আবুল হাসান এর কবিতার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

আবুল হাসান
আবুল হাসান এর কবিতার স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর।

অথবা, কাব্যবৈশিষ্ট্য/স্বদেশভাবনা/স্বদেশপ্রেম/মুক্তিযুদ্ধ/ভাষা আন্দোলন/কাব্যভাবনা/যন্ত্রণাদগ্ধ কবি/আধুনিক কাব্যধারায় অবদান।

আবুল হাসান (১৯৪৭-১৯৭৫) ষাটের দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবিব্যক্তিত্ব ও শিল্প¯্রষ্টা। পেশাগত দিক থেকে বেশ কিছু সময় সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যও চর্চা করতেন। তবে তাঁর সাহিত্য চর্চাকালীন সময় দীর্ঘ নয়। ‘রাজা যায় রাজা আসে’ (১৯৭২) কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতার জগতে তাঁর অভিষেক ঘটে। তাঁর কাব্যচর্চার সময় সংক্ষিপ্ত, মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। রচনার পরিমাণ সীমিত হলেও শৈল্পিক মানদ-ে ও উপস্থাপনাশৈলিতে তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো স্বতন্ত্র মাত্রা লাভ করেছে। গ্রামীণ ও শহুরে অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে তাঁর কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে। তিনি কবিতায় নাগরিক যন্ত্রণাকে তুলে ধরেন, আবার সেইসাথে গ্রামীণ প্রশান্তির স্মৃতিচারণও করেন। তাঁর কবিতায় আধুনিক সমাজের, আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ, নৈঃসঙ্গচেতনা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপনাশৈলিতে তিনি আধুনিক এবং সেই সঙ্গে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। আবুল হাসানের কবিতার প্রকৃতি ও প্রবণতা নি¤েœ বিশ্লেষণ করা হলো-

আবুল হাসান ষাটের দশকের কবি। তাঁর জীবনকাল স্বল্প, মাত্র ২৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, ১০ বছর কাব্যসাধনা করেছেন, রচনা করেছেন তিনটি কাব্যগ্রন্থ। এ গুলো হলো ‘রাজা যায় রাজা আসে’ (১৯৭২), ‘যে তুমি হরণ করো’ (১৯৭৪), ও ‘পৃথক পালঙ্ক’ (১৯৭৫)। রচনাসম্ভার সীমিত হলেও কাব্যগ্রন্থগুলো শিল্পমানে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং তিনি বাংলা কাব্যাঙ্গনে একটি স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। তাঁর প্রায় সব রচনাকর্মে কোন না কোন ভাবে ব্যক্তিজীবনের প্রভাব পড়েছে। কবি আবুল হাসান সম্পর্কে প্রাবন্ধিক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলছেন : শৈশবজীবন, শৈশবস্মৃতি ও তাঁর পারিপাার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রকৃতি তাঁর জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে ওতোপ্রতভাবে। তাঁর শৈশবস্মৃতিতে মিছিলের মতো ভেসে আসে ফাতিমা ফুফুর কোরান তেলাওয়াত, বর্নির বাওরে বিকালের ভ্রমণ, দুলাভাইয়ের পাখি শিকার, মহকুমা শহরের যাত্রাগান, এভাবে আরও কত কী। জন্মস্থান বর্নিগ্রাম ও এর পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি ও পরিবেশ তাঁর কবিতায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। ‘শৈশবের বর্নি গ্রাম আবুল হাসানের চিত্ততলে রোপণ করেছে ভালোবাসার বীজ; বর্নির অবারিত প্রকৃতি উত্তরকালে তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল ভরা-নদীসম ‘আবেগের প্রতিনিধি’। আবুল হাসানের বর্নি গ্রাম যেন ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের অপুর নিশ্চিন্দিপুর।’ এখানে প্রসঙ্গক্রমে ‘পাখি হয়ে যায় প্রাণ’ কবিতার কিছু অংশ উল্লেখ করা যেতে পারেÑ

ফাতিমা ফুফুর প্রভাতকালীন কোরানের
মর্মাায়িত গানের স্মরণে তাই কেন যেনো আমি
চলে যাই আজো সেই বর্নি বাওড়ের বৈকালিক ভ্রমণের পথে

হাসানের অনেক বন্ধু ছিল, কবিবন্ধুও ছিল, তাঁদের নামে অনেক কবিতাও তিনি উৎসর্গ করেছেন। যেমন: ‘গাছগুলো’ কবিতাটি শহীদ কাদরীকে, ‘স্মৃতিকথা’ কবিতাটি হেলাল, কাঞ্চন, ওয়ালী, বাচ্চু ও রাব্বীকে, ‘রূপসনাতন’ কবিতাটি সিকান্দার আমিনুল হককে, ‘অন্তর্গত মানুষ’ কবিতাটি মুহম্মদ নুরুল হুদাকে, ‘বদলে যাও, কিছুটা বদলাও’ কবিতাটি শফিকুর রহমানকে,‘অসভ্য দর্শন’ কবিতাটি নির্মলেন্দু গুণকে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর অনেক বন্ধু আছে। তবুও একটি বেদনাময় দার্শনিক সিদ্ধান্তে উপনীত হোন যে, মানুষ মূলত একা। তাই আমাদের বাংলা কবিতায় নিঃসঙ্গতার আইকন হলো আবুল হাসান। আবুল হাসান নিজ সত্ত্বার একাকিত্ব ঘোষণা করেন তাঁর কবিতায়। এখানে প্রাসঙ্গিক কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করা যেতে পারে-
অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে এই পৃথিবীর সাথে কোনদিন।

লোকসংস্কার ও লোকবিশ্বাসের প্রবল প্রভাব কবির শিল্পীসত্ত্বায় আমরা দেখতে পাই। কবি আবুল হাসান শান্তির মানুষ। তাঁর শৈশব কেটেছে গ্রামের নৈসর্গিক পরিবেশে। সেখানকার গাছপালা, নদীনালা তথা প্রকৃতিকে আশ্রয় করে তাঁর বেড়ে ওঠা। তাই কবিতায় তিনি মাটির ঘ্রাণ মেখে শিল্পপ্রতিমা গড়ে তোলেন। এ জন্য তাঁর কবিতা সহজেই পাঠককে স্পর্শ করে যায়। কবি মাটির মানুষ, মাটির সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক। এ সম্পর্ককে সমুন্নত রেখেই তিনি শিল্পচর্চা করেন। কবি নিজেই বলছেন : ‘চিরকাল রক্তে আমি শান্তি আর শিল্পের মানুষ।’

আবুল হাসান বাংলা কবিতায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর আমাদের অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটে। দেশ মুক্ত হয়; মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঙালির অপূরণীয় ক্ষতি, প্রত্যাশা ও প্রাাপ্তি সম্পর্কে হতাশার সুর তাঁর কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে এভাবে :

‘অনেক রক্ত যুদ্ধ গেলো
অনেক রক্ত গেলোশিমুল তুলোর মতো
সোনারূপা ছড়ালো বাতাসে
ছোট ভাইটিকে আমি
কোথাও দেখিনা।’

সালেক শিবলু. এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

About সালেক শিবলু

বিএ অনার্স, এমএ (প্রথম শ্রেণি) এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

View all posts by সালেক শিবলু