সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে অস্তিত্ববাদ কী ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে আলোচনা করো।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) বাংলাদেশের সাহিত্যে মানবীয় উজ্জ্বল অভীপ্সায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে জটিল জীবনচেতনা অভিনব প্রকরণ উপন্যাসে আমদানি করেছিলেন। মাত্র ৩টি উপন্যাস, ২টি নাটক এবং কয়েকটি ছোটগল্প রচনা করেই বাংলা সাহিত্যের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘লালসালু’তে ধর্মীয় গোঁড়ামির মর্মমূলে আঘাত করেছেন। পরবর্তীতে রচিত ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) উপন্যাসে সামাজিক বাস্তবতায় ব্যক্তির অস্তিত্ব সংকট কিভাবে প্রকট হয়ে ওঠে- তা যেমন দেখিয়েছেন ।
‘চাঁদের অমাবস্যা’ এবং ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের কাহিনীবৃত্তে ওয়ালীউল্লাহ অস্তিত্ববাদী দর্শনের ভেতর দিয়ে ব্যক্তি-মানুষকে চিত্রিত করেছেন। মানুষের উৎস শূন্যতা ও কাদামাটির ভেতর থেকে। ব্যক্তি ইচ্ছা করলে ভেতরের নিষ্ক্রিয় ঔদাসীন্যে নিশ্চিন্তে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে, আবার সেটা নাও করতে পারে। ব্যক্তি-মানুষ চাইলে নঞর্থক বৃত্তের বাইরে এসে স্বীয় অস্তিত্ব সম্পর্কে ক্রমাগত সচেতন হয়ে উঠতে পারে কিংবা সদর্থক অস্তিত্বের বিপরীতে নাৎসীবাদী হিটলারে পরিণত হতে পারে। অস্তিবাদীরা মনে করেন- ব্যক্তির মানসচৈতন্যে বা অন্তরে যা সত্য বলে প্রতিভাত হয়, তার দায় অবশ্যই ব্যক্তিমানুষকে বহন করতে হয়। এজন্যই ‘চাঁদের অমাবস্যা’র মাস্টার আরেফ আলী শেষ পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন করেও একটি হত্যাকা-ের বিচার প্রার্থনা করেছে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ‘লালসালু’ উপন্যাসে সমাজজীবনের গভীরতর সমস্যা ও সংকটের শেকড় তথা মূল অসঙ্গতি চিত্রিত করেছেন। মানবচৈতন্যকে শিল্পায়তনে দৃশ্যমান করে তুলতে ঔপন্যাসিক বাহ্যজগতে সর্বজ্ঞ দৃষ্টি দিয়েছেন। অস্তিত্ব সংহারক ও বিকৃত আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় ব্যক্তিঅস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার নঞর্থক অতিক্রমণের অগ্নিপথ নির্দেশ করেছেন। ‘লালসালু’তে ব্যক্তিঅস্তিত্বের সার্থক ব্যবহার নেই সত্য তবে এতে মজিদের সংকটাপন্ন অস্তিত্বের কথাও অস্বীকার করা যায় না। কারণ, মজিদ অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই মিথ্যে মাজার পুঁজি করে মহব্বতনগরে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। মজিদের অস্তিত্ব রক্ষায় এটি তার স্বেচ্ছাকৃত অপরাধ। এ অপরাধের আত্মযন্ত্রণা থেকে সে মুক্তিও খুঁজে নেয় এই ভেবে যে (মহান আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন।)
‘লালসালু’র বাহ্যবাস্তবতা ‘চাঁদের অমাবস্যা’য় ক্রমশ ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতা সংকটাপন্ন হয়েছে। উপন্যাসের মাস্টার আরেফ অস্তিত্বশীল হয়ে উঠতে প্রান্তিক পরিস্থিতির তীব্র আঘাতে যন্ত্রণাকাতর। মানসচৈতন্যে রক্তাক্ত হয়ে সত্যানুসন্ধানে আত্মঘাতী; মানসজটিলতা বিশ্লেষণে ক্রমসংকুচিত। উপন্যাসের বাইরের ঘটনার সাথে ব্যক্তিহৃদয়ের এই রক্তক্ষরণের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ নয়। ঔপন্যাসিক মূলত গল্পে ব্যক্তির চেতন ও অবচেতন মানস বিশ্লেষণে অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। একটি হত্যাকা-ের বিচার দাবি করতে গিয়ে মাস্টার আরেফের জীবন-জীবিকার পথ অনিশ্চিত হয়ে যাবে জেনেও তার থানায় রিপোর্ট করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রবল ধ্বনিত হয়েছে।
‘কাঁদো নদী কঁদো’ উপন্যাসের অন্তর্বয়নে বিষয়ানুষঙ্গ জটিল ও সূক্ষ্ম। তবারক ভূইঞার স্মৃতিময় পাতায় কুমুর ভাঙ্গার আতঙ্কগ্রস্ত বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর বিপন্ন অস্তিত্ব ও শঙ্কামুক্তির শব্দরূপ ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। তবে ঔপন্যাসিকের অভিজ্ঞতালব্ধ উদ্ভাসিত চেতনাপ্রবাহে মুস্তফার মনস্তাপ ও অস্তিত্ব বিষয়ক সংকট মুখ্য হয়ে উঠেছে। এ উপন্যাসের মুস্তফা চরিত্রে অস্তিত্ববাদী দর্শনের পরিপূর্ণ প্রভাব সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। মুস্তফা সাধারণ ও নির্বিবাদী নিষ্ক্রিয়। তার নিষ্ক্রিয়তার ভেতরেও ঔপন্যাসিক সচেতন মানসিক উপস্থিতি দেখিয়েছেন। এজন্যই খোদেজার মৃত্যু সম্বন্ধে বাড়ির অন্যদের মতামত সে বিশ্বাস না করলেও বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়; কিন্তু ক্রমাগত খোদেজার মৃত্যুচিন্তা তাকে গভীর দায়িত্ববোধের সঙ্গে যুক্ত করে ফেলে। পিতাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তার দায়িত্ব মনে করলেও তা অস্বীকার করে মুস্তফা বিয়ে করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়ে ভাবতে বাধ্য হয় এবং আবিষ্কার করে তার কর্তব্যহীনতাই মূলত খোদেজার মৃত্যুর কারণ। দায়িত্ববোধ ও কর্মসচেতন মুস্তফা অসাবধানবশত করা অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে আত্মহত্যার মধ্যেই আত্মমুক্তি পথ লাভ করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাস তিনটির আপাত অর্থে কোনো সংলগ্নতা সাযুজ্য কিংবা সাদৃশ্য দৃশ্যমান না হলেও গভীর অর্থে এদের সম্পর্ক আছে বলেই প্রতীয়মান হয়। কারণ, এ তিনটি উপন্যাসেই অস্তিত্ববাদী দর্শনচেতনার প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়। ‘লালসালু’তে ধর্মব্যবসায়ী মজিদের আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রাবল্য, জমিলার আত্মমুক্তির দ্রোহে অস্তিত্ববাদ প্রকটিত। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র পরের অন্নে প্রতিপালিত সহায় সম্বলহীন যুবক মাস্টার আরেফের মানবিক বোধের দায় প্রতিপালকের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে অস্তিত্বশীল হয়ে উঠেছে। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র মাস্টার আরেফের অস্তিত্ব উপলব্ধিতে নিয়তিবাদের ভূমিকাও দেখাতে পাওয়া যায়। গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের ইডিপাস অস্তিত্বসংকটের মুখোমুখি হয়ে স্বীয় জীবনেতিহাস জানার ব্যাপারে সব শক্তি নিয়োগ করে। অতঃপর ভয়াবহ নিয়তির মুখোমুখি পরাজয় বরণ করে। আরেফের পরাজয় নিজের ব্যক্তিগত হলেও সামগ্রিক মানবজাতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই দেখা যায়, মাস্টার আরেফের আত্মানুসন্ধান প্রক্রিয়া তাকে প্রতিপালক অন্ন দাতার বিরুদ্ধে ন্যায়ানুগ অবস্থান নিয়েছে।
মাস্টার আরেফের ভূমিকায় খুব সহজেই আমাদের মনে আসে, রাজা ইডিপাসও একই মানবিক কর্তব্যবোধ তাড়িত হয়েই নিজের জীবনেতিহাসের সন্ধান করেছিল। মাস্টার আরেফ আলীর পরাজয়ও অনেকাংশেই ইডিপাসের মতোই। কারণ, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও কর্তব্যকর্ম থেকে পিছপা হয়নি সে। আধুনিক মানুষ মাস্টার আরেফ জানত: ‘বিরূপ বিশ্বে মানুষ/নিয়ত একাকী।’ এজন্য মাস্টার আরেফ আলী স্বীয় মনুষ্যত্ব কিংবা মানবিক বোধকে অস্বীকার করতে পারেনি; অতঃপর সে থানায় গিয়ে দারোগার কাছে হত্যাকা-ের বিচারের প্রার্থনা করেছে। আরেফের এই বিচার প্রার্থনার মধ্য দিয়ে সে জীবন-জীবিকার সংকট ঘনীভূত করেছে, তারপরও মানবিক আদর্শকে অস্বীকার না করে, প্রবল অস্তিত্ব ঘোষণা করেছে।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা, পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বাংলা উপন্যাসে অস্তিত্ববাদী দর্শন ও চেতনাপ্রবাহরীতি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি মন ও হৃদয় দিয়ে যা সত্য বলে অনুভব করেন, তাই উপন্যাসে তুলে আনেন। হতে পারে তা রাজনৈতিক দর্শন, বা সামাজিক কোন অনুষঙ্গ। মানবসত্যকে তিনি কথাসাহিত্যে অমর করে রাখতে চেয়েছেন।