সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস আর্ন্তজাতিক হয়েও স্বাদেশিক’-মন্তব্যটির তাৎপর্য বিচার কর। 241001

.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস আর্ন্তজাতিক হয়েও স্বাদেশিক’-মন্তব্যটির তাৎপর্য বিচার করা হলো-

 

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উপন্যাসিকদের মধ্যে একজন প্রধান উপন্যাসিক। বাংলাদেশের উপন্যাসের কথা উঠলেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এর নামটি সবার আগে উঠে আসে। রাজনীতি, সমাজ ভাবনা, স্বদেশ, প্রেম ও সময়চেতনা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার তাঁর উপন্যাস সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সামাজিক দর্শন ও বাঙালি চেতনায় তাঁর উপন্যাস ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। অতি আধুনিক উপন্যাসের ধারার তাঁর রচনা সার্থকভাবে স্থান করে নিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলা উপন্যাসের ধারায় তিনি স্বতন্ত্র মাত্রা সংযুক্ত করেছেন। তাঁর উপন্যাস আর্ন্তজাতিক হয়েও স্বাদেশিক’ বিষয়টি নিচে আলোচনা করা হলো-

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এর উপন্যাসের সংখ্যা খুব নয়। তিনি মাত্র তিনটি উপন্যাস রচনা করেছেন। এ গুলো হলো ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে যে সব উপন্যাস আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তারমধ্যে ‘লালসালু’ প্রধান। এই উপন্যাসটি ১৯৪৮ সালে প্রকাশ হয়। প্রকাশের সাথে সাথে এই উপন্যাসটি পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদর লাভ করে। লেখক গ্রামীণ সমাজের পটভূমিকায় এই উপন্যাসটি রচনা করেছেন। উপন্যাসটি আয়তনে বেশ ছোট, চরিত্র সংখ্যাও বেশি নয়। কিন্তু অন্তর্নিহিত ভাবধারায় এটি একটি অসাধারণ উপন্যাস। মজিদ, রহীমা, জমিলা এই তিনটি চরিত্র এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। বিশেষত মজিদ চরিত্রটিকে ঘিরে উপন্যাসের কাহিনি সফল পরিণতির দিকে এগিয়েছে। তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস হলো ‘চাঁদের অমাবস্যা’। আরেফ আলী মাস্টার এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। লেখকের তৃতীয় ও সর্বশেষ উপন্যাস হলো ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। মুহম্মদ মোস্তফা ও খোদেজা এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

তিনটি উপন্যাসই আয়তনে ছোট। ভাষা সহজ-সরল, প্রাঞ্জল, পাঠক খুব সহজেই পড়ে বুঝতে পারে। বাংলাদেশের গ্রামীণ পটভূমিকে ভিত্তি করে এ তিনটি উপন্যাস রচিত হয়েছে। তিনটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে কোন না কোনভাবে অস্তিত্ববাদ চেতনা আরোপ করেছেন। এই দর্শনটি ঔপন্যাসিক ফ্রান্সের একজন দার্শনিক জ্যা পল সাত্রের দর্শন থেকে গ্রহণ করেছেন। এবং এই চেতনায় বাংলা উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীগুলো নির্মাণ করেছেন। ‘লালসালু’ উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, মজিদ শস্যহীন অঞ্চল থেকে প্রথমে ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ে আসে। তারপর সেখানে সুবিধা করতে না পেরে পরে মহব্বত নগরে আসে এবং একজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কবরকে মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে সনাক্ত করে। গ্রামের সাধারণ মানুষ মজিদের এই কথাকে সরল মনে বিশ্বাস করে এবং এখানে নিয়মিত টাকা-পয়সা দান করে। এই টাকা দিয়েই মজিদ জমি-জমা, ঘর-বাড়ি করে। এবং রহীমা নামের মেয়েটিকে স্ত্রী করে ঘরে তোলে। তারপর মজিদ জমিলা নামের আরো একটি মেয়েকে বিয়ে করে। প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে সুখে দিন কাটালেও দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে পরে। দ্বিতীয় স্ত্রী মজিদের অবাধ্য হয়। মজিদ সর্বক্ষেত্রে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং সফল হয়েছে। তাই মজিদ দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। মজিদ জানে যে গ্রামবাসীর কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতাকে পুজি করে সে এতোদূর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মজিদ মনে মনে এ সত্যকে মানে। তাই নিজেই মনে মনে বলে যে, সব সত্য প্রকাশ করে দিয়ে একদিন এ গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। মজিদ পৃথিবীতে কপর্দকশূন্য একজন মানুষ। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই মজিদ এ পথ অবলম্বন করেছে-এটাই লালসালু উপন্যাসের আসল কথা।

আবার ‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসে দেখা যায় যে, আরেফ আলী মাস্টার যুবতী হত্যার সব ঘটনা জানে। তবুও প্রকাশ করতে সাহস পায় না। আবার এ দায় থেকে নিজেও মুক্ত হতে পারে না। আরেফ আলী মাস্টারের উভয় দিকেই বিপদ। একদিকে সত্য প্রকাশ তার জন্য জরুরী, আরেফ আলী মাস্টারের হৃদয় সত্যের পক্ষে। তাই সত্য প্রকাশ না করে তার শান্তি নেই। তার মনে একটি চেতনা সব সময় প্রবাহিত হতে থাকে। আবার অপরদিকে সমস্যা হলো সত্য প্রকাশ করলেই তাকে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই আরেফ আলী মাস্টার কোন দিকে যাবে। আরেফ আলী মাস্টার সব জেনেও চুপচাপ থাকে একটি কারণে। আর তা হলো নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। তাই এ উপন্যাসের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি যে, লেখক অস্তিত্ববাদী চেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। আবার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর সর্বশেষ উপন্যাস হলো ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। এখানেও মুহম্মদ মোস্তফা মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করে এবং শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর তিনটি উপন্যাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি ইউরোপীয় সাহিত্য থেকে অস্তিত্ববাদী চেতনা ও চেতনাপ্রবাহরীতি বাংলা উপন্যাসে প্রবর্তন করেছেন। তাই তাঁর উপন্যাসগুলো আন্তর্জাতিক। কিন্তু এ উপন্যাসগুলোর বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার পটভূমিকে ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। তাই এখানে গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন, সমাজ ব্যবস্থা, লোকজীবন ও লোকবিশ্বাসকে লেখক অসাধারণ শৈল্পিক নৈপুণ্যে উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পেক্ষাপটে সমাজের শ্রেণিবিন্যাস, মানুষের কুসংস্কার, ধর্মের প্রতি গভীর বিশ্বাস, সামাজিক রীতি-নীতি এ রকম আরো নানাবিধ সংস্কৃতি তিনি তিনটি উপন্যাসেই উপস্থাপন করেছেন। তাই উপন্যাস তিনটির সার্বিক আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস আর্ন্তজাতিক হয়েও স্বাদেশিক’-এই উক্তিটি যথার্থ।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা, পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বাংলা উপন্যাসে অস্তিত্ববাদী দর্শন ও চেতনাপ্রবাহরীতি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি মন ও হৃদয় দিয়ে যা সত্য বলে অনুভব করেন, তাই উপন্যাসে তুলে আনেন। হতে পারে তা রাজনৈতিক দর্শন, বা সামাজিক কোন অনুষঙ্গ। মানবসত্যকে তিনি কথাসাহিত্যে অমর করে রাখতে চেয়েছেন। তিনি একই সাথে বাংলা উপন্যাসে আন্তর্জাতিক দর্শনের প্রয়োগ দেখিয়েছেন, আবার নিজ দেশের সমাজচিত্রকে অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়-বাংলা উপন্যাসে তিনি স্বতন্ত্র মাত্রা সংযুক্ত করেছেন।

 

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক,বাংলা বিভাগ, জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *