রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে কপালকুণ্ডলা এর সার্থকতা আলোচনা কর । 211003

রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে ‘কপালকুণ্ডলা’র সার্থকতা আলোচনা কর ।

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত কপালকুণ্ডলা উপন্যাস বাংলা কথা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্টিক উপন্যাস। উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে রোমান্টিকতার বৈশিষ্ট্য প্রথিত, পল−বিত করে বঙ্কিমচন্দ্র ‘কপালকুণ্ডলা’কে একটি সার্থক শিল্পপ্রতিমা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। কাপালিক কতৃক পালিতা অরণ্যাচারী কপালকুণ্ডলার জীবনকে রোমান্সরসে সিক্ত করে উপস্থাপন করা হয়েছে এ উপন্যাসে। নিন্মে  বিষয়টি উপস্থাপনা করা হলো-

শিল্পসাহিত্যের একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও রূপের নাম হলো রোমান্টিকতা। রোমান্টিকতার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো কল্পনা শক্তির উপর অগাধ বিশ্বাস। বস্তুজগতের বাইরে যে অলৌকিক জগত তাকে খুঁজে বের করতে পারে একমাত্র কলল্পনা শক্তি। কল্পনার মাধ্যমে অলৌকিকতার রহস্য উদঘাটনই রোমান্টিকতার আসল রহস্য। রোমান্টিকশিল্পী তার চোখের বাইরে কিছু খোঁজেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে। ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কল্পনার নবদিগন্ত উন্মোচন করে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিবেশ ও জীবনকে কেন্দ্র করে নিসর্গ সৌন্দর্যের অবতারণার ভিতর দিয়ে কাহিনি নির্মাণ করেছেন। এই নিসর্গ সৌন্দর্য বা বিশ্বপ্রকৃতির বিরাট, আকর্ষনীয়, রহস্যময় স্বরূপের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এ উপন্যাসে লেখক রোমান্টিকতাকে অবলম্বন করেছেন, তাকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করেন নি। বরং শান্ত জীবনের উপর কল্পনার আলোকপাত করে এক অসাধারণ ভাববলয় গড়ে তুলেছেন।

কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে সমুদ্র, উপকূলবর্তী অরণ্য, খর¯্রােতা নদীর ঢেউয়ে ভেঙ্গে পড়া তটভূমি যেমন আছে, তেমনই আছে সাধক কাপালিক, নির্জনে লালিতা যুবতীÑ সব বাহ্যিক দিক থেকে এগুলো সবই রোমান্টিক আবহ সৃষ্টি করে। তবে সমুদ্র তীরের অপার মহিমা, কাপালিকের নির্মম সাধনা কেবল বাহ্যিক বৈচিত্রে সমৃদ্ধ নয়, এগুলো কপালকুণ্ডলার চরিত্রের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। উপন্যাসের সম¯ত রোমান্টিকতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে অরণ্যচারী ও সমাজবিচ্ছিন্ন নারী কপালকুণ্ডলা। নায়িকা কপালকুণ্ডলা স্বামী সংসারের প্রতি কোন আকর্ষন অনুভব করে নি। বরং অরণ্যের প্রতি গভীর আকর্ষন তাকে সব সময় তাড়িয়ে ফিরছে। তাছাড়া কাপালিক দীক্ষিত ধর্মবিশ্বাসকে সে সমগ্রতায় লালন করেছে।

‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের ঘটনাবর্ত রোমান্টিক আমেজে মিশ্রিত। এর কাহিনি, প্রকৃতি, রূপ বর্ণনা, নায়ক-নায়িকার মিলন, প্রতি নায়িকার আবির্ভাব, পরষ্পর পরষ্পরের কথোপকথনে কাব্যময়তা, সবই রোমান্টিকতার জন্ম দিয়েছে। তাছাড়া চরিত্র ও কাহিনির আলোক-আঁধারি পরিবেশ উপন্যাসে রোমান্টিক আবেদন ঘনীভূত করেছে। উপন্যাসের কাহিনিতে আমরা লক্ষ করি নবকুমারের স্ত্রী পদ্মাবতীর ধর্মান্তর ও নবকুমারকে পরিত্যাগ, নবকুমারের তীর্থযাত্রা, পথ হারানো, কাপালিকের নজরে পড়া, কপালকুণ্ডলাকে বিবাহ করে মুক্তি লাভ, দেশে ফেরার সময় প্রথমা স্ত্রীর দর্শন, কপালকুণ্ডলাকে সন্দেহ, পত্র পাওয়া, ব্রাহ্মণ যুবকধারী পদ্মাবতী, কপালকুণ্ডলার ঔষধি খোঁজা, শেষ পর্যন্ত নবকুমার ও কপালকুণ্ডলার সলিল সমাধি সবই রোমান্টিক।

কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের রোমান্টিকতা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে রুপায়িত হয়েছে। কপালকুণ্ডলার ভাবজগত ও মুক্তস্বাধীন চিত্তে প্রকৃতি মায়াবি প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর বিরহ-মিলন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, আচার-আচরণ, তান্ত্রিক সাধনা, সব কিছুর মধ্যেই প্রকৃতি রোমান্টিকতার বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। উপন্যাসে অলৌকিকতা ও অতিপ্রাকৃত আবহ এসেছে রোমান্টিকতার বাহন হিসেবে। নকুমারের সাথে বিবাহের মুহূর্তে ভবিষ্যৎ শুভাশুভ জানবার জন্য দেবীর পায়ে বিল্বপত্র প্রদর্শন করা হয়। এতে কেবল পুজার বাহ্য অনুষ্ঠানের পরিচয়ই পাওয়া যায় না, বরং তার মধ্য দিয়ে কপালকুণ্ডলার ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ে একটি অজ্ঞাত আশঙ্কার ছায়া পড়ে, যা তার নতুন জীবনের প্রতি অনাসক্তি বাড়িয়ে তুলেছে। কাপালিক কপালকুণ্ডলাকে দেবীর পায়ে বলি দেবার যে স্বপ্ন দেখেছে, কপালকুণ্ডলাও একই স্বপ্ন দেখেছে। শেষ পর্যন্ত এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের যে প্রয়াস তা সবই রোমান্টিকতার বিশেষ উপকরণ। কপালকুণ্ডলার পরিণতির মধ্যে রোমান্টিকতার বিশেষ দিক উন্মোচিত। তার পরিণতির জন্য আশৈশব অরণ্যপ্রীতি, কাপালিকের ধর্মবিশ্বাস, মতিবিবির ঈর্ষা, নবকুমারের রূপতৃষ্ণা, প্রভৃতি কারণ থাকলেও নিয়তিবাদই এখানে তার পরিণতিকে অনিবার্য করে তুলেছে। এতে রোমান্টিক রস স্ফূতি লাভ করেছে। উপন্যাসে কপালকুণ্ডলা, নবকুমার, মতিবিবি সব চরিত্রের উপরই রোমান্টিকতার ছাপ পড়েছে। মানবমনের গহীন প্রদেশে নেমে ঔপন্যাসিক তার রহস্যের সন্ধ্যান করেছেন। অরণ্যচারী নারীকে তিনি সংসারে এনে মানব রহস্যের বৈচিত্র্য অনুসন্ধান করেছেন কল্পনার রঙিন ফানুস পড়ে।

উপর্যুক্ত আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে বলা যায় যে, ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে রোমান্টিকতা পল−বিত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের দক্ষ ও শিল্পকুশলী হাতে। উপন্যাসের কাহিনি, ভাষা, চরিত্র, এবং পটভূমিÑ সব কিছুর মধ্যেই রোমান্টিকতার স্ফূরণ ঘটেছে। রোমান্টিকতার মূল বৈশিষ্ট্য যে প্রকৃতি ও প্রেমরহস্যে ঘেরা মানবজীবন, তা উপন্যাসে সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে। সুতরাং ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে রোমান্টিকতার আবেষ্টন রচনায় বঙ্কিম যে অদ্ভুত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাই রোমান্টিক উপন্যাস হিসেবে ‘কপালকুণ্ডলা’ সার্থক ও সফল হয়েছে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

* এই প্রশ্নটি অন্য ভাবেও আসতে পারে যেমন – (কাব্যধর্মী উপন্যাস হিসেবে/উপন্যাস হিসেবে/রোমান্টিক আবহ পল্লবিত)

Scroll to Top