উপনীত হয়। তার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। সে চষা ক্ষেত বরাবর রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াতে থাকে, এক পর্যায়ে সে ক্ষেতের আইলের পাশে উবু হয়ে পড়ে থাকে। তার ভেতর থেকে চিরতরে প্রশান্তি শিশিরের মত উবে যায়।
সে কত কষ্টে পড়ালেখা শিখেছিল, স্কুলে চাকরি পেয়ে তার দারিদ্র্য বিমোচন ঘটেছিল, আশ্রয় পেয়েছিল এই বড় বাড়িতে। এরা জোতদার-ভূস্বামী, এরাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, বেতন পেলে বিধবা মাকে পাঠিয়ে দিত। অথচ এ বাড়িরই প্রভাবশালী ব্যক্তি কাদের দরবেশ এই পাশবিক ব্যভিচারের সঙ্গে জড়িত?

যুবক শিক্ষকের মতো গ্রাম্য-দরিদ্র-নিরীহ মানুষ এমন ভয়ঙ্কর দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়নি। বলা হচ্ছে, ”সাপের মুখগহ্বরে ঢুকে ব্যাঙের আওয়াজ যেন হঠাৎ’ থামে বা মস্তক দেহচ্যুত হলে মুখের আওয়াজ যেন অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়, দেহচ্যুত মাথা এখনো হয়তো আর্তনাদ করছে, কিন্তু তাতে আর শব্দ নাই”

অমানবিক উদাহরণ সাপের গ্রাসের সামনে ব্যাঙ যেমন অসহায়, তেমনি ব্যাঙের মত অসহায়-দরিদ্র, গ্রামের এক মাঝির বন্ধ্যা যুবতী স্ত্রীকে বাঁশঝাড়ে ডেকে এনে কাদের দরবেশ বলাৎ্কার করে। কৌতূহলবশত যুবক শিক্ষক ওখানে উপস্থিত হলে শুকনো বাঁশ পাতার মচমচ শব্দ শুনে বন্ধ্যা বউটি ভয়ে দাপাদাপি করেছিল, হয়তো চিৎকার দিতে চেয়েছিল, হয়তো নিজেকে কাদেরের লোমশ হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল। তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করার জন্য কাদের শায়িত নারীর গলদেশ চেপে ধরেছিল, তাতে তার মৃত্যু ঘটে, অর্ধ বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকে কাদের বাঁশঝাড় থেকে দ্রুত বের হয়ে যায়।

এখানে কাদের যে বন্ধ্যা বউটিকে ভোগ করার জন্য ডেকে এনেছিল, হয়তো সে স্বেচ্ছায়ই এসেছিল। গরিব,তাই এত বড় প্রভাবশালী বড় বাড়ির মানুষের আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেনি। মানুষের পদশব্দ শ্রবণ করে বিচলিত হয় কাদের কেউ জেনে ফেললে বড় বাড়ির ইজ্জত যাবে। তাই বউটির গলা চেপে ধরেছিল, যাতে শব্দ না করে যাতে কেউ না জানে জীবনের চেয়ে ঠুনকো ইজ্জত এখানে বড় হয়ে দেখা দেয় বিবেক, মনুষ্যত্ব লাঞ্ছিত হয়। এরই নিদারুণ প্রতিক্রিয়া হয় যুবক শিক্ষকের বিবেকের মধ্যে সবচেয়ে মর্মানত্মিক হচ্ছে, তার মধ্যে কাজ করতে থাকে প্রতিকারহীন প্রতিক্রিয়া।
জ্যোৎস্না রাতে এক নগ্ন নারীর লাশ আবিষ্কার করে গ্রামের তরুণ স্কুল মাস্টার। খুনী সেই দরিদ্র স্কুল মাস্টারের আশ্রয় দাতা পরিবারেরই একজন। কাজেই বিষয়টা চেপে যায় সে। কিন্তু পরবর্তীতে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে – একদিকে সত্য প্রকাশ করতে না পারার বেদনা অন্যদিকে তার আশ্রয় এবং শিক্ষাকতার পেশাটা হারানোর ভয়। এই শিক্ষক শুধু যে একটা হত্যাকান্ডের বিষয়ে অবগত তা নয়, হত্যাকারীর আহ্বানে লাশ গুম করার ব্যাপারে একজন সহকারীও !

সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ অসাধারণ দক্ষতায় এই স্বল্প পরিসরে গড়ে ওঠা প্লটের উপরই একধরনের আলো-ছায়ার খেলা খেলেছেন। ঘটনার প্রেক্ষিতে একজন লোকের মনস্তাত্ত্বিক অবহ থেকে বাস্তবে ফিরে আসা অতঃপর আবার মনস্তাত্ত্বিক জগতে ফিরে যাওয়ার যে বর্ননা পাঠকে বাস্তব অবাস্তবের এক ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়।

মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’

উপন্যাসের বিষয়বস্তু এটাই। মূল রহস্য শুরু এর পরেই। রহস্য বলতে, এই খুনের ঘটনাকে যুবক শিক্ষক কিভাবে কাটাছেঁড়া করছেন তার উপর। যুবক শিক্ষক আরেফ আলী নিজের মনের মধ্যে যে বিচার বিশ্লেষণ জারি রাখেন তা তার মনস্তাত্ত্বিক সংকট থেকে উত্থিত। একজন স্বল্প বেতনভুক শিক্ষক যিনি নিরাপদ জীবনযাপন করছিলেন দাদাসাহেব-এর বাড়িতে খেয়েপরে, সেই শিক্ষকের মনস্তত্বে জীবন সম্পর্কে অনেক উঁচু ধারণা এতদিন ক্রিয়াশীল ছিল, সেই মানুষটা যুবতী বউয়ের লাশ দেখার পর থেকে এটাই বিশ্বাস স্থাপন করতে চাইছিল যে, কাদের তাকে (যুবতী বউ) খুন করেনি।

এই বিশ্বাসের উপর নানা ডালপালা ছড়িয়ে তিনি যুক্তি স্থাপন করার পর মনে মনে শান্তি পান বা নিরাপদ অনুভব করেন। এরপরে যখনই তিনি জানতে পারেন যে কাদেরই তাকে খুন করেন, তখন আবার যুবক শিক্ষকের যুক্তির ডালপালা এটা ভেবে শান্ত হয় যে, কাদের হয়তো যুবতীকে ভালবাসত অনেক। সেই ভালবাসার মানুষ যাতে মৃত্যুর পর সমাজের চোখে খারাপ না হয় তাই যুবক শিক্ষকের সাহায্য নিয়ে লাশ ডুবিয়ে দেন নদীতে।

এভাবে এক সময় যুবক শিক্ষক আবিষ্কার করেন, যুবতীর মৃত্যুর সাথে গভীর ভালবাসার কোনো সম্পর্ক নেই। কাদের তার পরিবারের মান রক্ষার্থে নানা ব্যবস্থা নিয়েছে।

যে মনস্তাত্ত্বিক সংকট থেকে যুবক শিক্ষক এসব বিচার বিশ্লেষণ জারি রাখেন, সেই অস্তিত্ব তখনই তার নাকের ডগায় ভেঙে পড়ে যখন দেখতে পান পুরো সমাজে একটা অন্যায়কে চাপা দেয়ার অদ্ভূত বিশ্রী গোপনীয় সমাজ কাঠামো চালু আছে নানা মিথ-মিথ্যার বেসাতিতে।

যুবক শিক্ষক মনস্তাত্ত্বিক সংকট তাদের অবচেতনে চাপা পড়ে থাকে না। আমাদের কদর্য জীবনের ভন্ডামিতে আরেফ আলী অভ্যস্ত হননি দেখেই হয়তো বারবার লেখক তাকে ‘যুবক’ শিক্ষক বলে সম্বোধন করেছেন।

জীবন কে অন্ধকার অভিজ্ঞতায় ঝালিয়ে নেয়ার অনুভূতি কত ভয়াবহ তার অপরূপ প্রকাশ এই লাইনে: ‘সত্যটি গ্রহণ করা কি এত সহজ? একবার গ্রহণ করলে জীবনে একটা ফাটল ধরবে না? তারপর কি পৃথিবী সে-ই পৃথিবী থাকবে?’

উপন্যাসে নিঃসঙ্গতা, স্রস্টা-বান্দা’র কর্তৃত্ব, অভ্যস্ত মুখোশের সমাজ বার বার ছুঁয়ে গেছে।

‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের মূল বিষয় একটি অপরাধের এক অশুভ কমের্র জ্ঞান। যুবক শিক্ষক হয়ে দাঁড়ায় এ জ্ঞানের ধারক। এ জ্ঞানের সঙ্গে যে দায়িত্ববোধ যুক্ত,সেটি তাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। আমি যেটা বলতে চাই তা হলো, সেই অশুভ কর্মটি বা অপকর্মের হোতা, কেউই গুরুত্বপূর্ণ নয়,বরং সবচেয়ে জরুরী হল একটি অপকমের্র বাইরের মানুষটির আচরণ। যুবক শিক্ষক অকস্মাৎ বিদ্রোহ করে বসে। যুবক শিক্ষক কাপুরুষ থেকে এক সাহসী মানুষ এবং একই সঙ্গে এক শহীদে পরিণত হয়”

‘চাঁদের অমাবস্যা’র ‘চুম্বক-চরিত্র’ যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর আত্ম-প্রবঞ্চনা এবং অস্তিত্ব-অন্বেষার মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াদি। আর খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই আলোচনায় প্রবেশ করবে আখ্যানটির প্রতিবেশ এবং ধর্ম কিংবা বিচার-বিবেচনা বিষয়ে লেখকের নানানকৌণিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়- কথাটি মিথ্যা নয় কিছুতেই। তারপরও বাঁচবার আকুলতা বুকে নিয়ে আর অমরতা লাভের ঔষুধের দোকান খুঁজতে খুঁজতে সাড়ে তিন হাত নিরাপদ ও আপন প্লটের দিকে আমাদের নিবিড়-নিশ্চিত অভিযাত্রা। মানুষের বাঁচবার এই অশেষ আকুলতার কারণেই গোরস্থানের সামনের ফ্ল্যাটের চেয়ে লেকের পাশের বাড়ির দাম দাঁড়ায় অনেকটা বেশি।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ উপন্যাস-গল্প ও নাটকে ‘ভয়’, ‘চাঁদের আলো’, ‘অন্ধকার’ প্রভৃতি অনুষঙ্গ পরিবেশিত হয়েছে বারবার। কেউ কেউ হয়তো ভাববেন লেখকের অবচেতনে এমনটি হয়েছে; আবার কারো মত হলো- না, তিনি সতর্কভাবেই প্রয়োগ করেছেন এইসব প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ। আর বিশেষ অভিনিবেশের জায়গাটি দখল করে নিয়েছে তাঁর পাঁচটি উপন্যাসের ভিন্ন ভিন্ন ক্যানভাস ও পরিবেশনশৈলী। বর্তমান কাহিনিতে চাঁদের প্রসঙ্গ, অমাবস্যার প্রতীক, মানুষের চিন্তাতীত ভাবনারাজ্য ও অর্জিত অভিজ্ঞান লেখক সাজিয়েছেন টেবিলে পাতা প্লেটের সারিতে- আপন কল্পনা ও জীবন-জিজ্ঞাসার অনুভবজ্ঞানকে অবলম্বন করে। এই কথাটি নিতান্তই স্বাভাবিক হলেও সরল নয়- অন্তত কথাকারের দেখবার ও দেখাবার ভঙ্গিটি চিনে নিতে আমাদেরকে খানিকটা চোট খেতে হয় বৈকি! সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ প্রখর পর্যবেক্ষণসম্পন্ন ও সাহসী কথানির্মাতা। সময়ের সমূহ চালচিত্র এবং মানুষের সমকালীন প্রবণতা ঠিক ঠিক পাটাতনে রেখে পরিবেশন করার কৌশলটি তিনি আয়ত্ব করেছিলেন। তাঁর সাহিত্যভাবনায় আন্তর্জাতিক মেজাজ ছিল। আর বর্ণনা ও উপনস্থাপন ভঙ্গিতে নতুনত্ব সৈয়দের সাহিত্যের বিশেষ মনোযোগ-আকর্ষণী অধ্যায়। ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় যুবক শিক্ষকের ভয় ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিফলনের সমাচার আঁকতে গিয়ে তিনি মানবিক অস্তিত্ব-সংকট এবং ব্যক্তির দায় ও ভারবোধের প্রসঙ্গাদি পরিবেশন করেছেন- সম্ভবত নিবিড় অভিজ্ঞানকে মান্য জেনে।

তাঁর গ্রন্থে প্রকৃতি, রাত, চাঁদ, অন্ধকার, আলো, কুয়াশা, নদী, বাঁশির শব্দ, বাতাসের আওয়াজ; ব্যক্তির সংশয়, সারল্য, আত্মনিমগ্নতা- এইসব বিষয় ও অনুভব সারিবদ্ধভাবে হাজির হয়েছে পাঠকের সামনে। কখনো দ্বিধা, কখানো উৎসাহ, মাঝে মধ্যে বিব্রতবোধ ও মানসিক চঞ্চলতা নিয়ে পাঠে অগ্রসর হতে হতে সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতের নানান বাঁক ও ঢালের ধাক্কায় (ঠেকে শিখে) নিজের জীবনদর্শনকে পাকিয়ে তুলে পাঠক খানিকটা তৃপ্তি আর কিছুটা অস্পষ্টতার জিজ্ঞাসা নিয়ে চোখ নামিয়ে নেন (পাঠ শেষ করা অর্থে)। তবে পাঠে প্রবেশের আগে লেখক সৈয়দ সাহেবের একটা ঘোষণার প্রতি আমাদের দৃষ্টি পড়ে। তিনি জানিয়েছেন: ‘এই উপন্যাসটির বেশির ভাগ ফ্রান্সের আলপ্স্ পর্বত অঞ্চলে পাইন-ফার-এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক একটি ক্ষুদ্র গ্রামে লেখা হয়। মঁসিয় পিয়ের তিবো এবং মাদাম ইভন তিবোকে তাঁদের আতিথ্যের জন্যে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।’ কাহিনিনির্মাতার এই ব্যক্তিগত কৈফিয়তটিতে সামান্য মনোযোগ স্থাপন করতে হয় বটে- পর্বত অঞ্চল, গাছ-গাছালির ছায়াঘেরা ছোট্ট একখানি গ্রাম আর সহৃদয় এক দম্পতির উপস্থিতির কারণে। ব্যাপারটিকে কেবল কৃতজ্ঞতা ভাবতে পারলে কোনো ঝামেলা ছিল না; কিন্তু এটি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের সূত্রাবলি পেরিয়ে গল্পের ক্যানভাসের সীমানা ও ভেতরবাড়ি পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে বলে অনুমান হওয়ায় ওই বিশেষ অভিনিবেশের জায়গাটি তৈরি হয়েছে। মানুষ যে নির্জন দ্বীপে এক একটি বৃক্ষ কিংবা বনাঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকা নীরব ও একাকি গাছ, সে অভিজ্ঞান আমাদেরকে খানিকটা ভাবায় বৈকি! গ্রামটির ‘ক্ষুদ্র’তা মানব-সভ্যতা ও তার কারিগর মানুষের সীমাবদ্ধতার প্রতীক যে নয়, তা-ই বা কী করে বলি? আর যুবক শিক্ষক কোনো এক রাতে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যে যুবতীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে, এমনও তো হতে পারে এই ঘটনাটি ওই ‘ক্ষুদ্র’ গ্রামটিতে সত্যি সত্যি ঘটেছিল! এবং চাঁদের আলোপড়া পায়ের ওই মৃতদেহটিকে ঘিরে আবর্তিত সমস্ত ঘটনার বিবরণ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর বর্ণিত ‘মঁসিয়’ ও ‘মাদাম’-এর কাছ থেকে জেনেছেন! যাই হোক, এই সামান্য সন্দেহটুকু আপাতত চেপে রেখে, কী ঘটেছিল এবং ঘটনার চারপাশের ব্যাপারাদির রহস্যই বা কী- সেসব আমরা পর্যবেক্ষকের কাতারে দাঁড়িয়ে দেখবো গল্পকারিগরের পরিবেশন কায়দা আর প্রাসঙ্গিক মাল-মসলার প্রতি নিবিড় অনুসন্ধানি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে।

শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্নারাত, তখনো কুয়াশা নাবে নাই। বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। অবশ্য কথাটা বুঝতে তার একটি দেরি লেগেছে, কারণ তা ঝট্ করে বোঝা সহজ নয়। পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো। শুয়েও শুয়ে নাই। তারপর কোথায় তীব্রভাবে বাঁশি বাজতে শুরু করে। যুবতী নারীর হাত-পা নড়ে না। চোখটা খোলা মনে হয়, কিন্তু সত্যিই হাত-পা নড়ে না। তারপর বাঁশির আওয়াজ সুতীব্র হয়ে ওঠে। অবশ্য বাঁশির আওয়াজ সে শোনে নাই।

এই হলো ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের প্রথম অনুচ্ছেদ। কুয়াশাহীন শীতরাত্রি, হালকা অন্ধকার, যুবক শিক্ষকের এক যুবতীর ডেডবডি দর্শন, জোছনার প্রসন্নতা, অজানা বাঁশির সুর- সবকিছু মিলিয়ে সাদার অন্তরালে কালো, স্পষ্টতার আড়ালে অস্পষ্টতা আর সত্যকে ঢেকে দিয়ে মিথ্যার প্রভাববিস্তারের এক ধরনের ছায়া-সন্দেহ তৈরি হয় গল্পের ক্যানভাসে। তারপর নানান রহস্য আর সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতের প্রতি পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখক অগ্রসরর হতে থাকেন। চাঁদের আলো থাকলে অমাবস্যা কীভাবে আসে!; কিংবা অমাবস্যা রাতে তো জ্যোৎস্না থাকার কথা নয়!- এইসব জিজ্ঞাসার ভেতর দিয়ে পাঠক পারি দিতে থাকে বিশেষ এক অভিজ্ঞানের পথে দোল-খাওয়া অভিযাত্রায়! সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কাহিনি ও আখ্যানের বিশেষত্ব হলো বিষয় এবং ভাষার জটিলতা। বর্ণনার গভীরে প্রবেশ করার কাজটা যেন অনেক সময় পাঠকের জন্য কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি বোধ ও প্রসঙ্গকে নির্ভর মেনে তার গল্পের শরীর, শিরা ও উপশিরার গঠনকাজ চলতে থাকে চেতন-অচেতন, থাকা-না-থাকা আর জানা-অজানার যাবতীয় সদর দরোজা ও গলির পথ ধরে। যুবক শিক্ষক যখন বাঁশঝাড়ের মধ্যে মৃতদেহটি দেখতে পায়, তখন কে যেন হঠাৎ তার সামনে দিয়ে দৌড়ে পালায়। সম্ভবত সে হত্যাকারী (ধর্ষণকারীও কি? যুবতীটিকে কি ধর্ষণের পর মেরে ফেলা হয়েছে?)। কিন্তু তাকে সে স্পষ্টভাবে দেখতে পায় না। লেখক বলছেন ‘নিরাকার বর্ণহীন মানুষ’। যুবক শিক্ষক চাঁদের আলো পছন্দ করে। যদিও জোছনার সমূহ ইতিবাচকতাকে সে আত্মস্থ করতে পারেনি; ‘যেখানে সে দাঁড়িয়েছিল সেখানে ছায়া, কিন্তু চতুর্দিকে জ্যোৎস্নার অপরূপ লীলাখেলা।’ তবে ‘জ্যোৎস্না-উদ্ভাসিত রাতের প্রতি তার অদমনীয় আকর্ষণ।’ হত্যাকাণ্ডটিকে ঘিরে যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর ঘোরলাগা অবিরাম সব মুহূর্তকে ছড়ানো ছিটানোভাবে বিন্যাস করে ঔপন্যাসিক পুরো কাহিনির ঘটনা-পরম্পরা সাজিয়েছেন। তবে কার্যকারণ হিশেবে পাঠককে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। সেটি এরকম:

চন্দ্রালোকের দিকে তাকিয়ে যুবক শিক্ষক হয়তো বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ নির্জন রাতে চলনশীল কিছু দেখতে পেলে প্রথমে সে চমকে ওঠে। তারপর সে তাকে দেখতে পায়। বড়বাড়ির কাদেরকে চিনতে পারলে তার বিস্ময়ের অবধি থাকে না। চন্দ্রালোক-উদ্ভাসিত এ-মায়াময় রাতে কাদেরের আকস্মিক আবির্ভাব তার কাছে হয়তো অজাগতিক এবং রহস্যময়ও মনে হয়। এত রাতে এমন দ্রুতগতিতে কোথায় যাচ্ছে সে?

তখন যুবক শিক্ষকের চোখ জ্যোৎস্নায় ঝলসে গেছে, তাতে ঘুমের নেশা পর্যন্ত নাই। দ্রুতগামী কাদেরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটি ঝোঁক চাপে মাথায়। সে ঠিক করে, তাকে অনুসরণ করবে।

-এই যে অন্বেষার অভিপ্রায়। এখান থেকেই আরম্ভ হয় যুবক শিক্ষকের অস্থিরতা-ছোটাছুটি। অস্থিরতা ও ভ্রমণ যতোটা না শারীরিক, তার চেয়ে ঢের বেশি মানসিক! বিস্ময় আর বিভ্রান্তির বিরাট পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। নিজের সাথে নিজের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত পরাজিতও হয় এই যুবক। কথানির্মাতা ‘যুবক শিক্ষক’ শব্দযুগলের ভেতর দিয়ে সামর্থ্য-সাহস-স্পৃহা-সম্ভাবনা প্রভৃতি সামাজিক পজিটিভ সমাচার প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বোধকরি। কিন্তু তিনি দেখেছেন আরেফ আলীর বিপন্নতা। সত্য প্রকাশে তার সাহসহীনতা। নিজের আশ্রয় (বসবাস করবার জন্য) এবং চাকরি টিকিয়ে রাখতে সে অপরাধকে গোপনে প্রশ্রয় দিয়ে চলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস করে না। সতর্ক দৃষ্টিতে খেয়াল করলেই টের পাবেন- আমাদের দেশের শিক্ষকসমাজ এইরকমভাবে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে মানসিক যন্ত্রণা ও ব্যর্থতার তাপে পুড়ছে প্রতিদিন! শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না যেন কিছুতেই! বর্ণিত যুবক শিক্ষক নিজের স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত নৈতিক অবস্থানের কাছে পরাজয় মেনে নেয়; অবশ্য সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বাস্তব পরিবেশ-পরিস্থিতি তাকে বাধ্যও করে অনেকটা। ‘জটিল এবং পরিশ্রমসিদ্ধ আত্মপ্রবঞ্চনাটি শুরু হয় তখন, যখন আত্মরক্ষার প্রবল বাসনার জন্য তার বিবেকের নির্দেশ শুনতে যুবক শিক্ষক অক্ষম হয়ে পড়ে। তারপর তার লজ্জাকর ভীতি-দুর্বলতা সে নিজের কাছেই লুকাবার চেষ্টা করে। সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষকদের সামাজিক-পারিবারিক-ব্যক্তিগত অবস্থা ও অবস্থান, চিন্তা ও স্বপ্নের পরিধি, মনস্তাত্ত্বিক বিচরণের সীমানা প্রভৃতি বোঝাতে লেখকের একটি বর্ণনার কিছু পাঠ নেওয়া যায়:

ক. চুনবালিতে লেপা বাঁশের দেয়াল, কাঠের ঠাট, ওপরে তরঙ্গায়িত টিনের ছাদ। ছাত্রদের সামনের বার্নিশশূন্য বেঞ্চিতে কালির দাগ, অনেক গ্রীষ্মের ঘামের ছাপ, এখানে-সেখানে ছুরির নির্দয় আঁচড়। অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার টেবিলের পেছনে বসে যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। গায়ে নিত্যকার মতো সামান্য ছাতাপড়া, জীর্ণ সবুজ আলোয়ান, পরনে আধা-ময়লা সাদা পায়জামা, পায়ে ধুলায় আবৃত অপেক্ষাকৃত নোতুন পাম্প-সু। অভ্যাসমতো টেবিলের তলে সে অবিরাম ডান পা নাড়ে পা-টি যেন কলযন্ত্রে চালিত হয়।

খ. দরিদ্র যুবক শিক্ষক, কোপন নদীর ধারে ক্ষুদ্র গ্রামগুলোকে ‘ক্ষুদ্র’ বলার পেছনে সৈয়দ সাহেবের বিশেষ কোনো ইঙ্গিত আছে কী? তিনি ফ্রান্সের যে গ্রামে বসে কাহিনিটি কম্পোজ করেছেন, তাকেও ‘ক্ষুদ্র’ বলে অভিহিত করেছেন!] চাঁদপারা গ্রামে তার জন্ম। কষ্টেসৃষ্টে নিকটে জেলা শহরে গিয়ে আই.এ পাস করেছে, সুপরিচিত নদী-খাল-বিল ডোবা-মাঠ-ঘাট সুদূরপ্রসারী ধান ফসলের স্রোতের বাইরে কখনো যায় নাই। সমতল বাংলাদেশের অধিবাসী, পর্বতমালা কখনো দেখে নাই। বই-পুস্তক, সাময়িক পত্রিকা-সংবাদপত্রে কোনো কোনো পর্বতের ছবি দেখেছে, কিন্তু অনেক পর্বতের শুধু নামই শুনেছে। এন্ডিজ, উরাল, ককেসিয়ান, আলতাই পর্বতমালা। কত নাম। সব স্বপ্নের মতো শোনায়।… হিমালয় সে দেখে নাই। বস্তুত সে কিছুই দেখে নাই। দরিদ্র শিক্ষক কিছুই তার দেখার সৌভাগ্য হয় নাই।

আমাদের দেশে এমন সব যুবক শিক্ষকের ঘাড়ে বর্তেছে জাতির ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে তৈরি করার মহা (!) দায়িত্ব। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ কেবল ‘যুবক’ শব্দের মধ্যে উদ্যম আর সক্ষমতাকে আটকে রেখে তার জানার সীমাবদ্ধতাকে আমাদের সামনে হাজির করেছেন। লেখক জানেন, ‘তরুণমনের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন আর বিশ্বাস নবজাত বলেই সুন্দর ও পবিত্র।’ এই রকম সীমিত জ্ঞান দিয়ে যে সত্যিসত্যিই সত্যকে অনুধাবন করা যায় না, সে কথাও বোধকরি লেখক আমাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। আর তাই হয়তো যুবক শিক্ষক আত্মপ্রত্যয়ী হতে পারেনি; সঞ্চয় করতে পারেনি কাঙিক্ষত সাহসের সমাচারও। আশ্রয়দাতা (চাকরিদাত্রও বটে) দাদাসাহেবের বাড়ির প্রতিনিধি ‘দরবেশ’ কাদেরের অপকর্মে কথাও সে বলতে পারে না ওই সামান্য জ্ঞানের অসামান্য সীমাবদ্ধতার কারণে! মাদ্রাসা-পড়–য়া বাইশ-তেইশ বছরের যুবক আরেফ আলী মুখের শীর্ণতা আর চোয়ালের অনুজ্জ্বল আভায় যৌবনের ভার ধরে রাখতে পারেনি; শিক্ষকতা করে বলে এক ধরনের আরোপিত উদ্ধতভাব ও মেকি দম্ভ তার মধ্যে আছে বটে! যুবক শিক্ষক কুয়াশাঘেরা অন্ধকার রাতে প্রায় দৌড়তে থাকা কাদেরের পিছু নিয়েছিল। কিন্তুÑ

একটু পরে চৌমাথার মতো স্থানে এসে সে হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে পড়ে। কোন দিকে যাবে?… ভাবে, লোকটা যে কাদের সে-কথা সঠিকভাবে সে বলতে পারে না, চোখের ভুল হয়ে থাকতে পারে। তাকে মুখামুখি দেখে নাই, কেবল তার পেছনটাই দেখেছে।…কিন্তু যুবক শিক্ষক ফিরে যায় না। কাদেরকে সে সামনাসামনি দেখে নাই বটে কিন্তু তার হাঁটার বিশেষ ভঙ্গি, ঘাড়ের কেমন উঁচু-নিচু ভাব, মাথার গঠন ইত্যাদি দেখেছে। ভুল অবশ্য হতে পারে, কিন্তু আরেকটু দেখে গেলে ক্ষতি কী? মানুষটি অদৃশ্য হয়ে গেলে তার সম্বন্ধে কৌতুহলটা আরো বাড়ে যেন। কিন্তু কোন দিকে যাবে? চারটা পথের কোনটা ধরবে?

লোকটিকে চিনতে পারা-না-পারার সংশয় এবং চারটি পথের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা কিংকর্তব্যবিমূঢ় যুবক শিক্ষকের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার মধ্য দিয়ে গল্পনির্মাতা সম্ভবত আমাদের প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনের জটিলতা ও প্রতিকূলতাকে ইঙ্গিত করেছেন। অবলোকন, নির্ণয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই যে বিভ্রান্তি- এর ভেতর দিয়ে আমরা যেন আমাদেরই মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতার পাঠ গ্রহণ করি; আর দেখতে থাকি চারদিকে প্রবহমান সব কুটিলতা আর প্রতিবন্ধকতার ছবি। অনুমান ও সত্য যে এক নয়, কাজে স্থিরচিত্ত থাকা আর পিছিয়ে পড়ার মধ্যে যে নিশ্চিত দূরত্ব রয়েছে, করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারা আর না-পারার মাঝখানে যে নিশ্চিত-সরল প্রভেদ, তা বোঝাবার জন্য লেখক যুবক শিক্ষকের এই মানসিক বিভ্রান্তিকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন বোধকরি। এই চরিত্রটি আমাদের চারপাশে পরিচিত ভুবনে বিরাজমান হাজার-কোটি মানুষের প্রতিনিধি মাত্র। নিজের অবস্থানে থেকে নিজেকে আড়াল করার যে শামুকস্বভাব আমরা লালন করে চলেছি প্রতিদিন-প্রতিরাত, তারই সামান্য ও সফল রূপায়ন যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। অবশ্য আরেফ আলী সে রাতে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে পারতো। কিন্তু বাস্তবে সে পারেনি। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু এবং চলমান রেখা যেমন তাকে ব্যস্ত করে তুলেছিল, তেমনি খানিক অবসরে, মানসিক ক্লান্তির কালে, সে চাঁদের আলোয় মুগ্ধ হয়ে পড়েছিল। এই মুগ্ধতা হয়তো তার জন্য নতুন নয়- পুরনো। আর ‘চাঁদের আলো যাদুকরী, মোহিনী।’ কাজেই চাঁদের আলোর কাছে যুবক শিক্ষকের মন বাঁধা। আর ‘কাদের বড়বাড়ির মানুষ। যুবক শিক্ষক সে-বাড়িরই পরাপেক্ষী, তাদেরই আশ্রিত।’ অতএব কাদেরের কাছে, তার পরিবারের কাছে সর্বোপরি বড়বাড়ির প্রধান মুরব্বী দাদাসাহেবের কাছে যুবক শিক্ষক ‘জালে আটকে-পড়া প্রাণী’ যেন!

‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে প্রধান হয়ে উঠেছে সমাজ নয়, ব্যক্তিই অন্বিষ্ট। সমাজ ও ব্যক্তির প্রাসঙ্গিক পারিপার্শ্ব পরিবেশিত হয়েছে ব্যক্তির অবস্থা ও অবস্থানকে নির্দেশ করবার প্রয়োজনে। যুবক শিক্ষক আরেফ আলীকে কেন্দ্র করে যে আখ্যান সাজিয়েছেন লেখক, তার ভার হয়তো সমাজকেই শেষপর্যন্ত বহন করতে হয়, কিন্তু তিনি সমাজকে আশ্রয় করেননি। তবে সমাজ তাঁর আখ্যানে কোনোভাবেই উপেক্ষিত থাকেনি। যখন সমাজের যে পাতা তিনি প্রকাশ করেছেন, তখন তাকে উল্টে-পাল্টে পাঠককে দেখিয়েছেন দক্ষ যাদুকর বা পথের পাশে দাঁড়িয়ে হেঁকে-ডেকে পণ্য বিক্রেতার মতো। সাহিত্যের কিংবা শিল্পের পরিবেশনে এবং বিপণন-কৌশল সৃষ্টিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আগ্রহ বা প্রচেষ্টার কোনো ঘাটতি অন্তত চোখে পড়ে না।

‘পানিশমেন্ট অব ন্যাচার’ বলে একটা কথা আছে। তার ওপরে শেষপর্যন্ত ভরসা করে মাদ্রাসা-পড়–য়া যুবক শিক্ষক আরেফ আলী। যে খুনের ঘটনাটি ঘটেছে, তার প্রকৃত বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে কি-না, অপরাধী ধরা পড়বে, না-কি নিরপরাধ কাউকে শাস্তি দেওয়া হবে- এই নিয়ে তার মনে সংশয় দেখা দেয়। তবে প্রকৃতি ও সমাজকে অবলোকন করে, সময়ের পরিক্রমায় সে উপলব্ধি করেছে, প্রকৃতঅর্থে মানুষ মানুষকে সাহায্য করতে পারে না। তার জন্য দরকার পড়ে সৃষ্টিকর্তার সহযোগিতা ও আশ্রয়। মানুষের অজ্ঞতা, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা, দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা এবং ধর্মের ওপর নির্ভরতা প্রভৃতি বিষয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য। তিনি কোনো রাখঢাক না রেখে ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান, ধর্মবিশ্বাস এবং অপরগতা-অসহায়তা বিষয়ে নিবিড় বিবৃতি তৈরি করেছেন। তাঁর পাঠকদের জন্য এটি বিশেষ পাওয়া যে লেখকের অভিজ্ঞান, তাঁর সৃজনভাবনা ও প্রকাশের ভার এবং সংস্কৃতির আলোয় ব্যক্তির বেঁচে থাকার সদর দরোজার সন্ধান অন্তত তিনি আখ্যান-পরিসরে সুবিন্যস্তভাবে পরিবেশন করেছেন। যুবক শিক্ষকের মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রমের কালে তার স্বস্তি ও মুক্তিকে টার্গেট করে লেখক পবিত্র কোরআনের আশ্রয় নিয়েছেন। প্রসঙ্গত যুবক শিক্ষকের দুর্বল-ধর্মচেতনা সম্বন্ধে মত প্রকাশ করতেও দ্বিধা করেননি তিনি। নিজের মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণার অবসান এবং চোখে-দেখা অপরাধীর বিচার প্রার্থনায় কাতর আরেফ আলী কীভাবে সুরা আল্-খালাক ও সুরা লাহাবের প্রায়োগিকতার ওপর ভরসা করেছেন তাঁর বিবরণ-ভাষ্য নির্মাণ করেছেন ঔপন্যাসিক। তিনি লিখছেন:

বড়বাড়িতে আসার পূর্বে নিয়মিতভাবে নামাজ পড়ার অভ্যাস যুবক শিক্ষকের ছিল না। আজকাল অন্ততপক্ষে সকাল-সন্ধ্যায় নামাজটা পড়ে। তবু ঠিক মনঃপ্রাণ দিয়ে যে তা নয়। তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার না করলেও তা সে সম্পূর্ণভাবে বোঝে না। কিন্তু আজ সে হঠাৎ অত্যন্ত নিঃসঙ্গ এবং অসহায় বোধ করে বলে নামাজ পড়তে দাঁড়ালেই তার মন একটি তীব্র ভাবোচ্ছ্বাসে ভরে ওঠে। সে যেন আর তোতার মতো মুখস্থ-করা বুলি আবৃত্তি করে সারশূন্য কর্তব্য পালন করছে না: যাঁর সামনে সে দাঁড়িয়েছে তাঁর উপস্থিতি সে অন্তর দিয়ে অনুভব করছে, তার বক্তব্য তাঁর কর্ণগোচর হচ্ছে তাতেও তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকে না।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ দেখিয়েছেন কীভাবে একজন নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পায়। অপরাধীচক্রের দৌরাত্ম্য আর বিচার-প্রথার অনাধুনিকতা ও অগ্রহণযোগ্যতার এই যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, এমনটা বাংলাসাহিত্যে বিরল। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছেন এদেশে অপরাধীরা ক্ষমতা কিংবা টাকার জোরে পার পেয়ে যায়; আর মার খায় নিরীহ সাধারণ মানুষ- যাদের মামা-কাকার কিংবা টাকাকড়ির বাহাদুরি নেই। পাশাপাশি পুলিশ এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলাবাহিনির সদস্যরা যে নিজেদের রাষ্ট্রীয় ও মহান দায়িত্ব ভুলে গিয়ে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে অপরাধীর কাছ থেকে সুবিধা নেয়, তার চিত্র পরিবেশন করতেও লেখক পিছপা হননি। অবশ্য আইনের লোকেরা যে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিকে শায়েস্তা ও শাস্তি প্রদানে বাধ্য হয় (ওপরের নির্দেশে!- সৃষ্টিকর্তার নয়, রাষ্ট্রীয় উচ্চপদমর্যাদায় আসীন ব্যক্তির)- এমন ইঙ্গিতও গল্পটিতে পাওয়া যায়। ‘কর্তায় ইচ্ছায় কর্ম’ বলে যে কথাটির প্রচলন রয়েছে, তার পেছনে আছে প্রশাসকের, ক্ষমতাধরদের অবিচার-অন্যায়ের গোপনকাহিনি। ওয়ালীউল্লাহ্ এই বিষয়ে অত্যন্ত প্রখরদৃষ্টি মানুষ। প্রকৃতঅর্থে তিনি এই আখ্যানের ভেতরে প্রবেশ করা একটি বিচারিক ঘটনা উপস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক দুর্বলতাকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সত্যিকথা বলতে কি, আমরা বর্তমান বাংলাদেশে আইন ও বিচার বিভাগের যেসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দেখতে পাচ্ছি, তা কোনো নতুন ঘটনা নয়- দীর্ঘদিনের পথচলায় তা আজ পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্য-অনুসন্ধানি সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ আজ থেকে অর্ধশতাব্দীকাল আগে এই বিষয়ে তাঁর পরোক্ষভাবে গোটা সমাজকে সতর্ক করে গেছেন।

যুবক শিক্ষককে আমরা কেবল দেখেছি মনস্তাত্ত্বিক -সংকটে ভুগতেথাকা এক অনিকেত মানুষ হিশেবে। কিন্তু শিকড়বিহীন এই যুবকের মনের ভেতরে লুকিয়েথাকা স্বপ্নময়তার খুব একটা স্পর্শ আমাদের চেতনায় দোলা দেয় না। হয়তো তার যুবকত্ব কিংবা যুবকসুলভ বাসনা-কামনা, ক্ষোভ-হতাশা প্রভৃতির বিবেচনায় তাকে আমরা মানবিক কাঠগড়ায় দাঁড় করাইনি! কিন্তু দেখুন, লেখক বারবার আমাদের মনের চোখটিকে সজাগ করে তুলতে চেয়েছেন। যুবক শিক্ষকের চোখ ও মনের ঝলসেওঠা আগুন ও উত্তেজনার কিছুটা রেশ অন্তত পাঠকের সামনে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। ‘আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়।… পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো।’, ‘শাড়িটা অসংলগ্ন, পায়ের কাছে এক ঝলক চাঁদের আলো।’- এইসব বাক্যে প্রযুক্ত অনুভব দ্বারা লেখক কী বোঝাতে চাইছেন? যুবকের মনের ভেতরে, শরীরের গোপনস্তরে লুকিয়েথাকা জৈবিক কামনার কথা? যুবক শিক্ষক অবিবাহিত। সম্ভবত জীবনে কোনো নারীর (জৈবিক তাড়নায় প্রার্থিত) সাথে মানসিক কিংবা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করাটা হয়ে ওঠেনি! কিংবা কে জানে, কী রহস্য গোপন আছে যুবকের মনে? কে-ই বা এই যুবতী? যুবতীর সাথে তার পূর্ব-পরিচয় ছিল কি-না? তা থেকে থাকলে তার প্রতি কোনো আকর্ষণী দৃষ্টি কখনো প্রসারিত হয়েছিল কি-না? ‘যুবতী নারী’কে ঘিরে কি যুবক শিক্ষক ও কাদেরের মধ্যে কোনোরকম প্রতিযোগিতা ছিল (কে পাবে, কে পাবে না- ধরনের!)? ‘যুবতী নারী’ কি মৃত্যুর আগপর্যন্ত এসবের সবকিছু জানতো? এইসব ভাবনায় আমাদের ঘোরলাগাচোখে যেন খানিকটা তন্দ্রার জন্ম নেয়- লেখকের একটা বর্ণনা পাঠ করে। তিনি (আখ্যানের প্রায় শেষভাগে, বিচারের প্রায় দ্বারপ্রান্তে, যুবকের শাস্তি যখন প্রায় নিশ্চিত, তখন) জানাচ্ছেন:

কিন্তু কে শাস্তি পাবে? পুলিশ-কর্মচারীর সামনে বসে যুবক শিক্ষকের হয়তো এই ধারণা হয় যে, কে শাস্তি পাবে সেটি আর প্রধান কথা নয়। শাস্তিটার অর্থ যখন মৃত যুবতী নারীর কাছে আর পৌঁছবে না, তখন কে শাস্তি পাবে তাতে তার আর কী এসে যাবে? শাস্তিটা তার জন্যে নয়। যুবক শিক্ষক যদি ভুল করে শাস্তিটা নিজের ওপরই টেনে আনে, যুবতী নারীর মৃত্যুর জন্যে সে-ই যদি অবশেষে শাস্তি পায়, তবে শাস্তিটা আসলে যার উদ্দেশ্যে সেখানে তা পৌঁছুবে না। সে-কথায় সে কি একবার সান্ত্বনা পেতে পারে না?

‘চাঁদের অমাবস্যা’ নামক আখ্যানটিতে মানুষ, তার চারপাশের সমাজ, চলমান স্বাভাবিক-অস্বাভাবিক জীবনধারা, ব্যক্তির ব্যক্তিতা প্রভৃতির ধারণার প্রয়োগ আছে। আছে সত্য-অন্বেষার প্রচেষ্টা এবং মিথ্যার প্রতিষ্ঠা (বিচারের নামে প্রহসনের মধ্য দিয়ে)। ‘ব্যক্তিত্ব’ এবং ‘ মনস্তাত্ত্বিক্ব’- এই ধারণাগুলো যুবক শিক্ষকের অনুভবের ভেতর দিয়ে পাঠককে জানান দিতে চেষ্টা করেছেন লেখক। ‘কাদেরের পায়ের তলে সে যেন ঘৃণ্য বস্তু, শিরদাঁড়াহীন নপুংশক কীটপতঙ্গ কিছু।’- অর্থাৎ ব্যক্তিত্বহীন, মেরুদণ্ডহীন এক প্রাণী যুবক শিক্ষক আরেফ আলী! মনে রাখতে হবে, মেরুদণ্ড (সমাজ-সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানের বারান্দায়) বলতে দেহের পশ্চাৎভাগে কতগুলো হাড়ের সমষ্টিকে বোঝায় না- এটি একটি কনসেপ্ট বা ধারণাজ্ঞাপক শব্দ। মেরুদণ্ডহীন প্রাণী (রক্ত-মাংসের মানুষ বলে কথা!) যুবক শিক্ষক আরেফ আলী কি মানসিক বিভ্রমে ভোগেনি? শেষত তার সকল সম্ভাবনা, প্রতিবাদের কণ্ঠ, স্বপ্ন প্রভৃতি পরাজিত হয় সামাজিক বিপন্নতা, আর্থিক নির্ভরতা ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার অনৈতিকতার দাপটের কাছে। অন্ধকারের কাছে হেরে যায় সমূহ আলো। চাঁদ যেন ঢেকে যায় অমাবস্যার আড়ালে। টিকে থাকার লড়াইয়ে পেছনে পড়ে যায় সত্যনিষ্ঠ জনতা। অসহায় মানুষ ডুবতে থাকে অপমান আর যন্ত্রণার অতলে!

সার-সংক্ষেপ

‘চাঁদের অমাবস্যা’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অন্যতম একটি উপন্যাস। উপন্যাসের মধ্যে মনস্তাত্ত্বি¡-সংকটের লড়াই আছে যেমন, তেমনি মনস্তাত্ত্বিক জগতের বাস্তব অবাস্তবের বর্ননা ।
উপন্যাসে পূর্ব বাংলার অবরুদ্ধ শৃঙ্খলিত সমাজের ভেতরগত গূঢ় চিত্র অঙ্কন করেছেন স্বৈরাচার পিষ্ট সমাজের মানুষের মনোবৈকলিক সংকটের চেহারা উন্মোচন করেছেন । উপন্যাসের নায়ক অতিশয় দরিদ্র, তাই উচ্চশিক্ষার অভিলাষ পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি; তাই গ্রামের জোতদার বড় দরবেশ সাহেব এর সদ্য প্রতিষ্ঠিত হাইস্কুলে সে চাকরি নিয়ে তার বাড়িতেই লজিং মাস্টার হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে ।

এক গভীর পূর্ণিমা রাতে যুবক মাস্টার বাঁশবনে দেখতে পায় এক বীভৎস দৃশ্য : ‘শীতের উজ্জ্বল জ্যোতস্না রাত, তখনো কুয়াশা নামে নাই, বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়, সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। পায়ের ওপর একঝলক চাঁদের আলো”

এই পাশবিক দৃশ্য দেখে তার মত যুবক শিক্ষকের অস্তিত্বের মধ্যে প্রলয়কাণ্ড শুরু হয়ে যায়। সে হতভম্ভ, বিভ্রান্ত, বিমূঢ় ও বিপণন দশায় উপনীত হয়। তার মনস্তাত্ত্বিক সংকট দেখা দেয়। খুনী সেই দরিদ্র স্কুল মাস্টারের আশ্রয় দাতা পরিবারেরই একজন। কাজেই বিষয়টা চেপে যায় সে। তাই যুবক শিক্ষক পরবর্তীতে মনস্তাত্ত্বিক সংকটে ভুগতে থাকে। একদিকে সত্য প্রকাশ করতে না পারার বেদনা অন্যদিকে তার আশ্রয় এবং শিক্ষাকতার পেশাটা হারানোর ভয়।

সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ অসাধারণ দক্ষতায় এই স্বল্প পরিসরে গড়ে ওঠা প্লটের উপরই একধরনের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের আলো-ছায়ার খেলা খেলেছেন। ঘটনার প্রেক্ষিতে একজন লোকের মনস্তাত্ত্বিক অবহ থেকে বাস্তবে ফিরে আসা অতঃপর আবার মনস্তাত্ত্বিক জগতে ফিরে যাওয়ার যে বর্ননা বাস্তব অবাস্তবের জলছাপে সুন্দর করে তুলে ধরেছেন।

তথ্যসূত্র:

১. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্্ ও নিঃসঙ্গ নায়ক’
সমকালীন বাংলা সাহিত্য, এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা।
২. রশীদ করীম, ‘সমসাময়িকের চোখে: ‘লালাসালু’, আর এক দৃষ্টিকোণ
বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
৩. ‘ওয়ালীউল্লাহর : ভাষারীতি’ প্রবন্ধ
সম্পাদক. মমতাজউদ্দীন আহমদ, ঢাকা
৪. আলী আনোয়ার, ‘বাংলাদেশের উপন্যাস: থীম ও ফর্ম’
সমকালীন বাংলা সাহিত্য।
৫. শিবনারায়ণ রায়, ‘ঔপন্যাসিকের বিবেক: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্্’
প্রতিক্ষণ, কলকাতা।
৬. আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, ঢাকা, ২০০১ ।
৭. সৈয়দ আবুল মকসুদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ” জীবন ও সাহিত্য
ঢাকা, ১৯৮১।
৮. সৌদা আখতার, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্-র চাঁদের অমাবস্যা’
সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তেত্রিশ বর্ষ প্রথমসংখ্যা কার্তিক ১৯৩৬।
৯. রুশতী সেন, ‘কান্না মরণের তৃষ্ণা জীবনের, পরিকথা
সম্পাদক. দেবব্রত চট্টোপাধ্যায়, চতুর্থ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা মে, ২০০২, পশ্চিমবঙ্গ।
১০. সৈয়দ শামসুল হক, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্: একটি শ্রদ্ধা নিবেদন’
সমকালীন বাংলা সাহিত্য।

 

 

About সালেক শিবলু

View all posts by সালেক শিবলু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *