বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান মূল্যায়ন কর।

ঈশ্বরচন্দ্র
ঈশ্বরচন্দ্র
বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান মূল্যায়ন কর।

বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল কবিতা নির্ভর। বাংলা গদ্যসাহিত্য আধুনিক যুগের সৃষ্টি। ১৫৫৫ সালে কুচবিহারের রাজা আসামের রাজার নিকট একটি পত্র লেখেন। এটাই বাংলা ভাষার গদ্যের প্রথম নিদর্শন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজদের প্রচেষ্টায় বাংলা গদ্য আস্তে আস্তে উন্নতি সাধন করে। বাংলা গদ্যসাহিত্যের উন্নতিতে যে সমস্ত বাঙালিরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) অন্যতম। নিম্নে বাংলা গদ্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান মূল্যায়ন করা হলো-

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিল্পসম্মত বাংলা গদ্যের জনক। তার আসল নাম ছিল ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা। তিনি সংস্কৃত কলেজ থেকে মাত্র ১৯ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। তিনি ১৮৪১ সালে ফোর্ট ইউলিয়াম কলেজের প্রধান প-িত নিযুক্ত হোন, ১৮৫১ সালে এই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হোন। বিধবা বিবাহের পক্ষে এবং বহুবিবাহের বিপক্ষে বিদ্যাসাগর সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিদ্যাসাগরের সমস্ত গ্রন্থকে মোট দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পড়ে মৌলিক রচনা, দি¦তীয়ভাগে পড়ে অনুবাদমূলক রচনা। তবে যে রচনাই হোক না কেন বিদ্যাসাগর এ সব রচনাকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং বাংলা গদ্যভাষাকে একটি মান পর্যায়ে উন্নিত করতে পেরেছেন। তিনি বাংলা গদ্যসৃষ্টির প্রথম পর্যায়ের শৃঙ্খলা, পরিমিতি বোধ, যতিচিহ্নের প্রয়োগ দেখিয়েছেন এবং বাংলা সাধু গদ্যরীতিকে পূর্ণাঙ্গ রুপ দান করেছেন।

বিদ্যাসাগরের গ্রন্থ সংখ্যা অনেক। শিল্পসৃষ্টি ছাড়াও তিনি সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব পালন করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে লেখার জগতে সমকালীন সময়ে অদ্বিতীয় ছিলেন। বিদ্যাসাগরের অনুবাদমূলক গ্রন্থের মধ্যে কাগজে মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থ হলো ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। এই বইটি হিন্দি ভাষার কবি লাল্লুজি ‘বৈতাল পচ্চীসী’ নামে রচনা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর এটি বাংলায় অনুবাদ করে নাম রাখেন ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। এটি বাংলা ভাষার প্রথম কাহিনিধর্মী গদ্যগ্রন্থ। এই বইটির দশম সংস্করণে বিদ্যাসাগর প্রথম যতিচিহ্নের সফল ব্যবহার করেন। ইতোঃপূর্বে বাংলা ভাষায় যতিচিহ্নের ব্যবহার ছিল না। তবে এক দাড়ি বা দুই দাড়ি পূর্বে ব্যবহার হতো। বিদ্যাসাগর দুই দাড়ির ব্যবহার তুলে দিলেন এবং ইংরেজি ভাষার যতিচিহ্ন বাংলা ভাষায় প্রয়োগ করে বাংলা গদ্য ভাষায় বিশেষ শৃঙ্খলা নিয়ে আসেন। বিদ্যাসাগরের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো- ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘শকুন্তলা’, ‘কথামালা’, ‘চরিতাবলি’, ‘ব্রজবিলাস’, ‘সীতার বনবাস’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’, ‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’, ‘ রত্নপরীক্ষা’-এ গুলো তার রচিত ও সম্পাদিত বই। তাছাড়া বন্ধুর বালিকা কন্যা প্রভাবতীর মৃত্যু উপলক্ষ্য করে তিনি ‘প্রভাবতী সম্ভাষন’ নামে একটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাছাড়া তিনি কয়েকটি মৌলিক প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। এ গুলো হলো- ‘সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বিধবাবিবাহ চলিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’। এ সমস্ত গ্রন্থে বিদ্যাসাগর যেমন যুক্ত-তর্কসহ নিজের মতামত তুলে ধরেছেন, তেমনই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি সাধন করেছেন।

বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের ভাষাকে সাহিত্যের উপযোগী করেছেন এবং ভাষার মধ্যে গতিশীলতা নিয়ে এসেছেন। তিনি বাংলাগদ্যকে নতুন আঙ্গিক ও কাঠামোতে বিন্যাস করে সাজিয়েছেন। গদ্যের মধ্যে প্রবাদ-প্রবচনের সুষ্টু ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষার অন্তরশক্তিকে বৃদ্ধি করেছেন। ভাষার মধ্যে কমা, কোলন, সেমিকোলন, দাঁড়ি, জিজ্ঞাসাবোধক চিহ্ন, উদ্ধৃতিচিহ্ন, বিষ্ময়চিহ্ন প্রভৃতি যতিচিহ্নর সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এতে করে পাঠকেরা কোথায় কতটুকু বা কি পরিমাণে থামতে হবে সেটি বুঝতে পারবে। ফলে বাংলা ভাষা আরো গতিশীল ও প্রাণবন্ত হয়েছে। ভাষাকে আমরা ব্যবহার করে কোন না কোন অর্থ প্রকাশ করে থাকি। অর্থ ছাড়া বাক্যের কোন তাৎপর্য থাকে না। যতিচিহ্নের সফল প্রয়োগে বাক্যের অর্থের সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান অতুলনীয়। তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ প্রকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বাক্য গঠন করেন। কখনো বাক্যকে সম্প্রসারণ করেন, আবার কখনো সংকুচিত করেন। সব ক্ষেত্রেই লক্ষ্য রাখেন ভাষার গতিশীলতা ও অর্থের বিকাশের বিষয়টি। বক্তার মনের ভাব অনুসারে তিনি বাক্য ছোট বা বড় করেন এবং কখনো কখনো উপবাক্য গঠন করেন। ফলে সফলভাবে বাক্য গঠিত হয় এবং স্পষ্ট অর্থ প্রকাশ করে এবং বাক্যও রসালো হয়। বাংলা গদ্য ভাষা বিকাশে তার প্রচেষ্টা অনেক। প্রাথমিক পর্যায়ের বাংলা গদ্যের অস্থিরতাকে দূর করে স্থিরতা নিয়ে আসেন। তিনি সাধু ভাষায় বাংলা গদ্যরীতিকে পূর্ণাঙ্গতা দান করেন। তিনি নিজস্ব ভাষিক কৌশলে বাংলা গদ্যভাষাকে জড়তা ও দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। বাংলা গদ্যের মধ্য্যে যে সুরবিন্যাস ও ধ্বনিঝংকার থাকতে পারে সেটা বিদ্যাসাগরই প্রথম আবিষ্কার করেছেন। আসলে বাংলাগদ্যের সুবিন্যস্ত ও যথার্থ প্রয়োগের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে ‘বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে এবং তাঁর প্রবর্তিত ভাষারীতিকে ‘বিদ্যাসাগরীয় রীতি’ বলা হয়ে থাকে।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যভাষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনিই প্রথম বাংলা গদ্য ভাষায় বিরামচিহ্নের প্রচলন করেছেন। এতে বাক্যে অর্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে সব বাধা দূর হয়েছে। বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে সুন্দর যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে এ ভাষারীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বিদ্যাসাগর প্রথম পর্যায়ে বাংলা গদ্যভাষাকে আড়ষ্ঠতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। গদ্য ভাষার মধ্যে যে সজীব প্রাণশক্তি রয়েছে এটি বিদ্যাসাগরই প্রথম আবিস্কার করেন। সুতরাং বিষয়টির সার্বিক বিবেচনা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায় যে, বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী এবং তিনিই বাংলা গদ্যের জনকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। এক কথায় বাংলা গদ্যভাষা বিকাশে তার অবদান অপরিসীম।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।