রূপসী বাংলা কাব্যে রুপকথার অনুষঙ্গ বিচার কর। (লোককথা/ঐতিহ্যচেতনা)
কল্পনা কবিতা নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কল্পনার সঙ্গে বান্তববোধ ও জীবনঘনিষ্ট আরও কিছু উপাদানের সমন্বয়ে ত্রিশের দশকের কবিরা কাব্যনির্মাণের একটি নতুন কাব্যান্দোলনে নিজেদেরকে মনোনিবেশ করলেন। এ কাবান্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। ‘বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকেই বলা চলে বাংলা আধুনিক কবিতার পথ চলা শুরু। যার সার্বিক সমৃদ্ধি ঘটেছে জীবনানান্দের হাতে।’ জীবনানন্দ দাশের কাব্যসম্ভারের মধ্যে ‘ঝরা পালক’(১৯২৮), ‘ধূসর পা-ুলিপি’ (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৯), রূপসী বাংলা (১৯৫৭), ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১) ইত্যাদি। এর মধ্যে রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কবি ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি, পুরাণের পাশাপাশি রুপকথার নানা অনুষঙ্গ এ কাব্যে উপস্থাপন করেছেন। নি¤েœ বিষয়টি আলোচনা করা করা হলো-
জীবনানন্দ দাশ ঐতিহ্যসচেতন কবি। তাঁর ঐতিহ্যসচেতনতার পরিচয় সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় রূপসী বাংলা কাব্য গ্রন্থে। বাঙালি সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে রয়েছে পুরাণকথার মায়া, লোককথা, রুপকথা, কীর্তন, উপকথা, পাঁচালী এ রকম আরও কত কী। কবি জীবনানন্দ দাশ এ সমস্ত কিংবদন্তির সঙ্গে মিলিয়ে বাঙালি জীবন দর্শনকে তাঁর ‘রুপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন একান্ত নিজস্ব শৈলিতে। ‘রুপসী বাংলা’ কাব্যের গভীরতর স্তরে রয়েছে প্রাচীন সাহিত্যের কিংবদন্তি পটভূমি। যে গুলোকে আমরা ‘রুপকথা’ নামে ডেকে থাকি। অর্ধ নারীশ্বরের বর্ণনায়, গৌড় বাংলার রাজন্যবর্গের কথায়, উমা-চন্দ্রশেখেরর প্রেমের গল্প উল্লেখে, বেহুলা, খুল্লনা, লহনা, কাঞ্চনমালা, শঙ্খমালা, রোহিণী, ইন্দ্র, অর্জুন, প্রভৃতি পৌরাণিক ব্যক্তিত্বের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ‘রুপসী বাংলা’ কাব্য এক অসাধারণ ঐতিহ্যসম্পৃক্ত কাব্য হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
‘রুপসী বাংলা’ কাব্যে কবি জীবনানন্দ দাশকে রুপকথাকে চিরন্তনের মর্যাদা দিয়ে কবিতায় অমর করে তুলেছেন। এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে কবির ইতিহাস-ঐতিহ্যচেতনা। তিনি সমকালের পেক্ষাপটে সেকালকে স্থাপন করে রুপকথাকে জীবন্ত করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন। চাঁদ সওদাগর, বেহুলার প্রেম, ভাসান মনসার বাৎসল্য প্রভৃত প্রসঙ্গ উপস্থাপন করে কবি রুপকথার অনুষঙ্গে ‘রুপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। এ গুলো এখনও পাঠকের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে। এখানে প্রাসঙ্গিক কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করা যেতে পারে-
বেহুলাও একদিন গাঙের জলে ভেলা নিয়ে,
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়
সোনালী ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বথ বট দেখেছিল হায়,
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়।
‘রুপসী বাংলা’ কাব্যের কবিতাগুলোতে রুপকথা-উপকথা, পুরাণ ও ইতিহাস কথার পারষ্পরর্য পূর্ণ অনুষঙ্গ প্রকৃতির রুপ ও রসকে আরও জীবন্ত করে তুলতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া বেহুলা, খুল্লনা, লহনা, ক্ঞ্চানমালা, শঙ্খমালা এ সব রুপকথার নায়িকাদের ভিড়ে সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিমের নায়িকা রোহিণীকেও জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘রুপসী বাংলা’ কাব্যে স্থান দিয়েছেন। আর এ সাথে ভৌগোলিক চেতনাও কবিতার সমৃদ্ধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রাসঙ্গিক কবিতার চরণ নিম্নরুপ :
পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;
এশিরিয়া ধূলো আজ-বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় রুপকথাকে সমকালীন করে তুলেছেন। রুপকথাকে কাব্যিক রুপ দেবার জন্য তিনি মহাভারত-রামায়ণসহ বিভিন্ন পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বিষয় ও ব্যক্তিকে কবিতা নির্মাণের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘সোনার খাঁচার বুকে’ নামক কবিতায় কবি মহাকবি আলাওলের শুক পাখির প্রসঙ্গ এনেছেন। রাজকন্যা চন্দ্রমালার গল্প উপস্থাপনের জন্য হীরামন পাখির প্রসঙ্গ অবতারণা করেছেন। এখানে প্রাসঙ্গিক কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করতে চাই-
চন্দ্রমালা রাজকন্যা, মুখ তুলে চেয়ে দ্যাখো-শুধাই , শুনো লো,
কি গল্প শুনিতে চাও তোমরা আমার কাছে, -কোন গান বলো,
আমার সোনার খাঁচা খুলে দাও, আমি যে বনের হীরামন;
সার্বিক বিশ্লেষণ : উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, কবি জীবনানন্দ দাশ একজন ইতিহাস মনস্ক কবি। তাঁর ঐতিহ্যসচেতনতা বাংলা কবিতার ধারায় অতুলনীয়। তিনি আবহমান বাংলার প্রাচীন নানা অনুষঙ্গ যেমন ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি, রুপকথা, উপকথা, লোককথা, পুরাণচরিত্রসহ বিভিন্ন রকমের ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও বিষয়ের সমন্বয়ে ‘রুপসী বাংলা’ কাব্যটিকে অসাধারণ করে নির্মাণ করেছেন। তবে সব কিছুকে ছাড়িয়ে রুপকথার নানা অনুষঙ্গ তিনি বিশেষ মুন্সিয়ানায় ‘রুপসী বাংলা’ কাব্যে তুলে ধরেছেন।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।