পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বনে বিভূতিভূষণের প্রকৃতিপ্রেমের পরিচয় দাও।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) বাংলা কথাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ কথাশিল্পী । উপন্যাস রচনা করে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। তিনি জীবনপ্রেমিক মানুষ। মানুষের জীবনে প্রেম দু’ভাবে আসে। একটি মানবপ্রেম, অন্যটি প্রকৃতিপ্রেম। সামাজিক রীতি-নীতি দ্বারা মানবজীবনকে কিছুটা বাঁধা গেলেও মানবমনকে তো আর বাঁধা যায় না। তাই মানবমন কখনো কখনো প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। এই প্রকৃতিই হলো বিভূতিভূষণের উপন্যাসের মূল শক্তি। তিনি অনেক উপন্যাস রচনা করেছেন। পথের পাঁচালী তাঁর প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস । নিম্নে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস অবলম্বনে বিভূতিভূষণের প্রকৃতিপ্রেমের পরিচয় দেওয়া হলো-
পথের পাঁচালী (১৯২৯) উপন্যাসটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব ‘বল্লালী বালাই’, দ্বিতীয় পর্ব ‘আম আঁটির ভেঁপু’, তৃতীয় পর্ব ‘ অঙ্কুর সংবাদ’। উপন্যাসের কাহিনি নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের ‘সর্বজয়া ও হরিহর’ পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গ্রামের অসহায় দরিদ্র পরিবার, এ পরিবারে দুটি সন্তান রয়েছে, একটি কন্যা সন্তান, নাম দুর্গা; অপরটি পুত্র সন্তান, নাম অপু। এই অপু এবং দুর্গার শৈশবকালকে নিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনি একটি শিল্পিত পরিণতি লাভ করেছে। উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে অপু ও দুর্গা এই উপন্যাসের কিশোর চরিত্র। কিন্তু কিশোর হলেও অপু ও দুর্গাই এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। দুর্গা ও অপুর চোখে প্রকৃতির বিষ্ময়ভরা সৌন্দর্য লেখক এ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। দুটি কিশোর চোখে অপু-দুর্গা যা চেয়ে দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়ে যায়। অপু ছয় বছর বয়সে বাড়ির বাইরে আসে, প্রকৃতিকে দুচোখ ভরে দেখে, আর অপার বিষ্ময়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। দুর্গা বয়সে বড়, তাই দুর্গাই বনজঙ্গল থেকে কুলটা, আমটা, জামটা, আমড়া এমনই আরো কত কী সংগ্রহ করে আনে এবং দুই ভাই-বোন মিলে মিশে একত্রে উপভোগ করে। দুর্গা প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়, আর অপুও দুর্গার মতো প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। খুব অল্প সময়ই তারা বাড়িতে থাকে। শুধু খাওয়ার সময় পর্যন্ত, তারপরই বেড়িয়ে পরে বাইরে, প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতিতেই তারা প্রশান্তি লাভ করে। এমনকি দেখা যায় যে, সর্বজয়া চাল ভেজে অপুকে খাওয়ার জন্য ডাকছে আর অপু না খেয়ে বাড়ির বাইরে খেলতে যাচ্ছে। অপু খেলেই বেশি মজা পায়, প্রকৃতি তাকে ডেকে নিয়ে যায়, আর অপু-দুর্গা দুজনই এ ডাকে সারা দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যায়। কোন বাগানের ঝোঁপে বৈচি ফল পেকেছে, কোন বাগানে আমের গুটি ধরেছে, কোন বাঁশতলায় শেয়াকুল খাইতে মিষ্টি-এসব অপু ও দুর্গার মুখস্থ আছে। দুর্গা দুপুর বেলা পালিতদের বাগান থেকে দুটি কামরাঙা নিয়ে আসে, নিজে এগুলো খায় আর অপুকে জানায় এগুলো ‘মিষ্টি যেন গুড়’। অপুকেও একদিন নিয়ে যাবে এবং কামরাঙা পেড়ে খাওয়াবে। ঘরের খাবারের চেয়ে প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানা ফল-মূল জাতীয় খাবারই তাদের কাছে আসল খাবার। অর্থাৎ প্রকৃতির সান্নিধ্য তাদের ভালো লাগে, তাই কেবল ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া তারা সব সময় প্রকৃতির কোলে থাকতেই পছন্দ করে। বোশেখ মাসে ঝড় আসে, সবাই ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেয়। কিন্তু দুর্গা ও অপু ঘরের মধ্যে থাকতে পারে না। প্রকৃতি তাদের ডেকে নিয়ে যায়। প্রকৃতি ছাড়া অপু-দুর্গার ভালো লাগে না। প্রকৃতির কাছে গেলেই তারা প্রাণ ফিরে পায়। তাই ঘড়ের সময়েও তারা প্রকৃতির কাছে থাকে আর নেচে নেচে সতুদের আমবাগানে আমকুড়ায়। অপু অন্ধকার বাতাসে দু’একটি আম কুড়ালেও আনন্দদই বেশি প্রকাশ করে। সতু বাগানে এসে দুর্গা-অপুকে তাড়িয়ে দেয়। দুর্গা-অপু এই বাগান থেকে অন্য বাগানের দিকে চলে যায়। তবে যেখানেই যাক-প্রকৃতই তাদের আসল ঠিকানা। প্রকৃতি ছাড়া এক মুহূর্তও তারা শান্তিতে থাকতে পারে না।
প্রকৃতিকে নিয়ে দুর্গা-অপু আর আবার ছড়াও আবৃতি করেছে এভাবে-‘নেবুর পাতায় করমচা হে বৃষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা হে বৃষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা-’ দুর্গা সোনামুখী তলায় আম কুড়াতে যায় । বাড়ি ফিরার সময়ে একটি নারিকেল পায় তাই নিয়ে আনন্দে মায়ের হাতে তুলে দেয়। কখনো কখনো তারা রান্নার আয়োজন করে এবং সত্য সত্যই একদিন দুর্গা রান্না করে, ছোট্ট হাড়িতে ভাত চড়িয়ে দেয় এবং এক জায়গা থেকে বড় বড় মেটে আলু ফল নিয়ে আসে এবং ভাতে দেয়। পুটিদের তালতলার ঝোপের মাথায় এ গুলো অনেক পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোথায় কোন জিনিস পাওয়া যায় তা সবই দুর্গার নখদর্পণে রয়েছে। বৃষ্টির দিনে সর্বজয়া একটি কই মাছ ধরে বাড়ি নিয়ে আসে। বৃষ্টির পানিতে এটি ডাঙ্গায় উঠে আসে আর কানে হেঁটে বেড়ায়। এ কথা শুনে দুর্গার মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ দুর্গা কই মাছের কানে হেঁটে বেড়ানো দেখতে পারে নি। দুর্গা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে আসে। আসল কথা এ কয়দিন দুর্গা প্রকৃতির কাছে আসতে পারে নি। তাই দুর্গার মন খারাপ।
লেখক প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, তাই ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অপু আর দুর্গার দৃষ্টি দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। এ উপন্যাসে দুর্গা আর অপুর প্রকৃতিপ্রেম আসলে লেখকেরই প্রকৃতিপ্রেম। উপন্যাসের সমস্তটাই প্রকৃতির সুখ আর সৌন্দর্যের বর্ণনা। এখানে উপন্যাস থেকে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো-‘সোনাডাঙ্গার মাঠ এ অঞ্চলের সকলের বড় মাঠ। এখানে ওখানে বনঝোপ, শিমুল-বাবলা গাছ, খেজুর গাছে খেজুর কাঁদি ঝুলিতেছে, সোঁদালি ফুলের ঝাড় দুলিতেছে, চারিদিকে বৌ কথা কও পাখির ডাক। দূরপ্রসারী মাঠের উপর তিসির ফুলের রঙের মত গাঢ় নীল আকাশ উপুড় হইয়া পড়িয়াছে।’ এই হলো লেখকের প্রকৃতির বর্ণনার স্টাইল। প্রকৃতিই এই উপন্যাসের আসল বিষয়, এই প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই দুর্গা আর অপুর জীবন আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে, তারা যেমন জীবনকে ভালোবেসেছে, তেমনই প্রকৃতিকে ভালোবেসেছে।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে এ্ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অপু ও দুর্গা। তারা সর্বজয়া ও হরিহরের সন্তান হলেও তারা প্রকৃতির কোলে আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রকৃতির কোলেই বড় হয়েছে। তাদের কৈশোর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই প্রকৃতির কাছে কেটেছে। এই অপু ও দুর্গার প্রকৃতিপ্রেম মূলত লেখকেরই প্রকৃতিপ্রেম। এ রকম প্রকৃতিপ্রেম বাংলা উপন্যাসে সত্যিই বিরল।
সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।