বাংলা ভাষায় বৈদেশিক প্রভাব এর স্বরূপ বিচার কর। 211003

ভাষায় বৈদেশিক প্রভাব
বাংলা ভাষায় বৈদেশিক প্রভাব এর স্বরূপ বিচার কর।

ভাষায় বৈদেশিক প্রভাবের ক্ষেত্রে ব্যাকরণগত প্রভাব অপেক্ষা শব্দ ঋণ ও আত্তীকরণের প্রবণতাই বেশি। বহু বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষায় এমনভাবে মিশে গেছে যাদের আর বিদেশি বলা চলে না। চেয়ার, টেবিল, উকিল দরবেশ, চশমা, গজল ইত্যাদি। মোটামুটি যেসব বৈদেশিক ভাষার প্রভাবে বাংলা ভাষার শব্দও কখনো কখনো ব্যাকরণ প্রভাবিত হয়েছে তা মোটামুটি নিম্নরূপ-

১.ফারসি প্রভাব ২. পর্তুগিজ প্রভাব ৩. ওলন্দাজ প্রভাব ৪. ফরাসি প্রভাব ৫. ইংরেজি প্রভাব।

ফারসি প্রভাব :
খ্রিস্টীয় এয়োদশ শতকের প্রারম্ভে ইসলাম ধর্মালম্বী তুর্কিগণ পশ্চিমবঙ্গ অধিকার করে। একশত বছরের মধ্যে সমস্ত বঙ্গদেশে মুসলমান অধিকার বিস্তৃত হয়। সম্রাট আকবরের আমলে বাংলাদেশ মোগল সাম্রাজের অন্তর্ভূক্ত হয়। এ সময় রাজ সরকারের ভাষা ফারসি ছিল। লর্ড বেন্টিঙ্ক আমল পর্যন্ত বাংলা ভাষার ওপর ফারসির প্রভূৃত প্রভাব ছিল। বাংলা ভাষায় ফারসি প্রভাব দু’দিকে থেকে-

ক) শব্দের দিক থেকে                                              খ) ব্যাকরণের দিক থেকে।

শব্দের দিক থেকে ফারসি প্রভাব : ফারসি হতে বাংলায় গৃহীত শব্দগুলোকে সাত ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- রাজ্য, যুদ্ধবিগ্রহ প্রভৃতি সন্বন্ধীয় শব্দ : বাদশাহ, নবাব, বেগম, ফৌজ, তীর, তোপ, তখত, জমিদার, হুজুর, রসদ ইত্যাদি।

আইন-আদালত সংক্রান্ত শব্দ : নালিশ, মোকদ্দমা, তামাদি, মেয়াদ, আইন, কানুন আদালত, মুন্সেফ, হাকিম, ইত্যাদি।

ধর্ম সন্বন্ধীয় শব্দ : খোদা, নামাজ, রোজা, হজ, কোরবানি, জবাই, ফকির, দরবেশ মোল¬া, মৌলবী, হারাম, জাহান্নম ইত্যাদি।

শিক্ষা সন্বন্ধীয় শব্দ : কাগজ, কলম, কেতাব, খাতা, নকল, তরজমা, হরফ, আলেম, আদাব, কেচ্ছা, গজল ইত্যাদি।

সভ্যতার উপকরণ সন্বন্ধীয় শব্দ : আতর, গোলাপ, বরফ, কোরমা, কোপ্তা, কালিয়া, পোলাও, চশমা, জামা, রুমাল ইত্যাদি।

জাতি ও ব্যাবসাবাচক শব্দ : হিন্দি, ইহুদি, ফিরিঙ্গি, দরজি, দোকানদার, কারিগর, যাদুকর, সহিস, খানসামা ইত্যাদি।

সাধারণ দ্রব্য সন্বন্ধীয় শব্দ : আওয়াজ, হাওয়া, ওজন, কমবেশি, খবর, কোমর, জাহাজ, দরকার, পেশা, সবুজ ইত্যাদি।

ব্যাকরণের দিক থেকে বাংলা ভাষায় ফারসির প্রভাব :

১. বাংলায় নর পায়রা, মাদী পায়রা, মদ্দা কুকুর, মাদী কুকুর রূপে লিঙ্গ নির্দেশ ফারসি প্রভাবের পরিচায়ক।
২. তদ্ধিত প্রত্যয়ে: ই-বিলাতি, দেশি, জাপানি
দার, দারী দোকানদার, দোকানদারী, পোদ্দার, পোদ্দারী, তহসিলদার, তহসিলদারী
দান, দানী ফুলদানী, পিকদান, আতরদানী, সুরমাদানী, বাকদান
খোর গুলিখোর, তামাকখোর, গাঁজাখোর
বাজ মোকদ্দমাবাজ, ফন্দিবাজ
গিরি কেরানীগিরি, বাবুগিরি, কুলিগিরি
ইত্যাদি বিভক্তিগুলো ফারসি হতে গৃহীত।

পর্তুগিজ প্রভাব : ইংরেজ আগমনের পূর্বে বঙ্গদেশে পর্তুগিজ প্রভাব এত বেশি ছিল যে, এদেশের অনেকে পর্তুগিজ ভাষায় কথাবার্তা বলতে পারতো। বর্তমানে বাংলা ভাষায় শতাধিক পর্তুগিজ শব্দ আছে। দৈনন্দিন ব্যবহারে অনেক পর্তুগিজ শব্দকে এখন আর পর্তুগিজ বলে মনে হয় না, তাদের বাংলা বলেই মনে হয়। যেমন : আনারস, আলপিন, ইস্পাত, কামরা, গুদাম, চাবি, জানালা, নীলাম, পাউরুটি, পিতা, সুতি।

ওলন্দাজ প্রভাব : বাংলা ভাষা ও শব্দের ওপর ওলন্দাজ প্রভাব খুব ব্যাপক নয়। তবুও বেশ কিছু শব্দ বাংলায় এসেছে-যেমন:- হরতন, রুইতন, ইস্কাপন।

ফারাসি প্রভাব : ফরাসি থেকে কিছু শব্দ বাংলায় এসেছে। যেমন :- ওলন্দাজ, দিনেমার, ইংরেজ। ইংরেজি নয় অথচ ইংরেজি থেকে পাওয়া ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার নানা ভাষার শব্দ প্রথমে ইংরেজিতে গৃহীত হয়ে পরে ইংরেজি শব্দ রূপে বাংলায় প্রবেশ করেছে। যেমন :- জেব্রা, ক্যাঙ্গারু, রিকশা, সাগু।

ইংরেজি প্রভাব : দু’শ’ বছর ইংরেজ রাজত্ব করার কারণে কেবল শব্দকোষের ওপরই নয়, বাংলা প্রয়োগ রীতির উপরেও ক্রমবর্ধমান ইংরেজি প্রভাব লক্ষণীয়। ইংরেজি শব্দ বাংলা ভাষাভাষীরা নানাভাবে আত্তীকরণ করেছে। যেমন- সরাসরি, ইষৎ পরিবর্তিত, অনুবাদ, উপসর্গরূপে প্রভৃতি। যেমন :- কফি, চেয়ার, টিকিট, মেল, শার্ট ইত্যাদি।

কোন ভাষার শব্দভান্ডারে নতুন নতুন শব্দ সংযোজন প্রাণের লক্ষণ। বাংলা ভাষার যে বিদেশি প্রভাব-প্রবল ও প্রাণবন্তের ফলে ভাষা সম্পদকে বৃদ্ধি করেছে। বাংলা ভাষা নদীর স্রোতের মত দু’দিক হতে শব্দসমূহকে কুড়িয়ে নিয়ে ছুটে চলেছে এবং ক্রমান্বয়ে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে নিজেকে |

ভাষায় বৈদেশিক প্রভাব

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *