ভাষাবিজ্ঞানী মুহাম্মদ দানীউল হক তার ‘ভাষাবিজ্ঞানের কথা’ গ্রন্থে বলেন , ‘পৃথিবীর সকল ভাষাতেই বাগধ্বনিসমূহকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়- ব্যঞ্জনধ্বনি এবং স্বরধ্বনি।’ স্বরধ্বনির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে দানীউল হক বলেনÑ ‘ফুসফুসাগত বাতাস গলনালী, মুখবিবর অথবা নাসিকা গহবরের কোথাও বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে অবারিত ও ঘোষবৎ পূর্ণাঙ্গ উচ্চারিত হলে তাকে স্বরধ্বনি বলে।’
আধুনিক যুগের শুরুতে ১৯২০ এর দশকের দিকে ইংরেজ ধ্বনিবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল জোন্স প্রথমবারের মতো পৃথিবীর যে কোন ভাষার স্বরধ্বনির উচ্চারণের স্বরূপ নির্ধারণ করেন। তিনি মৌলিক স্বরধ্বনিকে ইংরেজিতে ঈধৎফরহধষ ঠড়বিষ নাম দিয়েছেন। ড্যানিয়েল জোন্স এর মতে মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা ৮ টি । অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড . আবুল কালাম মনজুর মোনাশেদ তাঁর ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ নামক গ্রন্থে বাংলা মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা ৭ টি বলে উল্লেখ করেছেন।
মৌলিক স্বরধ্বনি : যে সকল স্বরধ্বনিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়, সেগুলোকে মৌলিক স্বরধ্বনি বলে । বাংলাদেশের অধিকাংশ ভাষাবিজ্ঞানী বাংলা ভাষায় অ, আ, ই, উ, এ, অ্যা, ও এই সাতটিকে মৌলিক স্বরধ্বনি বলে মতামত দিয়েছেন ।
দ্বিস্বরধ্বনি : ভিন্ন ভিন্ন স্বরধ্বনির সাহায্যে গঠিত স্বরধ্বনিকে দ্বিস্বরধ্বনি বলে । পাশাপাশি অবস্থিত দুটি সমশ্রেণির বা অসমশ্রেণির স্বরধ্বনি দ্রুত উচ্চারিত হলে তাদেরকে বলা হয় দ্বিস্বরধ্বনি । যেমনÑ ই + ই = দিই , অ + ও=হও, অ + উ = বউ । বাংলা বর্ণমালায় ‘ঐ ’ এবং ‘ঔ’ কে দ্বিষরধ্বনি বলা হলেও চলিত বাংলায় অসংখ্য দ্বিস্বরধ্বনি পরিলক্ষিত হয় ।
ড . আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ তাঁর ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ নামক গ্রন্থে দ্বিস্বরধ্বনির ৫ টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন ।
১. দুটো স্বনি একসঙ্গে একই প্রয়াসে উচ্চারিত ।
২. রূপমূলে দুটো স্বরধ্বনি পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় ।
৩. প্রথম স্বরধ্বনি দ্বিতীয় স্বরধ্বনির তুলনায় দীর্ঘ ও স্পষ্ট ।
৪. প্রথম স্বরধ্বনি পূর্ণদৈর্ঘ্য্য স্বরধ্বনির বৈশিষ্ট্যপ্রাপ্ত ও দ্বিতীয় স্বরধ্বনি পিচ্ছিল জাতীয় ধ্বনি।
৫. দ্বিস্বরধ্বনি গঠনে সমশ্রেণির অথবা অসমশ্রেণির দুটো স্বরধ্বনিযোগে গঠিত হয়ে থাকে।
মৌলিক স্বরধ্বনি ও দ্বিস্বরধ্বনির পার্থক্য :
মৌলিক স্বরধ্বনি :
মৌলিক স্বরধ্বনি কোন একক ভাষার স্বরধ্বনি নয়। মৌলিক স্বরধ্বনির মধ্য দিয়ে অন্য কোন স্বরধ্বনির স্বাতন্ত্র্য নির্ণয় সম্ভব। মৌলিক স্বরধ্বনি প্রত্যেকটি এক একটি একক সংগঠন । বাংলা ভাষায় মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা ৭ টি , মতান্তরে ৮ টি। মৌলিক স্বরধ্বনি কেবল একটি ধ্বনি, এটি কোন অক্ষর নয় ।
দ্বিস্বরধ্বনি:
পাশাপাশি দুটো স্বরধ্বনি সহযোগে দ্বিস্বরধ্বনি হঠিত হয় । দ্বিস্বরধ্বনি অক্ষরের মর্যাদা পায় । বাংলা বর্ণমালার ‘ঐ’ এবং ‘ঐ’ কে দ্বিষরধ্বনি বলা হলেও চলিত বাংলায় অসংখ্য দ্বিস্বরধ্বনি পরিলক্ষিত হয় । বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯ টি দ্বিশ্বরধ্বনির উদাহরণ দিলেও ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই দ্বিস্বরের সংখ্যা ৩১ টি বলে মতামত দিয়েছেন । এর মধ্যে ১৯ টি নিয়মত, ১২ টি অনিয়মিত দ্বিস্বরধ্বনি । অপরদিকে আরেক ভাষাবিজ্ঞানী ড . সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ২৫ টি দ্বিস্বরধ্বনির উল্লেখ করেছেন।