পথের পাঁচালী উপন্যাসে অঙ্কিত বাস্তবজীবন-চিত্রের মধ্যেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপুর রোমান্টিক জীবনচেতনার আশ্চর্য ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলেছেন- আলোচনা কর। 2021

পথের পাঁচালী
পথের পাঁচালী উপন্যাসে অঙ্কিত বাস্তবজীবন-চিত্রের মধ্যেই বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপুর রোমান্টিক জীবনচেতনার আশ্চর্য ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলেছেন”- আলোচনা কর। (অপু চরিত্র)

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) বাংলা কথাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ কথাশিল্পী । উপন্যাস রচনা করে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। তিনি জীবনপ্রেমিক মানুষ। মানুষের জীবনে প্রেম দু’ভাবে আসে। একটি মানবপ্রেম, অন্যটি প্রকৃতিপ্রেম। সামাজিক রীতি-নীতি দ্বারা মানবজীবনকে কিছুটা বাঁধা গেলেও মানবমনকে তো আর বাঁধা যায় না। তাই মানবমন কখনো কখনো প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায়। এই প্রকৃতিই হলো বিভূতিভূষণের উপন্যাসের মূল শক্তি। তিনি অনেক উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘পথের পাঁচালী’ ’ তাঁর প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস । এ উপন্যাসে বেশ কিছু চরিত্র রয়েছে। তন্মধ্যে অপু অন্যতম। নিম্নে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস অবলম্বনে অপু চরিত্রটি বিশ্লেষণ করা হলো-

পথের পাঁচালী (১৯২৯) উপন্যাসটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব ‘বল্লালী বালাই’, দ্বিতীয় পর্ব ‘আম আঁটির ভেঁপু’, তৃতীয় পর্ব ‘অক্রুর সংবাদ’। উপন্যাসের কাহিনি নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের ‘সর্বজয়া ও হরিহর’ পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গ্রামের অসহায় দরিদ্র পরিবার, এ পরিবারে দুটি সন্তান রয়েছে, একটি কন্যা সন্তান, নাম দুর্গা; অপরটি পুত্র সন্তান, নাম অপু। এই অপু এবং দুর্গার শৈশবকালকে নিয়ে এই উপন্যাসের কাহিনি একটি শিল্পিত পরিণতি লাভ করেছে। উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে অপু এই উপন্যাসের কিশোর চরিত্র। কিন্তু কিশোর হলেও অপু এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। অপুর চোখে প্রকৃতির বিষ্ময়ভরা সৌন্দর্য লেখক এ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। কিশোর চোখে অপু যা চেয়ে দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়ে যায়। অপু ছয় বছর বয়সে বাড়ির বাইরে আসে, প্রকৃতিকে দুচোখ ভরে দেখে, আর অপার বিষ্ময়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। দুর্গা বয়সে বড়, তাই দুর্গাই বনজঙ্গল থেকে কুলটা, আমটা, জামটা, আমড়া এমনই আরো কত কী সংগ্রহ করে আনে এবং দুই ভাই-বোন মিলে মিশে একত্রে উপভোগ করে। অপু প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। খুব অল্প সময়ই তারা বাড়িতে থাকে। শুধু খাওয়ার সময় পর্যন্ত, তারপরই বেড়িয়ে পরে বাইরে, প্রকৃতির কোলে। প্রকৃতিতেই অপু প্রশান্তি লাভ করে। এমনকি দেখা যায় যে, সর্বজয়া চাল ভেজে অপুকে খাওয়ার জন্য ডাকছে আর অপু না খেয়ে বাড়ির বাইরে খেলতে যাচ্ছে। অপু খেলেই বেশি মজা পায়, প্রকৃতি তাকে ডেকে নিয়ে যায়, আর অপু এ ডাকে সারা দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে যায়। কোন বাগানের ঝোঁপে বৈচি ফল পেকেছে, কোন বাগানে আমের গুটি ধরেছে, কোন বাঁশতলায় শেয়াকুল খাইতে মিষ্টি-এসব অপুর মুখস্থ আছে। ঘরের খাবারের চেয়ে প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া নানা ফল-মূল জাতীয় খাবারই অপুর কাছে আসল খাবার। অর্থাৎ প্রকৃতির সান্নিধ্য তার ভালো লাগে, তাই কেবল ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া অপু সব সময় প্রকৃতির কোলে থাকতেই পছন্দ করে। বোশেখ মাসে ঝড় আসে, সবাই ঘরের মধ্যে আশ্রয় নেয়। কিন্তু অপু ঘরের মধ্যে থাকতে পারে না। প্রকৃতি তাদের ডেকে নিয়ে যায়। প্রকৃতি ছাড়া অপুর ভালো লাগে না। প্রকৃতির কাছে গেলেই অপু প্রাণ ফিরে পায়। তাই ঝড়ের সময়েও তারা প্রকৃতির কাছে থাকে আর নেচে নেচে সতুদের আমবাগানে আমকুড়ায়। অপু অন্ধকার বাতাসে দু’একটি আম কুড়ালেও আনন্দই বেশি প্রকাশ করে। অপু প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিকে অবাক বিষ্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে দেখে। ‘আম আঁটির ভেপু’র শুরুতেই দেখা যায় অপু বাবার সঙ্গে বাইরে যায়। আর বাবাকে নানা বিষয়ে নানা প্রশ্ন করে। অপুর মধ্যে রোমান্টিক জীবনচেতনা রয়েছে। যা দেখে তাতেই অপুর মধ্যে রোমান্টিকতা জেগে উঠে আর বাবাকে প্রশ্ন করে এভাবে-‘বনের মধ্যে কি গেল বাবা? বড় বড় কান?’। বাবা হরিহরের কাছে এ প্রশ্নের গুরুত্ব কম হলেও অপুর কাছে অনেক গুরুত্ব রয়েছে। তাই অপু বার বার একই প্রশ্ন করে। তখন নবীন পালিত উত্তর দেয় ‘ও হলো খরগোশ, খোকা খোরগোশ’। প্রকৃতিকে নিয়ে দুর্গা-অপু আর আবার ছড়াও আবৃতি করেছে এভাবে-‘নেবুর পাতায় করমচা হে বৃষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা হে বৃষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা-’ দুর্গা সোনামুখী তলায় আম কুড়াতে যায় । বাড়ি ফিরার সময়ে একটি নারিকেল পায় তাই নিয়ে আনন্দে মায়ের হাতে তুলে দেয়। কখনো কখনো তারা রান্নার আয়োজন করে এবং সত্য সত্যই একদিন দুর্গা রান্না করে, ছোট্ট হাড়িতে ভাত চড়িয়ে দেয় এবং এক জায়গা থেকে বড় বড় মেটে আলু ফল নিয়ে আসে এবং ভাতে দেয়। কোথায় কোন জিনিস পাওয়া যায় তা সবই অপু-দুর্গার নখদর্পণে রয়েছে। রান্না শেষে অপু আলু ভাজি আর ভাত খেয়ে রান্নার প্রশংসা করে কিন্তু লবণ হয়নি তাও বলে দিয়েছে। এতে বোঝা যায় অপু সব সময় সত্য কথা বলে।

অপু টুনি, বঙ্কু, সতু, নীলু, রাণী, পুঁটি, অমলার সঙ্গে খেলাধূলা করে সময় কাটায়। এ সব বন্ধুদের মধ্যে অমলাকেই বেশি পছন্দ করে। অমলা খেলতে না আসলে অপু অভিমান করে থাকে। আবার অমলা এসে অভিমান ভাঙ্গিয়ে খেলা শুরু করে। এভাবেই কিশোর চরিত্র অপুর মধ্যে রোমান্টিকতা জাগ্রত হয়। অপু মিশুক প্রকৃতির কিশোর চরিত্র। নায়টকের নায়ক চরিত্র অজয়ের সঙ্গে অল্প সময়েই অপুর ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। তাছাড়া অপুর মধ্যে অধিকার সচেতনা আছে। খেলার সময় সতু মাকাল ফল নিয়ে পালালে অপু পিছনে ধাওয়া করে। তাছাড়া অপু চরিত্রে বড় বোন দুর্গার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা রয়েছে। তাই মাঝে মাঝে দুর্গার জন্য অপুর চোখে জল আসতে দেখা গেছে।

‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অপুর দৃষ্টি দিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। এ উপন্যাসে অপুর প্রকৃতিপ্রেম আসলে লেখকেরই প্রকৃতিপ্রেম। প্রকৃতিই এই উপন্যাসের আসল বিষয়, এই প্রকৃতিকে কেন্দ্র করেই অপুর জীবন আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে, অপু যেমন জীবনকে ভালোবেসেছে, তেমনই প্রকৃতিকে ভালোবেসেছে। সবকিছু মিলিয়ে সমগ্র কথাসাহিত্যে অপু একটি অসাধারণ চরিত্র।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে এ্ উপন্যাসের প্রধান কিশোর চরিত্র অপু। অপু সর্বজয়া ও হরিহরের সন্তান হলেও সে প্রকৃতির কোলেই বড় হয়েছে। তার কৈশোর জীবনের বেশিরভাগ সময়ই প্রকৃতির কাছে কেটেছে। এই অপুর প্রকৃতিপ্রেম মূলত লেখকেরই প্রকৃতিপ্রেম। এ রকম প্রকৃতিপ্রেম আর কিশোর চরিত্র সমগ্র বাংলা উপন্যাসে সত্যিই বিরল।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *