বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বাবু প্রবন্ধে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে বাবু চরিত্রের যে স্বরুপ তুলে ধরেছেন তা আলোচনা কর।

বঙ্কিমচন্দ্র

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বাবু প্রবন্ধে ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মধ্য দিয়ে ‘বাবু’ চরিত্রের যে স্বরুপ তুলে ধরেছেন তা আলোচনা কর।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) বাংলা ভাষার প্রথম সফল গদ্যশিল্পী । উপন্যাসের মতো বাংলা প্রবন্ধ রচনায় তিনি সফলতা দেখিয়েছেন। তিনিই বাংলা ভাষায় প্রথম তুলনামূলক সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থের সংখ্যা অনেক। তন্মধ্যে ‘লোকরহস্য’ (১৮৭৪) অন্যতম একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ। এ প্রবন্ধ গ্রন্থে মোট ১৫টি প্রবন্ধ রয়েছে। তন্মধ্যে বাবু প্রবন্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ । বঙ্কিম এ প্রবন্ধে বাঙালিদের অবস্থা, বিশেষ করে বাবু সম্প্রদায়ের স্বরুপ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন। নিম্নে এ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য আলোচনা করা হলো-

একজন সার্থক উপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরিচিত। তিনি একজন সার্থক প্রাবন্ধিকও । ‘বঙ্গদর্শন’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা ১৮৭২ সালে বঙ্কিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যের সমালোচনা, জাতীয় সংস্কৃতি, সমাজ ও জীবন অবলম্বনে তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি অত্যন্ত সহজ সুন্দর ও স্পষ্টভাবে বক্তব্য প্রকাশ করেন। বঙ্কিমের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল। বঙ্কিমের প্রবন্ধ প্রধানত বুদ্ধিনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী। তিনিই প্রথম প্রবন্ধে সরসতা দিয়ে ইহাকে প্রথম শ্রেণির শিল্পের মর্যাদা দিয়েছেন। প্রবন্ধ সাহিত্রে তাঁর পরিণত মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘লোকরহস্য’ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে তিনি স্বসমাজ ও স্বাদেশিকতার পরিচয় দিয়েছেন। রহস্য সৃষ্টিই ‘লোকরহস্য’ প্রবন্ধের মূল বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র মূলত ‘বাবু’ প্রবন্ধে ব্যঙ্গ বা কৌতুক সৃষ্টি করেছেন-এটা আপাতত বক্তব্যের উপরিভাগের অর্থ। কিন্তু এর ভেতরে রয়েছে বঙ্কিমের তীব্র সমাজ বিশ্লেষণের দৃষ্টি।

প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতের জন মেজয় ও বৈশম্পায়ন এর সংলাপের মধ্য দিয়ে ‘বাবু’ প্রবন্ধের বক্তব্য একটি সফল পরিণতির দিকে গিয়েছে। ‘বাবু’ একটি সামাজিক ও রাজনীতি বিষযক প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধের আয়তন ছোট কিন্তু এর ব্যাপকতা অত্যন্ত বিশাল ও বিস্তৃত। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষ সময়ে ভারতবর্ষের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু মানুষের আচরণের নানা বিষয় তিনি এ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। ইউরোপ মহাদেশে রেনেসা শুরু হয়, এর প্রভাব লাগে আমাদের দেশেও। কিছু মানুষ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা নিজেদেরকে একটি অভিজাত শ্রেণির মানুষ হিসেবে গণ্য করে। এমন কি এই শ্রেণির মানুষরা নিজেদের মাতৃভাষা পর্যন্ত ভুলে যায়। তারা ইংরোজি ভাষায় কথা বলে, মাতৃভাষা বাংলাকে ঘৃণা করে। যখন কবথা বলে তখন বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে। পরিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলাকে তারা অপমানজনক মনে করে। আর ইংরেজি জানাকে গর্বের বিষয ভাবে। তবে তারা শুদ্ধ করে ইংরেজি ভাষাও জানে না। তারা শুধু কথা বলায় খুব পারদর্শি কিন্তু কাজে নেই। তাদের পা শুকনো কাঠের মতো কিন্তু পালাতে তারা খুবই সক্ষম। এদের হাত খুব দূর্বল। কিন্তু ভালো লেখতে পারে, কাজ করুক বা নাকরুক, দায়িত্ব পালন না করেও তারা বেতন নিতে খুব পছন্দ করে। বাবুরা কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই অর্থ সঞ্চয় করে। সঞ্চয়ের জন্য যে কোন উপায়েই হোক, উপার্জন করা দরকার। আর উপার্জনের জন্য কিছুটা লেখাপড়া করে বিদ্যালাভ করতে হয়। আর এ জন্য তারা প্রশ্ন চুরি করে থাকে। বাবুরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তাই পুজা করতে চায় না। যখন পুজা করে তখন কেবল অশ্বনী কুমারীদিগের পুজা করে। বাবুদের অনেক রুপ আছে, রুপে তারা অতুলনীয় কিন্তু তাদের মধ্যে কোন গুণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাবুদের আবার কাব্যপাঠে খুব আগ্রহ আছে। বুঝুক আর না বুঝক তারা কাব্যপাঠ আর সমালোচনায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করে। বাবুরা কাজ-কর্মে জড় প্রদার্থ কিন্তু বাক্যে সরস্বতী। বাবুরা খুব শক্তিমান পুরুষ। এদের হাতে একগুণ, মুখে দশ গুণ, পিঠে শত গুণ, কিন্তু যখন কোন শক্তির প্রয়োজন তখন তারা হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। এই হলো বাবুদের স্বভাব।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ প্রবন্ধে কিছু বাঙালি বাবুর নানা কর্মকাণ্ডের ও কাজের অসঙ্গতির দিকটি তুলে ধরেছেন। বাঙালিদের ইংরেজ জাতির পায়ের কাছে নিজেদের নত করাকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমালোচনা করেছেন। সোজাসুজি কথা বললে তো আর রহস্য থাকে না। তাই একটু ঘুরিয়ে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপের মাধ্যমে সমাজের বাস্তব অবস্থাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। এই প্রবন্ধে দেখা যায় যে, রাজা বাবুদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন আর বৈশম্পায়ন বাবুদের নানারকম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন। বৈমম্পায়ন জানিয়েছেন যে, বাবুরা বিচিত্রবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ। কলি যুগে এই বাবুদের আগমন ঘটবে বলে বৈশম্পায়ন বলেিেছলেন। আসলে এই কলিযুগের মানুষ বলতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টেপাধ্যায় আধুনিক যুগের প্রথম দিকের কোলকাতার তথাকথিত শিক্ষিত বাঙাালি সমাজের স্বরুপ এই প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। এই বৈশম্পায়ন মহাভারতের একটি চরিত্র হলেও আসলে বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই এই প্রবন্ধে বৈশম্পায়নের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বাবু’ প্রবন্ধে তাঁর মননশীল চিন্তা-চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। বঙ্কিমের প্রবন্ধ রচনার পটভূমি তাঁর সমাজ ও সমাজের মানুষ। তিনি সমাজের শিক্ষিত মানুষের নৈতিক অধঃপতন দেখতে পেয়েছেন, আর ব্যথিত হয়েছেন। সরকারি চাকরি করায় সরাসরি এ সব অসঙ্গতিকে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। তাই বিকল্প পথ বেছে নিয়েছেন। এমনভাবে তিনি বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন যে, যাতে সরাসরি মানুষ বুঝতে না পারে। প্রবন্ধ পাঠ করে সাধারণত হাসি পাবে এমনই তাঁর উপস্থাপনার স্টাইল। কিন্তু এ হাসির অন্তরালে রয়েছে কান্না। এ প্রবন্ধে তিনি যে যৌক্তিক মতামত ব্যক্ত করেছেন যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপনাশৈলি, ও রস বিচারে ‘বাবু’ একটি অসাধারণ প্রবন্ধ। এ রকম প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যে সত্যিই বিরল। সমাজে বিশেষ এক শ্রেণির তথাকথিত শিক্ষিত বাবু সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য ও স্বরুপ এ প্রবন্ধে উপস্থাপিত হয়েছে।

সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *