কাব্যধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের সার্থকতা আলোচনা কর।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত কপালকুণ্ডলা উপন্যাস বাংলা কথা সাহিত্যের প্রথম সার্থক কাব্যধর্মী উপন্যাস। উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে কাব্যের বৈশিষ্ট্য পল্লবিত করে বঙ্কিমচন্দ্র কপালকুণ্ডলা উপন্যাসটিকে একটি সার্থক শিল্পপ্রতিমা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। কাপালিক কতৃক পালিতা অরণ্যাচারী কপালকুণ্ডলার জীবনকে রোমান্সরসে সিক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে এ উপন্যাসে। নিচে কাব্যধর্মী উপন্যাস হিসেবে কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের সার্থকতা আলোচনা করা হলো –
শিল্পসাহিত্যের একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও রূপের নাম হলো কাব্যসাহিত্য। কাব্যসাহিত্যের প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো কল্পনা শক্তির উপর অগাধ বিশ্বাস। বস্তুজগতের বাইরে যে অলৌকিক জগত তাকে খুঁজে বের করতে পারে একমাত্র কল্পনা শক্তি। কল্পনার মাধ্যমে অলৌকিকতার রহস্য উদঘাটনই কাব্যের আসল রহস্য। রোমান্টিকশিল্পী তার চোখের বাইরে কিছু খোঁজেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কল্পনার নবদিগন্ত উন্মোচন করে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশ ও জীবনকে কেন্দ্র করে নিসর্গ সৌন্দর্যের অবতারণার ভিতর দিয়ে কাহিনি নির্মাণ করেছেন। এই নিসর্গ সৌন্দর্য বা বিশ্বপ্রকৃতির বিরাট, আকর্ষনীয়, রহস্যময় স্বরূপের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এ উপন্যাসে লেখক কাব্যিক আবহকে অবলম্বন করেছেন।
কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে সমুদ্র, উপকূলবর্তী অরণ্য, খরস্রােতা নদীর ঢেউয়ে ভেঙ্গে পড়া তটভূমি যেমন আছে, তেমনই আছে সাধক কাপালিক, নির্জনে লালিতা যুবতী-সব বাহ্যিক দিক থেকে এগুলো সবই কাব্যিক আবহ সৃষ্টি করে। উপন্যাসের সমস্ত রোমান্টিকতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে অরণ্যচারী ও সমাজবিচ্ছিন্ন নারী কপালকুণ্ডলা। নায়িকা কপালকুণ্ডলা স্বামী সংসারের প্রতি কোন আকর্ষন অনুভব করে নি। বরং অরণ্যের প্রতি গভীর আকর্ষন তাকে সব সময় তাড়িয়ে ফিরছে।
কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের ঘটনাবর্ত কাব্যিক আমেজে মিশ্রিত। এর কাহিনি, প্রকৃতি, রূপ বর্ণনা, নায়ক-নায়িকার মিলন, প্রতি নায়িকার আবির্ভাব, পরষ্পর পরষ্পরের কথোপকথনে কাব্যময়তার জন্ম দিয়েছে। উপন্যাসের কাহিনিতে আমরা লক্ষ করি নবকুমারের স্ত্রী পদ্মাবতীর ধর্মান্তর ও নবকুমারকে পরিত্যাগ, নবকুমারের তীর্থযাত্রা, পথ হারানো, কাপালিকের নজরে পড়া, কপালকুণ্ডলাকে বিবাহ করে মুক্তি লাভ, দেশে ফেরার সময় প্রথমা স্ত্রীর দর্শন, কপালকুণ্ডলাকে সন্দেহ, পত্র পাওয়া, ব্রাহ্মণ যুবকধারী পদ্মাবতী, কপালকুণ্ডলার ঔষধি বৃক্ষ খোঁজা, শেষ পর্যন্ত নবকুমার ও কপালকুণ্ডলার সলিল সমাধি সবই কাব্যিক।
কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের রোমান্টিকতা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে রুপায়িত হয়েছে। কপালকুণ্ডলার ভাবজগত ও মুক্তস্বাধীন চিত্তে প্রকৃতি মায়াবি প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর বিরহ-মিলন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আচার-আচরণ, তান্ত্রিক সাধনা, সব কিছুর মধ্যেই প্রকৃতি রোমান্টিকতার বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। উপন্যাসে অলৌকিকতা ও অতিপ্রাকৃত আবহ এসেছে রোমান্টিকতার বাহন হিসেবে। কপালকুণ্ডলার পরিণতির মধ্যে রোমান্টিকতার বিশেষ দিক উন্মোচিত। তার পরিণতির জন্য আশৈশব অরণ্যপ্রীতি, কাপালিকের ধর্মবিশ্বাস, মতিবিবির ঈর্ষা, নবকুমারের রূপতৃষ্ণা, প্রভৃতি কারণ থাকলেও নিয়তিবাদই এখানে তার পরিণতিকে অনিবার্য করে তুলেছে। এতে রোমান্টিক রস স্ফূতি লাভ করেছে। উপন্যাসে কপালকুণ্ডলা, নবকুমার, মতিবিবি সব চরিত্রের উপরই রোমান্টিকতার ছাপ পড়েছে। মানবমনের গহীন প্রদেশে নেমে ঔপন্যাসিক তার রহস্যের সন্ধ্যান করেছেন। অরণ্যচারী নারীকে তিনি সংসারে এনে মানব রহস্যের বৈচিত্র্য অনুসন্ধান করেছেন কল্পনার রঙিন ফানুস পড়ে।
উপর্যুক্ত আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে বলা যায় যে, কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে কাব্যিক আবহ পল্লবিত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের দক্ষ ও শিল্পকুশলী হাতে। উপন্যাসের কাহিনি, ভাষা, চরিত্র, এবং পটভূমি- সব কিছুর মধ্যেই কাব্যিক স্ফূরণ ঘটেছে। কাব্যের মূল বৈশিষ্ট্য যে প্রকৃতি ও প্রেমরহস্যে ঘেরা মানবজীবন, তা উপন্যাসে সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, কাব্যিক উপন্যাস হিসেবে কপালকুণ্ডলা’ সার্থক ও সফল হয়েছে।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর