আয়না গল্পগ্রন্থের নামকরণের সাফল্য আলোচনা কর।
আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৮৯) ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্মক গল্পকার হিসেবে অধিক কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। গল্প রচনার স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি ১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। সমকালীন সমাজজীবনে বিরাজমান অন্যায়-অত্যাচারের চিত্র তিনি ব্যঙ্গ-রসাত্মক ভাষায় উপস্থাপন করার প্রয়াস পেয়েছেন ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থে। তাঁর উল্লেখযোগ্য অপর গল্পগ্রন্থ হলো ‘ফুড কন্ফারেন্স’, ‘আসমানী পর্দা’, প্রভৃতি। তাঁর মোট তিনটি গল্পগ্রন্থের মধ্যে ‘আয়না’(১৯৩৫) গল্পগ্রন্থটি অন্যতম। এটি একটি সার্থক গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থটির নামকরণের সার্থকতা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
‘আয়না’ গল্পগ্রন্থটি আবুল মনসুর আহমদের গল্পের বই। এটি ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। এ গল্পগ্রন্থে মোট সাতটি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলো হলো ‘হুজুর কেবলা’, ‘গো দেওতা-কা দেশ’, ‘নায়েবে নবী’, লিডরে কওম’, ‘মজাহেদিন’, বিদ্রোহী সংঘ’ এবং ‘ধর্মরাজ্য’। এ গল্পগুলো মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল্। সমকালীন সমাজের নানা অবক্ষয়, ধর্মীয় গোড়ামী, প্রতারণা, রাজনৈতিক হতাশা, এবং বঙ্গীয় মুসলমানদের জীবনচিত্র এ গ্রন্থের বিভিন্ন গল্পে ফুটে উঠেছে। গোড়া ধর্মাবল্বীদের রক্ষণশীল মনোভাব, ধর্ম পালনের নামে বাড়াবাড়ি, ক্ষুদ্র স্বার্থ আদায়ের জন্য দ্বন্দ্ব-কলহ, ধর্ম নিয়ে ব্যবসা, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ইত্যাদি বিষয় এই সব গল্পে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেছেন।‘গো-দেওতা-কা দেশ’ ও ‘ধর্মরাজ্য’ গল্প দুটিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। ধর্মীয় দলাদলি, অজ্ঞতা ও ভ-ামি নিয়ে পীর মওলানাদের যে ব্যবসা, তার উপর ভিত্তি করে ‘নায়েবে নবী’ ও ‘মুজাহেদিন’ গল্পদুটি রচিত হয়েছে। এ সব গল্পে হানাফি ও মাজহাবি মতানুসারীদের মধ্যকার তর্কযুদ্ধ লেখক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে তুলে ধরেছেন। এ গল্পটি হানাফি মোহাম্মদি বিরোধের পটভূমিতে রচিত। হানাফি-মোহাম্মদিদের মধ্যে বিরোধ, বাহাসের সভা, সভা শেষে মারামারি, পরিণামে মামলা-মোকদ্দমা জেল-জরিমানা ছিল সাধারণ ব্যাপার। ‘হুজুর কেবল’ ও ‘লিডরে কওম’ গল্পদুটিতে ভ-পীর ও বক ধার্মিকদের প্রকৃতি স্বরুপ উন্মোচিত হয়েছে। ‘হুজুর কেবলা’ ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প। এ গল্পের প্রধান চরিত্র হুজুর কেবলা। ‘হুজুর কেবলা’ গল্পে হুজুর কীভাবে অশিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়কে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে নিজের হীন লালসা চরিতার্থ করার জন্য হযরত মোহাম্মদ সো:কে নিয়ে তামাশা করেছেন এবং শেষে তার একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও মুরিদ রজবের নববিবাহিতা সুন্দরী স্ত্রী কলিমনকে বিয়ে করেছে সেই চিত্র ই আবুল মনসুর আহমদ এ গল্পে দেখিয়েছেন।
আবুল মনসুর আহমদের ‘বিদ্রোহী সংঘ’ গল্পটি রাজনৈতিক ব্যাঙ্গের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইংরেজদের শাসনামলে ভারতবর্ষে যে সমস্ত আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে তার মধ্যে অন্যতম স্বদেশী আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদি। এ গল্পে লেখক দেখিয়েছেন যে, আন্দোলনের জন্য একদল যুবক একটি বিদ্রেহী সংঘ গড়ে তোলে। আফতাব হোসেন এ সংঘের সদস্যদের কাজ দেখে আর্শ্চয হয়ে যায়। তারা প্রচলিত নিয়মের কোন ধার ধারে না। তারা হৈচৈ করলে তাকে গান বলে অভিহিত করে। সবাইকে ব্রাদার বলে সমে¦াধন না করে বলে ব্রাদার ইন ল ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে এরা নামেই বিদ্রোহী, আসলে তাদের অবস্থা অন্তঃসারশূন্য। এই গল্পে লেখক কথিত বিদ্রোহীদের মুখোশ উন্মোচনের চেষ্টা করেছেন। ‘ধর্মরাজ্য’ ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের সর্বশেষ গল্প। হিন্দু ও মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা গল্পটির মূল বিষয়। ধর্ম মানুষকে রক্ষা করবার জন্য পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু মানুষ এই ধর্মকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব করে শেষ হয়ে যাচ্ছে-এই বাস্তবতায় ‘ধর্মরাজ্য’ গল্পটি রচিত হয়েছে।
আবুর মনসুর আহমদ একজন সচেতন শিল্পী। তিনি সমকালীন সমাজ ও সমাজবাস্তবতাকে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আমাদের সমাজে কিছু ছদ্মবেশী মানুষ রয়েছে। ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থে তিনি সে সব ছদ্মবেশী মানুষের প্রকৃত চেহারা উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন। বস্তুত দর্পণ বা আয়নায় যেমন নিখুঁত ছবি প্রতিবিম্বিত হয়, তেমনিই আবুল মনসুর আহমদ আয়নায় সমাজের মুখোশধারী বকধার্মিক, ভ-দের চিত্র পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে। তিনি সমাজের প্রকৃতি ছবি আঁকতে গিয়ে বেছে নিয়েছেন হাস্যরস কলানৈপুণ্য। সমাজের নানা অসঙ্গতি বিশেষ করে স্বধর্মের অবনতি ও নীতনৈতিক জ্ঞানবিবির্জত ধর্মগুরুদের কা-জ্ঞানহীন কা-কারখানা লেখক ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থে তুলে ধরেছেন।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থ পঠন-পাঠনের মধ্যে পাঠক একধরনের হাসি পেলেও এ হাসির আড়ালে রয়েছে কান্না। কাচের নির্মিত আয়নার মাধ্যমে যেমন নিজের প্রতিচ্ছবি নিখুঁতভাবে অবলোকন করা যায় তেমনই ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের মাধ্যমে সমকালীন সমাজ, সমাজের মানুষ ও তাদের নানা রকম অনৈতিক ও অসঙ্গতিমূলক কর্মক্-া আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে। তাই এ সমস্ত বিষয়ের সার্বিক বিশ্লেষণে বলা যায় যে, ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের নামকরণ সার্থক হয়েছে।
সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।