সাধারণ হতদরিদ্র মানুষের জীবন যন্ত্রণার অসামান্য রূপকার তারাশঙ্কর-আলোচনা কর। Nu Bangla 231005

তারাশঙ্কর
তারাশঙ্কর
সাধারণ হতদরিদ্র মানুষের জীবন যন্ত্রণার অসামান্য রুপকার তারাশঙ্কর-আলোচনা কর। অথবা, (নিম্নবর্গের মানুষ / প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্র / চরিত্রচিত্রণ দক্ষতা / নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবন/গল্পের বিষয়বস্তু)
ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় শাখা । আধুনিক যুগে এ শাখার সৃষ্টি হয়েছে এবং বর্তমানে এ শাখা সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেছে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা। এরপর বাংলা সাহিত্যে অনেক লেখক এসেছে। এদের মধ্যে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭১) একজন অন্যতম লেখক। বাংলা ছোটগল্প রচনায় তিনি বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর শিল্পসম্মত ও জনপ্রিয় গল্পের সংখ্যা অনেক। এরমধ্যে ‘রসকলি’, ‘সন্ধ্যামণি’,‘জলসাঘর’, ‘নারী ও নাগিনী’, ‘তারিণী মাঝি’, ‘পদ্মবউ’, ‘ডাইনী’, ‘বোবা কান্না’ ইত্যাদি অন্যতম। তারাশঙ্কর অধিকাংশ গল্পে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের জীবনযন্ত্রণা উপস্থাপন করেছেন। বিষয়টি নিম্ন আলোচনা করা হলো-

তারাশঙ্কর সমাজসচেতন শিল্পী। তিনি সমকালীন সমাজে মানুষের শ্রেণিবিভাজন দেখতে পেয়েছেন। একই সমাজে একজন গাছতলায়, আবার একজন পাঁচতলায়। একজন দু’বেলার খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না, আবার আরেকজন অসংখ্য মানুষের খাবার মজুত করে রাখছে। সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য এতটাই প্রকট। তারাশঙ্কর এসব ব্যবধান দেখেছেন আর এগুলোকেই তাঁর ছোটগল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেছেন। চরিত্রগুলোও তিনি সমাজের প্রান্তিক মানুষ থেকে নির্বাচন করেছেন। তাঁর গল্পগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অধিকাংশ গল্পের নারী ও পুরুষ চরিত্র সমাজের নিচু তলার মানুষ। যেমন ‘রসকলি’ গল্পের পুলিন, মঞ্জরী, রামদাস, ‘সন্ধ্যামণি’ গল্পের কেনারাম, পৈরু, ‘নারী ও নাগিনী’ গল্পের খোঁড়া শেখর, ‘তারিণী মাঝি’ গল্পের তারিণী মাঝি, ‘ডাইনী’ গল্পের অনাথ বালিকা ডাইনী ইত্যাদি। তারা সবাই সমাজের প্রান্তিক মানুষ। সমাজের ছোট পেশা তারা অবলম্বন করেছে, অল্প একটু উপার্জন করেছে, অনেকটা দিন আনে দিন খায় এ রকম। সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের জীবনযšত্রণাকে তারাশঙ্কর তাঁর ছোটগল্পে উপস্থাপন করেছেন দক্ষতার সাথে। বিষয়টি আরো একটু বিশ্লেষণ করতে চাই।

‘রসকলি’ গল্পটি বৈষ্ণবদের জীবনকাহিনি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। এ গল্পের চরিত্রগুলো পুলিন, মঞ্জরী, রামদাস অন্যতম। রামদাসের দুঃখের অন্ত নেই। সে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। পুলিন চরিত্রটি সবশেষে এই পেশাটি বেছে নিয়েছে। মঞ্জরী গান গেয়ে একটু উপার্জন করেছে, তাই দিয়ে জীবন চালিয়েছে। ‘সন্ধ্যামণি’ গল্পে আরো করুণ অবস্থা লেখক আমাদেরকে জানিয়েছেন। এখানে বেশ্যাদের অমানবিক জীবনের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। এ গল্পে দেখা যায় কেনারাম চাটুজ্জে শশ্মানে থাকে। সেখানে পৈরু নামে এক চ-াল থাকে। এই চ-ালের সাথে কেনারাম সহবাস করে। দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে কুকুরগুলোর সঙ্গে মলে মিশে কেনারাম ও পৈরু একই সঙ্গে থাকে। তারা কুকুরের ভাষা বোঝে এবং কুকুরকেই তাদের সঙ্গী মনে করে আদর করে। চ-াল শশ্মানে শব পোড়ায়, যতটুকু টাকা পায়, তা দিয়েই তার জীবন-সংসার চলে। এমনই অসহায় ও করুণ, মানবেতর জীবনের কথা তারাশঙ্কর ‘সন্ধ্যামণি’ গল্পে উপস্থাপন করেছেন। এই গল্পে দেখা যায় যে, শশ্মানের কাছে একটি বাজার আছে। এই বাজারকে কেন্দ্র করে অবহেলিত নি¤œবর্গের মানুষের জীবনকাহিনি গড়ে উঠেছে। ‘নারী ও নাগিনী’ গল্পের খোঁড়া শেখ প্রধান পুরুষ চরিত্র। সে সাপুড়ে, সাপ ধরে, সাপ খেলা দেখায়-এর মাধ্যমেই সংসারের সব খরচ চালায়। ‘তারিণী মাঝি’ একটি অন্যতম শিল্পসফল গল্প। তারিণী মাঝি চরিত্রটি প্রধান পুরুষ চরিত্র। মাঝিগিরি করে তারিণী তার সংসারের ব্যয় মেটায়। তারিণী ময়ুরাক্ষী নদীর মাঝি। এ পার থেকে ও পারে লোক পারাপার করে। এ জন্য তাকে সবাই মাঝি বলে ডাকে। ময়ুরাক্ষী নদীতে বন্যার পানি আসলে তারিণী মাঝি খুব খুশি হয়। এ সময় তার আয় কিছুটা বেড়ে যায়। এই আয়টুকু দিয়েই সুখী নামের নারীটিকে নিয়ে তারিণী সুখে আছে। কিন্তু এই নদীই এক সময় সুখীর জীবন কেড়ে নেয়। ‘ডাইনী’ গল্পের অনাথ বালিকা এক সময় সত্যিই ডাইনী হয়ে যায়। মেয়েটি অনাথ, পেটভরা ক্ষুধা। তাই খাবার দেখলেই অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকতো। তাই লোকে তাকে ডাইনী বলে ডাকতো। এই ভাবে সমাজের মানুষের অত্যাচার আর অপবাদে একদিন সত্যিই অনাথ বালিকাটি ডাইনী হয়ে যায় এবং তার তাকানোতে মানুষের প্রাণ যেতে লাগলো। এইভাবে দেখা যায় যে, তারাশঙ্করের ছোটগল্পের চরিত্রগুলো সমাজের প্রান্তিক মানুষ। পেশায় তারা কেউ মাঝি, কেউ জেলে, কেউ সাপুড়ে, আবার কেউ চ-াল। অর্থাৎ তারা সবাই ছোট ও অবহেলিত পেশার সঙ্গে জড়িত। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনভাবে বেঁচে থাকে।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায় একজন সমাজ সচেতন শিল্পী। তিনি সচেতনভাবে তাঁর গল্পগুলোতে সমকালীন সমাজের অবহেলিত মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-বেদনাময় চিত্র তিনি উপস্থাপন করেছেন। সমাজের কিছু মানুষ জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে জীবন সংগ্রামে নেমেছে। তারা কখনো শশ্মানে, কখনো নদীতে, আবার কখনো সাপের গুহায় নেমেছে , চেষ্টা করেছে দুটি পয়সা উপার্জনের। এভাবেই তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম চলে। তারা কখনো হেরে যায় আবার কখনো জিতে যায়। তাই সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে বলা যায় যে, সাধারণ হতদরিদ্র মানুষের জীবন যন্ত্রণার অসামান্য রুপকার তারাশঙ্কর। তিনি যেভাবে বাংলা ছোটগল্পে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের কথা উপস্থাপন করেছেন এভাবে আর কোন লেখক করতে পারে নি। বিষয়বস্তু নির্বাচন, চরিত্র নির্মাণ, কাহিনি বর্ণনা সর্বোপরি উপস্থাপনাশৈলীতে তাঁর ছোটগল্পগুলো বাংলা সাহিত্যে বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেছে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *