অর্ধ-স্বরধ্বনির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ আলোচনা কর ।

অর্ধ-স্বরধ্বনির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ আলোচনা কর ।

ভাষা হলো বাক্যের সমষ্টি। আর বাক্য গঠিত হয় শব্দ দিয়ে। শব্দ গঠিত হয় ধ্বনির মাধ্যমে। সেই বিবেচনায় ধ্বনিই হলো ভাষার ক্ষুদ্রতম একক। ধ্বনি,শব্দ বাক্য সবই ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়। বাংলা ব্যাকরণের চারটি আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ধ্বনিতত্ত্ব। ধ্বনিতত্ত্বের মূল আলোচ্য বিষয় ধ্বনির উচ্চারণ, ধ্বনির বিন্যাস, বাকযন্ত্রের উচ্চারণ প্রক্রিয়া, ধ্বনিদল ইত্যাদি।

‘পৃথিবীর সকল ভাষাতেই বাগধ্বনিসমূহকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়- ব্যঞ্জনধ্বনি এবং স্বরধ্বনি। ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে আসার সময় বাপ্রত্যঙ্গগুলো যদি ততখানি সক্রিয় না থাকে এবং তেমন অনুরণিত না হয়, এমতাবস্থায় উচ্চারিত স্বরধ্বনিসমূহকে অর্ধ-স্বরধ্বনি বলে। উচ্চারণ প্রক্রিয়ার দিক থেকে অর্ধ-স্বরধ্বনি স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনির মাঝামাঝি। অর্থাৎ এ ধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময় স্বর ও ব্যঞ্জন উভয় ধ্বনির ধ্বনিপ্রকৃতি গ্রহণ করে । বাংলায় অর্থ-স্বরধ্বানির ব্যবহার সীমিত না হলেও এগুলোর সংখ্যা নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও ড. সুকুমার সেন বাংলা ভাষায় দুটো অর্ধ-স্বরধ্বনির উল্লেখ করেছেন । এ দুটো অর্ধ- স্বরধ্বনি হলো অন্তঃস্থÑয় ও অন্তঃস্থ ব । এরপরে মুহম্মদ আবদুল হাই উল্লিখিত দুটো অর্ধ- স্বরধ্বনি গ্রহণ করে এর সঙ্গে ই- শ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। চার্লস ফার্গুসন ও মুনীর চৌধুরী চারটি অর্ধস্বরধ্বনির কথা উল্লেখ করলেও তিনটির বেশি ‘জোড়’ দেখাতে পারেননি । তাদের নির্দেশিত অর্ধ স্বরধ্বনিগুলো হলো- ই, এ ও উ/কিন্তু প্রদর্শিত ধ্বনি/ই, এ ও । বাংলা ভাষার এই অর্ধস্বরধ্বনিগুলো ধ্বনিদলের কেন্দ্রে থাকে না । এরা আসলে ধ্বনিদলের অন্তে থাকে। তাই এগুলো অনেকটা ব্যঞ্জন জাতীয় এবং এ গুলোকে টেনে দীর্ঘ করা যায় না বা টেনে দীর্ঘ করা হলে এগুলো আর অর্ধ-স্বরধ্বনি থাকে না ।

যেমন-
১. ই : জা-ই (আমার জা-ই এ কাজ করেছে। যাই (আমি আজ যাই )
২. এ: এ (আমার জা-এ এ কাজ করেছে) যায় (সে রোজ বেরাতে যায় )
৩. ও : জা-ও (আমার জা-ও সঙ্গে যাবে) । যাও ( তুমি এখান থেকে চলে যাও )

অর্ধ স্বরধ্বনির গঠন: অর্থ-স্বরধ্বনির গঠন প্রসঙ্গে ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন যে, ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে আসার সময় বাক-প্রত্যঙ্গগুলো ততখানি সক্রিয় থাকে না বলে অনেক সময় স্বরধ্বনিগুলো ততখানি অনুরণিত হয় না এবং কম দ্যোতনায় এর প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্ধ-স্বরধ্বনিকে ধ্বনিগত প্রক্রিয়ার জন্যে পিচ্ছিল ধ্বনি হিসেবে বিচার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে স্বরধ্বনি গঠনের সময় শিথিল উচ্চারণ প্রক্রিয়ার জন্যে বদ্ধ স্বরধ্বনির কাছাকাছি স্বরধ্বনি গঠনের আগেই বাক-প্রত্যঙ্গ অন্য একটা ধ্বনি গঠনে অগ্রসর হয় বলে স্বরধ্বনি গঠনের পরিমাণগত সময়ের অভাবের জন্যে যে পিচ্ছিল ধ্বনি গঠিত হয়, তাই অর্ধ-স্বরধ্বনিরূপে পরিচিত।

অর্ধ স্বরধ্বনির বৈশিষ্ট্য:

বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ তার ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ নামক গ্রন্থে অর্ধ-স্বরধ্বনির নিম্নে বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করেছেন-

১. স্বরধ্বনির তুলনায় অর্ধ-স্বরধ্বনির উচ্চারণের সময় জিভের অবস্থান থাকে অনেক উঁচুতে এবং সেই পরিমাণে সামনের বা পিছনের
দিকও উঁচু থাকে।

২. অনেক সময় জিভের উচ্চতা অনান্য স্বরধ্বনির মতও থাকতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে অর্ধ-স্বরধ্বনিগুলো স্বরধ্বনির মত স্বরিত নয়।

৩. পাশাপাশি অবস্থিত দুটো স্বরধ্বনি উচ্চারণের দিক থেকে পার্থক্যের জন্য স্বরধ্বনির প্রকৃতির মধ্যেও পার্থক্য দেখা দেয়।

৪. পশাপাশি অবস্থিত দুটো স্বরধ্বনি যুগা বা দ্বিস্তর গঠন করার সময় একটা অন্যটার তুলনায় অনেক স্পষ্ট বা অনুরণিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *