কপালকুণ্ডলা উপন্যাস অবলম্বনে মতিবিবি চরিত্রটি বিশ্লেষণ কর।
সাাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) বাংলা সাাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাাসিক। কপালকুণ্ডলা (১৮৬৬) প্রথম রোমান্সধর্মী সার্থক উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্র উপন্যাসের প্লট, কাাহিনি, ভাষাগত দক্ষতার পাশাপাাশি চরিত্র নির্মাণেও সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছন। এ উপন্যাসে বেশ কিছু চরিত্রের সমাবেশ আছে এবং সব চরিত্রই কম-বেশি সফল। প্রশ্নের প্রসঙ্গক্রমে এখন মতিবিবি চরিত্রটি বিশ্লেষণ করা হল –
মতিবিবির সাধারণ পরিচয়- রাম গোাবিন্দ ঘোষালের কন্যা, নবকুমারের বিবাাহিত প্রথম স্ত্রী, বয়স তের বছর, শারীরিক গঠন মধ্যম আকৃতির চেয়ে একটু দীর্ঘ, ঠোঁট একটু চাপা, হাত পা সুডৌল, রুপের বর্ণনা একটি মাত্র লাইনে এভাবে লেখক দিয়েছেন -‘তাহার যৌবণশোভা শ্রাবণের নদীর ন্যায় উছলিয়া পড়িতেছে’। বিবাহের পর কিছুদিন পিতার ঘরে ছিল। মাঝে মাঝে শ্বশুরবাাড়িতে যাতায়াত ছিল। মতিবিবি মোঘল-পাঠান যুদ্ধের সময় পুরুষোত্তম দর্শনকালে পথের মধ্যে পাঠানের হাতে ধরা পড়ে, এবং সনাতন ধর্ম বিসর্জন দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় মুক্তি পায়। তখন মতিবিবির নাম হয় লুৎফ-উন্নিসা, কিন্তু তার পিতৃপ্রদত্ত নাম পদ্মাবতী, আর মতিবিবি হল তার ছদ্মনাম।
মতিবিবি স্পষ্টভাষী স্বভাবের, নবকুমার পদ্মাবতীর রূপ চেয়ে চেয়ে দেখলে পদ্মাবতী নবকুমারকে সোজাসুজি প্রশ্ন করে এভাবে-‘ আপনি কখনও কি স্ত্রীলোক দেখেন নাই, না আপনি আমাকে বড় সুন্দুরী মনে করিতেছেন’। মতিবিবি সব দিক থেকে উদার মনের মানুষ। স্বামীকে মনে প্রাণে ভালবাসে, তাই শরীরের প্রতিটি অলংকার খুলে নিজ হাতে কপালকুণ্ডলার শরীরে পড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমে সে সুখ অনুভব করে এবং নিজেকে স্বামীর কাছে স্বরণীয় করে রাখতে চায়।
দোষগুণ সমন্বয়ে মতিবিবি চরিত্র নির্মিত। তার আসল নাম পদ্মাবতী, পরিস্থিতির শিকার হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকালে নাম রাখে লুৎফ-উন্নিসা, ভ্রমণকালে মতিবিবি ছদ্ম নাম ধারণ করে। শিক্ষার প্রতি মতিবিবির আগ্রহ ছিল। আগ্রায় সে পারসিক, সংস্কৃত, নৃত্য, গীত, রসবাদ প্রভৃতিতে বিদ্যা অর্জন করে। প্রচুর বিদ্যা অর্জন করলেও ধর্ম সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। জীবনকে উপভোগ করতে চাইত। তাই মন-প্রাণ ও পাার্থিব সুখ-শাান্তির জন্য মতিবিবি যে কোন কাজ নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘেœ করত। স্বেচ্ছাচাারিতার সীমা লঙ্ঘন করলে পিতা রাম ঘোষাল তাকে গৃহ থেকে বিতাাড়িত করে।
মতিবিবি আগ্রাতে যুবরাজ সেলিমের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সেলিম তাকে প্রধান সহচরী নিযুক্ত করলে প্রকাশ্যে মতিবিবি বেগমের সখি হিসেবে পরিগণিত হলেও পরোক্ষভাবে সেলিমের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যৎ রাণী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু যুবরাজ সেলিম সুন্দরী মেহেরুন্নেসার প্রতি আকৃষ্ট হলে মতিবিবি সিংহাসনের আশা পরিত্যাগ করে।
পেষমন মতিবিবির নতুন স্বামী প্রসঙ্গ উত্থাপন করায় মতিবিবির ভাষ্য এরূপ- ‘আমার ন্যায় সতীর দুই স্বামী বড় অন্যায় কথা’। মতিবিবি আবার বিবাহ করার ইচ্ছা পোষণ করে, তাও আবার প্রথম স্বামীকেই বিবাহ করবে বলে জানায়। লুৎফ-উন্নিসার ভাষায় ‘সাধ হইয়াছে. একটি বিবাহ করিব।’
মতিবিবি তিন বছর দিল্লীর রাজপ্রসাদে থাকে। সম্রাঞ্জী হওয়ার বাসনা পূর্ণ না হলেও সব সময় ধন সম্পদ ও প্রাচুর্য্যে পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু শাান্তি পায়নি। এ প্রসঙ্গে মতিবিবির স্বীকারোক্তি – ‘এক দিনের তরেও সুখী হই নাই, এক মুহুর্তের জন্য কখনও সুখ ভোগ করি নাই। কখনও পরিতৃপ্ত হই নাই। কেবল তৃষ্ণ বাড়ে মাত্র।’
এক সময় লুৎফ-উন্নিসা হতাশ হয়ে রাজ্য, রাজধানী, সিংহাসন সব দিল্লীতে যমুনার জলে বিসর্জন দিয়ে চলে আসে সপ্তগ্রামে। নিজেকে সমর্পণ করে নবকুমারের পদচরণে। লুৎফ-উন্নিসা ভাষায়-‘তোমার যে পত্নী হইব, এ গৌরব চাাহি না, কেবল দাসী।’ নবকুমার মতিবিবিকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলে অত্যন্ত কাতরস্বরে মতিবিবি নবকুমারের শ্রীচরণে আশ্রয় প্রার্থনা করে এভাবে-‘আামি তোমার জন্য আগ্রার সিংহাসন ত্যাগ করিয়া আাসিয়াাছি। তুমি আমায় ত্যাগ করিও না।’ কিন্তু নবকুমার মতিবিবিকে কোনভাবেই গ্রহণ করল না। তখন মতিবিবি সমগ্র জীবন স্বামীর জন্য অপেক্ষা করবে বলে জানায়। লেখক বঙ্কিমের ভাষায় ‘এ জন্মে তোমার আশা ছাাড়িব না।’ লুৎফ-উন্নিসা সব দিক থেকে সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। কিন্তু সে ব্যর্থ হতে চায় না। তাই সে বিকল্প পথে হাঁটতে শুরু করে, মতিবিবি কপালকুণ্ডলা ও নবকুমারের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানোর মত হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এবং শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্য সাধনে সফল হলেও স্বামী নবকুমারকে আর ফিরে পায়নি।
উপরের বিশ্লেষণে দেখা যায়, মতিবিবি জাগতিক সুখ-শাান্তির জন্য সব দিক থেকে সব রকম প্রচেস্টা চাালিয়েছে। দিল্লী থেকে আগ্রা পর্যন্ত ছুটাছুটি করেছে, সুখের দেখা পায়নি, নিজেকে পরিতৃপ্ত করতে পারেনি। কিন্তু নিজেকে পরিতৃপ্ত করবার তীব্র বাসনা মতিবিবি চরিত্রে দেখা যায়। তাই মতিবিবি একটি আধুনিক ও সফল চরিত্র।