বিসর্জন নাটকের নায়ক কে, রঘুপতি না জয়সিংহ ? আলোচনা কর।
বিসর্জন নাটকের নায়ক
বিসর্জন (১৮৯০) নাটকটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) বহুমুখী প্রতিভার অনন্য সাক্ষর। আচারসর্বস্ব ধর্মের সঙ্গে মানব ধর্মের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি এবং শেষ পর্যন্ত মানব ধর্মের জয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন এ নাটকে। এ নাট্যসাহিত্যে বেশকিছু চরিত্র রয়েছে। তন্মধ্যে রঘুপতি ও জয়সিংহ অন্যতম। এ দুটি চরিত্রের মধ্যে নায়কোচিত গুণ রয়েছে। তাই কোন চরিত্রকে নায়কের মর্যাদা দেওয়া হবে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিষয়টি নিম্নে প্রশ্নের চাাহিদা অনুসারে আলোচনা করা হলো:
নাটকের কাাহিনিতে দেখা যায়-রাণী গুণবতী নিঃসন্তান, তাই সন্তান কামনায় সে শত শত প্রাণ বলি দিতে প্রস্তুত। অপর্ণার সন্তানতুল্য ছাগশিশু বলি দিলে সে রাজার নিকট অভিযোগ করলে রাজা মন্দিরে বলিদান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে মন্দিরপুরোহিত রঘুপতি ক্রোধে জ্বলে ওঠে। রঘুপতি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে। শুরু হয় প্রথাধর্মের ধারকবাহক রঘুপতির সাথে মানবধর্মের ধারকবাহক গোাবিন্দ্যমাানিক্যের দ্বন্দ্ব । রঘুপতি প্রজাদের রাজার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়, যুবরাজ নক্ষত্ররায়কে সিংহাসনের লোভে রাজহত্যায় প্ররোাচিত করে। পুত্রতুল্য শিষ্য জয়সিংহকে বোঝায়-‘রাজরক্ত চাই দেবীর আদেশ’। রঘুপতি জয়সিংহকে দেবীর পা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করায়-‘আামি এনে দেব রাজরক্ত শ্রাবণের শেষ রাতে দেবীর চরণে’। রঘুপতি প্রতারণা করে পাথরের তৈরি মূর্তির মুখ ঘুরিয়ে রাখে; এতে ধর্মভীরু মানুষের মনে ভীতির সৃষ্টি হয়। রঘুপতির এ ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে রাজা তাকে আট বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে। এতে রঘুপতির অন্তরের হিংসা দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
‘বিসর্জন’ নাটকে সমস্ত চরিত্রকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে রয়েছে-রঘুপতি, রাণী গুণবতী ও যুবরাজ নক্ষত্ররায়। অপরভাগে রয়েছে রাজা গোাবিন্দ্যমাানিক্য ও অপর্ণা । পালকপুত্র জয়সিংহ আত্মদ্বন্দ্বে দ্বিধাান্বিত। নাটকের মূল দ্বন্দ্ব চিরাচরিত ধর্মীয় কুসংস্কার আর নিত্য নতুন মানবধর্মের সাথে। হিংসার সাথে অহিংসার। আর এর মাঝখানে রয়েছে জয়সিংহ চরিত্র। জয়সিংহ রঘুপতির পালকপুত্র। তাছাড়া রঘুপতি তার ধর্মীয় গুরুও । তাই পালকপিতা ও ধর্মীয় গুরু রঘুপতির প্রতি রয়েছে জয়সিংহের পর্বতপ্রমাণ বিশ্বাস। জয়সিংহ চরিত্রে সব ধরনের মানবীয় গুণের সমাবেশ ঘটেছে। সে হৃদয়বান, কবি, দার্শনিক, প্রেমিক পুরুষ-এ রকম আরও কত কী? নায়িকা চরিত্র অর্পণার আহবানে জয়সিংহ চরিত্রে প্রেমর তরঙ্গ বইছে। পাথরের তেরি দেবী না মানবী অর্পণা? এ প্রশ্নে জয়সিংহ দ্বিধাযুক্ত। একদিকে হৃদয়ধর্ম প্রেম, অন্যদিকে শাস্ত্রধর্ম গুরুভক্তি। একদিকে রঘুপতির সাথে বন্ধন, অন্যদিকে অর্পণার আকর্ষন, উভয়ই তার কাছে শক্তিশালী। প্রবল দ্বন্দ্বে তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। তবে সবশেষে জয়সিংহ রঘুপতির ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে রাজাকে রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আবার অন্য দিকে গুরুর রাজরক্ত চাই। তাই জয়সিংহের হৃদয়ে ওঠে অশান্ত ঢেউ। তার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়-ধর্মের বাহ্য অনুষ্ঠান না মানবের হৃদয় ধর্ম সত্য ? রঘুপতি না অপর্ণা ? শেষ পর্যন্ত মানবধর্মই তার কাছে প্রাধান্য পেল, তবে দীর্ঘদিনের জঞ্জাল সরাতে বৃহৎ ত্যাগের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, রঘুপতিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অবশেষে বুকের রক্ত ঢেলে দিল। প্রথা ধর্মের হল অবসান, মানবধর্মের হল জয়। জয়সিংহের অন্তদ্বর্ন্দ্বের কারণে নাটকটি নাটক হয়ে উঠেছে। তবুও জয়সিংহকে আমরা নায়ক বলতে পারি না। সে দর্শক-শ্রোতাদের নয়নের মণি, তার বেদনায় আমরাও বেদনার্ত হই, কিন্তু জয়সিংহ এ নাটকের নায়ক নয়।
রঘুপতিই এ নাটকের নায়ক। রঘুপতি চরিত্রকে ঘিরেই নাটকের সকল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে। রঘুপতি চরিত্র নিজের অহংকার ধরে রাখার জন্য সব ধরনের কাজই করতে প্রস্তুত। তার স্বার্থ ও ক্ষমতা রক্ষার জন্য রাণী গুণবতীর সন্তান কামনাকে কাজে লাাগিয়েছে। রাজার ছোট ভাইকে রাজার বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছে। রঘুপতি ক্ষিপ্ত হয়, রাজহত্যা ও ভ্রাতৃহত্যায় প্ররোাচিত করে। রাজা-রাণীর দাম্পত্যজীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। জয়সিংহ-অর্পণার প্রেমের পথে বাঁধা দিয়েছে। দেবীর কণ্ঠ নকল করেছে। প্রতিমার মুখ ফিরিয়ে দিয়ে জনগণকে রাজার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। ধ্রুব হত্যায় হাত বাড়িয়েছে। শেষপর্যন্ত আপন পুত্রতুল্য শিষ্য জয়সিংহের বুকের রক্তে স্নান করেছে। সবশেষে রঘুপতি সন্তান হারানোর বেদনায় হাহাকার করেছে। পাথরের প্রতীমাকে জলে নিক্ষেপ করে রঘুপতি অপর্ণার হাত ধরে মন্দির ছেড়ে চলে যায় মাটির ঘরে। রাণী গুণবতী ফিরে পায় তার প্রাণের দেবতাকে, নেমে আসে মানবপ্রেম, দাম্পত্যপ্রেম। প্রথাধর্ম চূর্ণ হয়ে সবার হৃদয়ে প্রবাাহিত হয় মানবপ্রেমের বন্যা। তাই দেখা যায় যে, নাটকের সমস্ত কাহিনি রঘুপতি চরিত্রকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তাই রঘুপতি চরিত্রই এ নাটকের নায়কের আসনের উপযুক্ত।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে দেখা যায় যে, রঘুপতি ও জয়সিংহ দুটো চরিত্রই এ নাটকে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায় যে, তুলনামূলকভাবে রঘুপতি চরিত্রে সাফারিং বেশি। তাই রঘুপতি চরিত্রই এ নাটকের নায়ক চরিত্র। নাট্যকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ চরিত্রটিকে অমর করে তুলেছেন।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।