বাংলা ভাষার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ বিষয়ে একটি নিবন্ধ রচনা কর। 211003

অপপ্রয়োগ

বাংলা ভাষার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ বিষয়ে একটি নিবন্ধ রচনা কর। অথবা, অপপ্রয়োগের কারণ/ভুলের কারণ/কেন ঘটে)

লেখা ও মুদ্রণে বক্তব্য যথাযথভাবে ও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপনের জন্য চাই ভাষা-দক্ষতা। তা নির্ভর করে শব্দ ও বাক্যের নির্ভুল ও যথাযথ প্রয়োগের ওপর। এ দিক থেকে ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার শুদ্ধ প্রয়োগে দক্ষতা অর্জনের জন্য চাই উপযুক্ত ব্যাকরণ-জ্ঞান, চাই শব্দ ও বাক্যের অপপ্রয়োগ সম্পর্কে বিশেষ স্বচ্ছ ধারণা এবং ভুলগুলো নিরসনে সতর্কতা ও সচেতন প্রয়াস দরকার। মুদ্রণ ও লেখায় ভাষায় শুদ্ধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ত্রুটিগুলো হলো-

১.বানানে অশুদ্ধি : বানান ভুলের অন্যতম কারণ শব্দের অসতর্ক উচ্চারণ। আঞ্চলিক উচ্চারণের প্রভাব এবং শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ সম্পর্কে অসর্তকতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বানান ভুল হয়। এ ছাড়া বাংলা ভাষায় বানান ভুলের কারণের মধ্যে রয়েছে একই ধ্বনির একাধিক হরফ।

২.বাক্যে পদের অপপ্রয়োগ : শব্দের যথাযথ অর্থ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে অনেক সময় বাক্যে শব্দের অপপ্রয়োগ ঘটে। বিশেষ্য-বিশেষণ যথাযথভাবে বুঝতে করতে না পারলে বিশেষ্যের জায়গায় বিশেষণ ও বিশেষণ মনে করে বিশেষ্যের ভুল প্রয়োগ ঘটতে পারে। ‘আবশ্যকীয়’, ‘সৌজন্যতা’ ইত্যাদি শব্দের অপপ্রয়োগের উদাহরণ। শুদ্ধ প্রয়োগ হবে ‘আবশ্যক’ ও সৌজন্য’।

৩.বাক্যে পদবিন্যাসে ত্রুুটি : বাক্যে ইচ্ছামত পদবিন্যাস চলে না, এ ক্ষেত্রে ব্যাকরণের বিশেষ নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। গঠনের দিক থেকে বাংলা বাক্য মূলত কর্তা-কর্ম-ক্রিয়া-এই ধরণের হয়। যেমন : মিতা কবিতা পড়ে।

৪.সাধু ও চলিতের মিশ্রণজনিত ত্রুুটি : লেখায় ও মুদ্রণে সাধু ও চলিত-এই দুই রীতির যে কোন একটি রীতি বেছে নিতে হয়। সাধু ও চলিত ভাষারীতির মিশ্রণে ভাষা দূর্বল ও শিথিল হয়ে পড়ে বলে একই লেখায় এই দুই রীতির মিশ্রণ দূষণীয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই সাধু ও চলিত রীতির মিশ্রণ সতর্কভাবে পরিহার করা দরকার।

নিম্নে ভাষার ‘প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ’ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- (অপপ্রয়োগের কারণ/ভুলের কারণ/অপপ্রয়োগ কেন ঘটে)

ক. প্রত্যয়ের অপপ্রয়োগজনিত ভুল : প্রত্যয়ের অপপ্রয়োগের ফলে শব্দের বানানে ভুল হয়ে থাকে। যেমন : অপপ্রয়োগ : অধীনস্থ, আবশ্যকীয়, কনিষ্ঠতম; শুদ্ধ প্রয়োগ : অধীন, আবশ্যক, কনিষ্ঠ।

খ.সমাসঘটিত অপপ্রয়োগ : সমাসঘটিত কিছু শব্দে ভাষার অপপ্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়। যেমন : অপপ্রয়োগ : নিরপরাধী, নির্দোষী, নিরোগী; শুদ্ধ প্রয়োগ : নিরপরাধ, নির্দোষ, নিরোগ।

গ. বহুবচনের অপপ্রয়োগজনিত ভুল : অনেক সময় বিশেষণ পদ নির্ধারক বহবচনের কাজ করে। এ ক্ষেত্রে মূল শব্দটিকে বহু বচন করার দরকার হয় না। অপপ্রয়োগ : যাবতীয় প্রাণীবৃন্দ এই গ্রহের বাসিন্দা, শুদ্ধ প্রয়োগ : যাবতীয় প্রাণী এই গ্রহের বাসিন্দা।

ঘ. যথার্থ শব্দ প্রয়োগ না করায় ভুল : শব্দের যথাযথ অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় যথাযথ শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভুল হয়। যেমন : ‘অজ্ঞতা’ বোঝাতে ‘অজ্ঞানতা’ শব্দের অপপ্রয়োগ ঘটে। অপপ্রয়োগ : তিনি স্বস্ত্রীক ঢাকায় থাকেন, শুদ্ধ প্রয়োগ : তিনি সস্ত্রীক ঢাকায় থাকেন। (স্ত্রীসহ)

ঙ. বিশেষণ-দ্বিত্বজনিত ভুল : বিশেষণ শব্দের সঙ্গে পুনরায় বিভ্রান্তিজনিত বিশেষণবাচক উপসর্গ বা প্রত্যয়ের অপপ্রয়োগের ফলে কিছু কিছু ভুল শব্দ গঠিত হয়। যেমন : ‘চিত্রিত’ শব্দটি বিশেষণ, আবার ‘সচিত্র’ শব্দটিও বিশেষণ। দুটোকে মিলিয়ে অপপ্রয়োগ ঘটেছে। অপপ্রয়োগ : আকুলিত, উৎফুল্লিত, উদ্বেলিত; শুদ্ধ প্রয়োগ : আকুল, উৎফুল্ল, উদ্বেল।

চ. পুনরুক্তিজনিত অপপ্রয়োগ : একই অর্থবিশিষ্ট শব্দের পুনরুক্তি বা বাহুল্য ব্যাকরণের নিয়মে অশুদ্ধ বলে গণ্য হয়। তবে বাংলায় অনেক বিশিষ্ট লেখকের লেখায় এ ধরণের শিথিল প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যবহার করেছেন ‘অশ্রূজল’ শব্দটি। কিন্তু ‘অশ্রূ’ অর্থ চোখের জল। এ ক্ষেত্রে অশ্রূর সঙ্গে আবার জল যোগ করায় অপপ্রয়োগ ঘটে। অপপ্রয়োগ : আকণ্ঠ পর্যন্ত ভোজনে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, শুদ্ধ প্রয়োগ : আকণ্ঠ ভোজনে স্ব্াস্থ্যহানি ঘটে।

ছ. লিঙ্গজনিত অপপ্রয়োগ : বাংলা সাধু ভাষায় এবং কখনো কখনো তৎসম শব্দবহুল চলিত গদ্যরীতিতে স্ত্রীবাচক বিশেষণের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন সুন্দরী বালিকা, সুন্দরী বউ। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীবাচক শব্দের জন্যে স্ত্রীবাচক বিশেষণ ব্যবহার না করায় ভাষায় অপপ্রয়োগ ঘটে। অপপ্রয়োগ : বর্তমানে বিদ্বান মহিলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, শুদ্ধ প্রয়োগ : বর্তমানে বিদূষী মহিলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

জ. প্রবাদ-প্রবচনের অপপ্রয়োগ : প্রবাদ-প্রবচনের মর্মমূলে রয়েছে হাজার বছরের লোক অভিজ্ঞতা। তাই প্রবাদের পরিবর্তন কোনভাবেই কাম্য নয়। প্রবাদের বিকৃত প্রয়োগ অনেক সময় মূলের অর্থ বদলে দেয়, এবং প্রবাদ-প্রবচনের পরিবর্তনে ভাষার অপপ্রয়োগ ঘটে। অপপ্রয়োগ : যেমন বুনো কচু তেমনি বাঘা তেঁতুল, শুদ্ধ প্রয়োগ : যেমন বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল।

ঝ. সাধু ও চলিত রীতির মিশ্রণজনিত অপপ্রয়োগ : ভাষা প্রয়োগে কখনো চলিত ভাষারীতির সঙ্গে সাধু ভাষারীতি মেশানো উচিত নয়। এ বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার। এতে বাক্য গুরু-চ-ালী দোষে দুষ্ট হয় বলে ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অপপ্রয়োগ : লোপার কথা শুনিয়া লাবণী অবাক হয়ে গেল। শুদ্ধ প্রয়োগ : লোপার কথা শুনে লাবণী অবাক হয়ে গেল।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *