কৃষ্ণকুমারী নাটক অবলম্বনে অতি প্রাকৃতের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা কর।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) বাংলা সাহিত্যের প্রথম নাট্যকার। নাটক রচনায় তিনি বেশ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। পাশ্চাত্য ও ভারতীয় উপাদানের সমন্বয়ে তিনি কিছু অসাধারণ নাটক রচনা করেছেন। এ সব নাটকের মধ্যে কৃষ্ণকুমারী একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাটক। এই নাটকে অতি প্রাকৃতের ব্যবহার রয়েছে যা নাটকের কাহিনিতে গতি সৃষ্টি করেছে। কৃষ্ণকুমারী নাটক অবলম্বনে অতি প্রাকৃতের ব্যবহারনিম্নে আলোচনা করা হলো-
মাইকেল মধুসূদন দত্ত বড় শিল্পপ্রতিভা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আগমন করেন। মহাকাব্য ও নাটক-এই দুটি বিষয়ে তিনি অসাধারণ শিল্পসক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি আধুনিক নাটকের পথিকৃৎ। কিছু অসাধারণ নাটক আমরা মাইকেল মধুসূদনের হাতে পেয়েছি। এ গুলো শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী, কৃষ্ণকুমারী। কৃষ্ণকুমারী বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রথম ট্ট্যাজেডি নাটক। এ নাটকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম অতি প্রাকৃতের সফল ব্যবহার দেখিয়েছেন। অতি প্রাকৃত বলতে সাধারণ অসম্ভব বা অস্বাভাবিক কোন ঘটনাকে বোঝায়। অস্বাভাবিক ঘটনার প্রতি মানুষের চিরন্তন আকর্ষন রয়েছে। বাংলা সাহিত্যেও কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ বিভিন্ন শাখায় অতি প্রাকৃতের ব্যবহার রয়েছে। এমনকি বিদেশি সাহিত্য বিকশেষত শেক্সপিয়ারের নাটকে এই অতি প্রাকৃতের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইউরোপীয় সভ্যতা ও ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তাই সঙ্গত কারণেই তিনি বাংলা নাটকেও এই অতি প্রাকৃতের ব্যবহার দেখালেন।
কৃষ্ণকুমারী নাটকের
কৃষ্ণকুমারী নাটকের বিভিন্ন অঙ্কে ও চরিত্রে এ অতি প্রাকৃত ঘটনার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। পদ্মিনী দেবী নামে একটি ছোট্ট চরিত্র এ নাটকে দেখা যায়। সরাসরি এই চরিত্র এ নাটকে উপস্থিত নেই। কিন্তু অতি প্রাকৃত ঘটনা-প্রবাহের সঙ্গে এর সংযোগ রয়েছে। কোন এক সময় কৃষ্ণার বিয়ে প্রসঙ্গ উত্থাপন হয়; তখন কৃষ্ণার মাতা অহল্যা দেবী কৃষ্ণার বাবাকে তার পূর্বপুরুষ ভীমসেনের প্রণয়িনী পদ্মিনী দেবীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়; এই ঘটনার মধ্য দিয়ে অতি প্রাকৃতের শুরু।
নাটকের তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে কৃষ্ণকুমারী কোন এক সময়ে হঠাৎ আকাশে কোমল বাদ্য শুনে অবাক হয়ে যায়। এরপর একটি স্বপ্ন এ নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নায়িকা চরিত্র কৃষ্ণকুমারী একদিন রাতে স্বপ্নে পদ্মিনী দেবীকে দেখতে পায়। পদ্মিনী দেবী কৃষ্ণকুমারীকে উদ্দেশ্য করে উপদেশের সুরে বলতে থাকে যে-‘যে যুবতী এ বিপুল কুলের মান আপনার প্রাণ দিয়া রাখে, সুরপুরে তার আদরের সীমা নাই।’ তারপর পদ্মিনী দেবী কৃষ্ণকুমারীকে আরো জানিয়েছে যে, সে এই বংশের বধূ ছিল। তার জীবনেও এ রকম সংকট এসেছে। তখন সে কুলের মান রক্ষার জন্য আপনার প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। এবং পরজগতে সে সুখেই আছে। তাছাড়া পদ্মিনী দেবী কৃষ্ণকুমারীকে তার পথ অনুসরণের পরামর্শ দেয়। পদ্মিনী বলছে-‘তুমি যদি আমার মত কর্ম কর তা হলে আমারই মত যশস্বিনী হবে।’ এভাবে পদ্মিনী দেবী ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে নায়িকা কৃষ্ণকুমারীকে আত্মবিসর্জনের জন্য পরোচিত করে।
কৃষ্ণার সখি তপস্বিনী এ নাটকের একটি অন্যতম চরিত্র। কৃষ্ণার সঙ্গে সে বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়াতো। কোন এক রাতে তপস্বিনী স্বপ্ন দেখে যে, কেউ কৃষ্ণাকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। গোসাইজি একলব্যের মন্দিরে দেবতাদের চোখ দিয়ে জল পড়তে দেখেছে; রাজভবন থেকে রক্তপ্রবাহ নির্গত হতে দেখেছে এবং এ সব ঘটনা গোসাইজি তার শিষ্যদের কাছে প্রকাশ করেছে। এইভাবে দেখা যায়, কৃষ্ণার স্বপ্ন দেখা, তপস্বিনীর কুস্বপ্ন, গোসাইজির দেবতাদের চোখ দিয়ে জল পড়তে দেখা-এগুলো ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের অতি প্রাকৃতের ব্যবহারের সফল প্রয়োগ। নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত অত্যন্ত শিল্পসফলভাবে এ রকম কিছু অতি প্রাকৃতের ব্যবহার এ নাটকে উপস্থাপন করেছেন।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে অতি প্রাকৃতের শিল্পসফল প্রয়োগ দেখিয়েছেন। কৃষ্ণকুমারী এ নাটকের কেন্দ্রিয় নারী চরিত্র।এই চরিত্রটি স্বপ্নে যে ঘটনা দেখেছে, সেটি তার মানসিক ও চিন্তার জগতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে, এবং নাটকের ট্ট্যাজিক পরিসমাপ্তি ঘটাতে সহায়তা করেছে। নাটকে অতি প্রাকৃতের এই উপাদানটি মাইকেল মধুসূদন দত্ত পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকে গ্রহণ করে বাংলা-নাট্য সাহিত্য সমৃদ্ধ করেছেন।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।