মর্সিয়া সাহিত্য সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা কর। অথবা, (প্রবন্ধ/সংক্ষিপ্ত পরিচয়/নাতিদীর্ঘ রচনা শোককাব্য)
মর্সিয়া সাহিত্য মধ্যযুগের বাংলা কাব্যসাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। সুখ-দুঃখ নিয়েই মানব সংসার। সাহিত্য জীবনের দর্পণ। আর তাই মানবজীবনের সব কিছুই এতে প্রতিফলিত হয়। কোন বৃহৎ দুঃখময় ঘটনা নিয়ে সাধারণত মর্সিয়া সাহিত্য সৃষ্টি হয়। প্রশ্নানুসারে নিম্নে মর্সিয়া সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা/ একটি নিবন্ধ রচনা করা হলো-
‘মর্সিয়া’ আরবি শব্দ। অর্থ শোক প্রকাশ করা, দুঃখ প্রকাশ করা। শোকজাতীয় কাব্যকে তাই মর্সিয়া সাহিত্য বলা হয়। আরবি সাহিত্যের প্রভাবে ফারসি ভাষায় মর্সিয়া সাহিত্য রচিত হয়। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ভাবধারা হলো মর্সিয়া সাহিত্য। মুহম্মদ খান, দৌলত উজির বাহরাম খান, হায়াৎ মামুদ, হামিদ, জাফর প্রমুখ মর্সিয়া সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি। তাছাড়া আধুনিক যুগে মীর মশাররফ হোসেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন; এটি মর্সিয়া সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত বলে অনেকে মনে করেন। নিম্নে মর্সিয়া সাহিত্যের প্রধান প্রধান কবিদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
শেখ ফয়জুল্লাহ : বাংলা মর্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও শেখ ফয়জুল্লাহকে এ কাব্যধারার আদি কবি বলা হয়। তিনি ‘জয়নবের চৌতিশা’ নামে একটি কাব্য রচনা করেছেন। কারবালার একটি ছোট ঘটনাকে অবলম্বন করে ক্ষুদ্র কলেবরে এ কাব্য রচিত হয়েছে। শেখ ফয়জুল্লাহ এর আবির্ভাব ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্ধে বলে মনে করা হয়। তিনি একজন প্রতিভাবান কবি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ‘আমির হামজা’ ও ‘জঙ্গনামা’ কাব্যও রচনা করেন।
দৌলত উজির বাহরাম খান : তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে বলে জানা যায়। ‘লায়লী মজনু’ দৌলত উজির বাহরাম খানের শ্রেষ্ঠ রচনা। ঐতিহাসিক কারবালার কাহিনি নিয়ে তাঁর অপর বিখ্যাত কাব্য ‘জঙ্গনামা’ বা ‘মুক্তল হোসেন ’ রচিত হয়েছে। এটি তাঁর প্রথম রচনা।
মুহম্মদ খান : তিনি ‘মুক্তল হোসেন’ কাব্য রচনা করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। এ কাব্যটি ফারসি ‘মুক্তল হোসেন’ কাব্যে থেকে ভাবানুবাদ। এতে তাঁর নিজস্ব ভাবধারা ও চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে এ কাব্যগ্রন্থটি রচিত হয়। তিনি সতের শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন বলে মনে করা হয়।
সেবরাজ : মর্সিয়া সাহিত্যের অন্যতম কবি সেবরাজ। তাঁর জন্ম ত্রিপুরা জেলায় বলে অনেকে মনে করেন। মহররমের একটি ক্ষুদ্র বিবরণীকে অবলম্বন করে আঠার শতকের দিকে তিনি ‘কাশিমের লড়াই’ নামে একটি শোককাব্য রচনা করেন। এতে কারবালার বিষাদময় ঘটনা স্থান পেয়েছে। এছাড়া তিনি ‘মল্লিকার হাজার সওয়াল’ ও ‘ফাতিমার সুরতনামা’ নামে দুটি কাব্য রচনা করেন।
হায়াৎ মামুদ : তিনি আঠার শতকের একজন বিখ্যাত কবি। তিনি রংপুর জেলার ঝাড়বিশিলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ‘জঙ্গনামা’ তাঁর প্রথম রচনা। ফারসি কাব্যের অনুসরণে এ কাব্য রচিত হয়েছে। হায়াৎ মামুদ সতের শতকের শেষে জন্মগ্রহণ করেন এবং আঠার শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। তাঁর অনান্য কাব্য হলো-‘চিত্তউত্থান’, ‘কামাল নসিহত’, ‘ফকির বিলাস’, ‘হিতজ্ঞানবাণী’ ও ‘আম্বিয়া বাণী’ প্রভৃতি ।
জাফর : জাফর নামক একজন অজ্ঞাত ব্যক্তি ‘শহীদ-ই কারবালা’ ও ‘সখিনার বিলাপ’ নামে দুটি কাব্য রচনা করেছিলেন।এতে কবির স্বাভাবিক কবিপ্রতিভার বিকাশ ঘটেছে। কারবালার বিষাদময় ঘটনা অবলম্বনে অনেক কবিই মধ্যযুগে কাব্য রচনা করেছেন। কবি জাফর একই ঘটনা নিয়ে দুটি কাব্য রচনা করেছেন। এ দুটি কাব্য পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। কাব্যগুলোর রচনাকাল সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের সময়ে এ কাব্য রচিত হয়ে থাকতে পারে বলে কোন কোন গবেষক মনে করেন। অষ্টাদশ শতকের আরও একজন কবি ছিলেন, তাঁর নাম হামিদ। ‘সংগ্রাম হুসন’ নামে তিনি একটি কাব্য রচনা করেন। মুঘল আমলে আরও অনেক মর্সিয়া কাব্য রচিত হয়েছিল।
ইংরেজ আমলে বাংলা সাহিত্যে মর্সিয়া কাব্যের একটি বিশেষধারা অনুসৃত হয়। ফকির গরীবুল্লাহ ‘জঙ্গনামা’ কাব্য রচনা করেন। পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় এ কাব্যটি রচিত। তাঁর অনান্য কাব্যের নাম হলো- ‘সোনাভান’, ‘আমীর হামজা’, ‘ইউসুফ জোলেখা’, ‘সত্যপীর’ প্রভৃতি। মর্সিয়া কাব্য ধারায় রাধারমণ গোপ নামে একজন হিন্দু কবির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তিনি ‘ইমামগণের কেচ্ছা’ ও ‘আফৎ নামা’ নামে দুটি কাব্য রচনা করেন। এগুলো অষ্টাদশ শতকে রচিত হয়েছিল বলে ড. সুকুমার সেন মনে করেন।
মর্সিয়া সাহিত্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। এ ধারায় কাব্য রচনা করে অনেক কবি খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁরা নিজেদের প্রতিভাগুণে কাব্যিকশৈলিতে অনন্য অবদান রেখেছেন। কাব্যগুলোর মধ্যে সমসাময়িক সমাজজীবনের চিত্র কবিরা অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। এতে প্রধানত পূর্ববঙ্গীয় মুসলমানদের চিত্র লক্ষিত হয়। মর্সিয়া সাহিত্য রচনার অন্যতম পটভূমি হলো কারবালার ঘটনা। এই কারবালার ঘটনাকে অবলম্বন করে কম-বেশি প্রায় সব কবি-সাহিত্যিক মর্সিয়া সাহিত্য রচনা করেছেন; যেমন দৌলত উজির বাহরাম খান, শেখ ফয়জুল্লাহ, মুহম্মদ খান, হায়াৎ মামুদ, আব্দুল আলিম, নজর আলী, আমান উল্লাহ, নসরুল্লাহ খন্দকার প্রমুখ। কবিগণ এ সব কাব্যে চরিত্রচিত্রণের দক্ষতা দেখিয়েছেন, বর্ণনাভঙ্গিতে তারা কুশলতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এ সব রচনা আজও পাঠকহৃদয়কে আন্দোলিত করে। এ সব মর্সিয়া সাহিত্য শুধু বাংলা সাহিত্যে নয়, সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে বিরল।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।