ইডিপাস নাটক অবলম্বনে ইডিপাস চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর।
অথবা, (ইডিপাসের অন্তর্বেদনা/ নিয়তিবাদ ইডিপাসকে করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে/নিয়তিবাদেরস্বরুপ ও প্রভাব/সত্য অনুসন্ধান ইডিপাস চরিত্রের ট্ট্যাজেডির মূল কারণ)
উপস্থাপনা : ইডিপাস বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপুর্ণ নাটক। বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার সফোক্লিস গ্রিক ভাষায় এ নাটকটি রচনা করেন। সৈয়দ আলী আহসান এ নাটকটি বাংলায় অনুবাদ করেন। এটি একটি অন্যতম ট্র্যাজেডি নাটক। লোকগাথা অবলম্বন করে সফোক্লিস এ নাটক রচনা করেন। থিবির রাজা লেয়াস, রাজপুত্র ইডিপাস ও রাণী জোকাস্টার জীবনের করুণতম বিষয় অবলম্বনে এ নাটক নির্মাণ হয়েছে। ইডিপাস এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। ইডিপাসকে অবলম্বন করেই এ নাটকের কাহিনি জমে উঠেছে এবং সফল শিল্প পরিণতি লাভ করেছে। ইডিপাস চরিত্রটি নিচে আলোচনা করা হলো-
ইডিপাসের পরিচয় সম্পর্কে নাটকের কাহিনিসূত্রে জানা যায় যে, ইডিপাসের পিতার নাম রাজা লেয়াস, মাতার নাম জোকাস্টা। ইডিপাসের পিতা গ্রিক দেশের থিবি রাজ্যের রাজা ছিল। ইডিপাস পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান ডেলফির মন্দিরের দৈববাণী নিয়ে এ নাটকের সূত্রপাত এবং এ দৈববাণীর সফল পরিণতির মাধ্যমে নাটকের সমাপ্তি ঘটে। নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইডিপাস চরিত্রে আমরা সব ধরনের মানবিক গুণাবলি দেখতে পেয়েছি। যেমন : থিবির রাজ্যের প্রতিবেশি দেশ করিনথে ইডিপাস আস্তে আস্তে বড় হয় এবং এক সময় যুবক হযে উঠে। একদিন ইডিপাস এ্যাপোলো মন্দিরে দৈববাণী শুনে যে, সে তার পিতাকে হত্যা করবে এবং মাতাকে বিয়ে করবে। এ দৈববাণী শুনে ইডিপাস ভয় পায় এবং পিতা-মাতাকে রক্ষা করার জন্য করিন্থ দেশ থেকে পালিয়ে প্রতিবেশি দেশ থিবিতে যায়। এতে বোঝা যায় যে, পিতামাতার প্রতি ইডিপাসের অসীম ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল। পিতা-মাতাকে ইডিপাস সর্বোচ্চ ভালোবাসতো।
পথে ইডিপাসের সাথে একদল পথিকের সঙ্গে দেখা হয়। এই সময় পথিকদেরকে ইডিপাস পথ ছেড়ে দেয় নি, এতে উভয়ের মধ্যে যুদ্ধ লাগে। এই ঘটনায় বৃদ্ধাসহ অধিকাংশ মানুষ ইডিপাসের হাতে মৃতুবরণ করে। এতে বোঝা যায় ইডিপাস চরিত্রে যথেষ্ঠ বীরত্ব ছিল। একাই একদল পথিককে ইডিপাস পরাজিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে নিজের অজান্তেই ইডিপাস পিতাকে হত্যা করেছে। ইডিপাস চরিত্রে যথেষ্ট ব্যক্তিত্ব ও সাহস ছিল। এরপর ঘটনাসূত্রে দেখা যায় যে, ইডিপাস থিবি রাজ্যে প্রবেশ করে। স্ফিংস নামে এক পৌরাণিক পাখির ধাঁধার জবাব দিয়ে থিবির জনগণকে রক্ষা করে। এতে থিবি রাজ্যের সব প্রজা ইডিপাসকে তাদের রাজা হিসেবে মেনে নেয়। প্রজারা সবাই মেনে নেওয়ায় রাণী জোকাস্টাও ইডিপাসকে রাজা হিসেবে মেনে নেয় এবং জোকাস্টা ও ইডিপাসের মধ্যেআইনগতভাবে বিয়ে হয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে এ্যাপোলো ও ডেলফির মন্দিরের ভবিষ্যৎ বাণী সত্যে পরিণত হয়। কিন্তু ইডিপাসের চরম দুভার্গ্য যে নিজের অজান্তে এতা বড় অন্যায়ে জড়িয়ে পড়েছে। তবে এখানে ইডিপাসকে অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। দেশের সব প্রজার কল্যাণ সাধনে ইডিপাস নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছে। কিন্তু নিজের অজান্তে নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
থিবি রাজ্যে হঠাৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়। মানুষ বিপদে অসহায় হয়ে পড়ে। তাদের একমাত্র ভরসা রাজা ইডিপাস। সবাই রাজা ইডিপাসের কাছে ছুটে এসে। রাজা ক্রিয়নকে এ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ জানার জন্য এপোলো মন্দিরে পাঠায়। ক্রিয়ন এপোলো মন্দির থেকে জানতে পারে যে, রাজা লেয়াসের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিলে এ দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ অবস্থায় রাজা ইডিপাস দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। রাজা ইডিপাস লেয়াসের হত্যাকারীকে খূঁজে বের করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ইডিপাস অত্যন্ত মানবিক গুণ সম্পর্কে মানুষ। রাজা লেয়াসের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তি দিতে চায় এবং এ জন্য ইডিপাস সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখিয়েছে। ইডিপাস ত্রিকালদর্শী টিরেসিয়াসকে ডেকে এনে এর কারণ জানতে চায়। ত্রিকালদর্শী এক সময় ভয়ে সত্য প্রকাশ করে দেয় এবং রাজা ইডিপাস যে লেয়াসের হত্যাকারী, তা জানিয়ে দেয়। তখন ইডিপাস টিরেসিয়াসকে সন্দেহ করে এবং প্রকৃত সত্য উদঘাটনের জন্য তৎপর হয় এবং আস্তে আস্তে সত্যের জালে জড়িয়ে পড়ে। রাণী জোকাস্টা ঘটনা অনুমান করে ইডিপাসকে নিবৃত করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইডিপাস তার জন্মের সত্য রহস্য ও রাজা লেয়াসের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে সংকল্প গ্রহণ করে। ইডিপাসের স্পষ্ট কথা ‘আমি আমার জন্মের সত্য আজ আবিষ্কার করবো।’ ঘটনার শেষে দেখা যায় বাস্তবেই ইডিপাস সেই মেষচারক ও বৃদ্ধা রাজা লেয়াসের হত্যার সময় সেখান থেকে যে পালিয়ে এসেছিল তাকে সংগ্রহ করে এবং নিষ্ঠুর সত্য প্রমাণিত হয় যে, ইডিপাস রাজা লেয়াসের হত্যাকারী ও রাণী জোকাস্টার পুত্র সন্তান হয়ে রাণী জোকাস্টাকে বিয়ে করেছে। সব কিছু বিচার করে দেখা যায় এক চরম বিপর্যয়ের মুখেও রাজা ইডিপাস পিছনে হটে যায় নি। এমন কি রাণী জোকাস্টা ও ত্রিকালদর্শী টিরেসিয়াসের সাবধানবাণীও ইডিপাসকে থামাতে পারে নি। সত্য আবিষ্কার করতে গিয়ে ইডিপাস দেখতে পেয়েছে যে, ইডিপাস নিয়তির একজন অভিশপ্ত সন্তান। ইডিপাস নিজ হাতে রাণী জোকাস্টার কাপড় থেকে কাটা খুলে নিজের চোখদুটো নষ্ট করে দেয়। এই পাপযুক্ত চোখ দিয়ে ইডিপাস আর এ পৃথিবী দেখবে না। তারপর ইডিপাস দু’মেয়ের হাত ধরে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যায় এবং সিথারেয়ন পাহাড়ে নির্জনে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ইডিপাস নাটকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন ন্যায়পরায়ণ, কর্তব্যনিষ্ঠ, প্রজাসেবক এবং পিতা-মাতাভক্ত হিসেবে নিজের পরিচয় রেখেছে। দৈববাণী থেকে নিজেকে ও পিতামাতাকে রক্ষার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি। তাই ইডিপাস নিয়তির শিকার। তবে নিজের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইডিপাস নিয়তিকে অতিক্রম করেছে এবং সব পাঠকের সহানুভূতি ও ভালোবাসা পেয়েছে। সত্যিই ইডিপাসের মতো চরিত্র বিশ্বসাহিত্যে বিরল।
উপসংহার : উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ইডিপাস চরিত্র দৈববাণী থেকে নিজেকে ও পিতামাতাকে রক্ষার জন্য সব রকমের চেষ্টা করেছে। করিনথ থেকে পালিয়ে এসেছে কিন্তু নিয়তির হাত থেকে পালাতে পারে নি। ইডিপাস চরিত্রে সব ধরনের মানবিক গুণ আছে। ন্যায়পরায়ণতা, সত্যনিষ্ঠা, দায়িত্বশীলতাসহ সার্বিক মহৎগুণগুলো তার মধ্যে ছিল। নিয়তির কারণে ইডিপাস চরিত্রে গভীর ট্ট্যাজেডি নেমে আসে। যে কোন বিবেচনায়, বিশ্বসাহিত্যে ইডিপাসের মতো চরিত্র দ্বিতীয়টি আর নেই।
[সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়,গাজীপুর]