বাংলা গদ্য সাহিত্যের বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান মূল্যায়ন কর।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল কবিতা নির্ভর। বাংলা গদ্যসাহিত্য আধুনিক যুগের সৃষ্টি। ১৫৫৫ সালে কুচবিহারের রাজা আসামের রাজার নিকট একটি পত্র লেখেন। এটাই বাংলা ভাষার গদ্যের প্রথম নিদর্শন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজদের প্রচেষ্টায় বাংলা গদ্য আস্তে আস্তে উন্নতি সাধন করে। বাংলা গদ্যসাহিত্যের উন্নতিতে যে সমস্ত বাঙালিরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩) অন্যতম। তিনি একজন প্রগতিশীল মনের মানুষ। নি¤েœ বাংলা গদ্যের বিকাশে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান মূল্যায়ন করা হলো-
প্রতিভা বা ব্যক্তিত্ব যে কোন দিক থেকেই হোক, রাজা রামমোহন রায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মতো প-িত মানুষ বাংলা সাহিত্যে খুব কম আছে। তিনি অসীম প্রতিভা ও বিপুল হৃদয় নিয়ে বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছেন। নিজে সারাজীবন সংস্কারমুক্ত থেকেছেন এবং দেশবাসীকে সংস্কারের মধ্যে নিয়ে আসতে চেয়েছেন। আর এ জন্য তিনি কলম হাতে লেখনি ধারন করেন। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বই রচনা করেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় ত্রিশটি। এই সমস্ত বই বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, তিনি কত বড় মাপের একজন গদ্য শিল্পী। গদ্যের ভাষাকে তিনি মানুষের কাছে নিয়ে এসেছেন। তাঁর হাতে রচিত বাংলা ভাষার গুরুত্বপুর্ণ কিছু বই এখানে উল্লেখ করতে চাই। প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ যেমন : বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্ত সার, উপনিষদের অনুবাদ ইত্যাদি। কিছু বির্তকমূলক রচনা যেমন : গোস্বামীর সহিত বিচার, ভট্টাচার্যের সহিত বিচার, সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক-নিবর্তক সম্বাদ, কবিতাকারের সহিত বিচার, ব্রাহ্মণ সেবধি, পথ্য প্রদান, সহমরণ বিষয়ক ইত্যাদি। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা এ সব বই পড়লে সহজেই বোঝা যায়। তাছাড়া তার রচিত বইগুলো প্রমাণ করে যে, তিনি একজন গদ্যশিল্পীও। বাংলা গদ্যভাষার প্রচার ও প্রসারে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তিনি সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যরীতিকে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন বিষয় উপযোগী গদ্যভাষা নির্মাণে তার অবদান অনস্বীকার্য। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন বহুভাষাবিদ। তিনি অনেক ভাষা জানতেন, বলতেন এবং লিখতে পারতেন। বাংলা ভাষায় ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ নামে তিনি একটি ব্যাকরণগ্রন্থ রচনা করেছেন। এ গ্রন্থে তিনি বাংলা ব্যাকরণের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন, বিধি-বিধান সম্পকে সুনিদিষ্ট আলোচনা করেছেন। বাংলা ভাষার উপর রামমোহনের যে দক্ষতা তা এই বইয়ের মাধ্যমে দেখা যায়। আর সমাজ সংস্কারমূলক অনান্য পুস্তকে তার গদ্যশৈলির বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলা ভাষায় যে প্রাণ আছে তা রামমোহনের গদ্য পড়লে বোঝা যায়। বাংলা গদ্য রচনায় তিনি কোন সুনিদিষ্ট শৈলি অনুসরণ না করলেও তার বক্তব্য উপস্থাপনে ভাষিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর প্রবন্ধগুলো যেমন যুক্তিনিষ্ঠ তেমনই সাহিত্যিগুণে গুণাণি¦ত। বেদগ্রন্থে যে একেশ্বরবাদের কথা আছে তা তিনি যুক্তিসহকারে তুলে ধরেছেন। অন্য ধর্মের মানুষের আক্রমনের উপযুক্ত জবাব যুক্তিসহকারে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি শুধু বেদ নয়, অনান্য ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা করেছেন এবং এ নিয়ে অনেক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ধর্ম ও দর্শন চর্চাকে সহজ করে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছেন। উচ্চতর চিন্তা ও ভাবকল্পনার বাহন হিসেবে বাংলা গদ্যকে উপযোগী করে তোলেন।
রামমোহন রায়
রামমোহন রায় যখন বাংলা গদ্য ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করেন, তখন বাংলা গদ্যের উন্মেষের যুগ। এই সময়ে তার সামনে বাংলা গদ্যের উপযুক্ত কোন মডেল ছিল না। বিদ্যাসাগরের বিরামচিহ্ন তখন বাংলা ভাষায় ছিল না। তবে বাক্যের শেষে এক দাঁড়ি বা দুই দাঁড়ির ব্যবহার ছিল। রামমোহন এক দাঁড়ি বাংলায় ব্যবহার করতেন। বিরামচিহ্ন ছাড়াও কীভাবে সরল বাংলা গদ্য রচনা করা যায়, তা তিনি বাস্তবে প্রমাণ দেখিয়েছেন। তিনি জানতেন কীভাবে বাক্য গঠন করতে হয়, মনের ভাব প্রকাশের উপযুক্ত ভাষা তিনি তৈরি করেছিলেন। তাই যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরগুপ্ত রামমোহনের ভাষার প্রশংসা করেছেন। তিনি জলের মতো বাংলা ভাষায় গদ্য রচনা করেছেন এবং পাঠকরা সহজেই তার ভাষা পড়ে অর্থ বুঝতে পারতো। তার লেখা সমকালীন সমাজ ও পাঠকের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সবাই তার লেখা পাঠ করতো। বিষয়বস্তু নিয়ে কখনো কখনো বিবাদ থাকলেও তার গদ্য রচনার স্টাইল নিয়ে কারো কোন নেতিবাচক মনোভাব ছিল না। তাঁর গদ্য ভাষা প্রাঞ্জল ও সহজবোধ্য। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গদ্য ভাষার প্রশংসা করেছেন। রামমোহন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কি রাজনীতি, কি বিদ্যাশিক্ষা, কি সমাজ, কি ভাষা, আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই।’ ভাষা বিকাশে রামমোহন রায়ের যে অবদান তাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন।
রামমোহন রায় যেমন বাঙালিকে মধ্যযুগীয় ভাবনা থেকে মুক্ত করেছেন, আধুনিক ভাবনা ও প্রগতিশীল চেতনার সঙ্গে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তেমনই বাংলা গদ্যভাষাকেও মধ্যযুগের জড়তা থেকে মুক্ত করেছেন। বাংলা গদ্যভাষার মধ্যে গতিশীলতা আনয়ন করেছেন। দুর্বোধ্য, কাঠিন্য ও প্রপঞ্চ থেকে বাংলা গদ্য ভাষাকে মুক্ত করে আমাদের প্রাণের ভাষা বানিয়েছেন। তাই দেখা যায় যে, সমাজ সংস্কারের মতো বাংলা গদ্য ভাষায়ও তিনি সংস্কার সাধন করেছেন। বাঙালি আজীবন তার এ সাধনা ও গদ্যভাষার বিকাশের জন্য তাঁকে স্মরণ করবে। সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে বলা যায় যে, বাংলা গদ্যভাষা রামমোহনের অবদান অতুলনীয়।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, রাজা রামমোহন রায় বাংলা গদ্যভাষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনিই প্রথম বাংলা গদ্য ভাষায় গতিশীলতা আনয়ন করেছেন। এতে বাক্যে অর্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে সব বাধা দূর হয়েছে। বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে সুন্দর যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের ভাষারীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। রামমোহন রায় প্রথম পর্যায়ে বাংলা গদ্যভাষাকে আড়ষ্ঠতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। গদ্য ভাষার মধ্যে যে সজীব প্রাণশক্তি রয়েছে এটি রামমোহন রায়ই প্রথম আবিস্কার করেন। সুতরাং বিষয়টির সার্বিক বিবেচনা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায় যে, রামমোহন রায় বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী এবং তিনিই বাংলা গদ্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এক কথায় বাংলা গদ্যভাষা বিকাশে তার অবদান অপরিসীম।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।