বাংলাদেশের ছোটগল্প শিরোনামে একটি নিবন্ধ রচনা করো।

ছোটগল্প

বাংলাদেশের ছোটগল্প শিরোনামে একটি নিবন্ধ রচনা করো। (বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারা)

বাংলাদেশের সাহিত্যে ছোটগল্পের বিশিষ্ট স্থান সুনির্দিষ্ট হয়েছে সামাজিক-মানবিক ও আর্থ-রাজনৈতিক আবহ ধারণ করে। ছোটগল্পের ভুবনে সঞ্চিত হয়েছে ভাষা-আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সংকট, সামাজিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন আর মানব জীবনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত। খ্যাতিমান অনেক গল্পকার-উপন্যাসিককে আমরা পেয়েছি। তাদের ফলবান সম্ভারে পরিপূর্ণ হয়েছে বাংলাদেশের গল্পলোক। রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবর্তনের ধারায় মানুষের আকাক্সক্ষা-সংগ্রাম, দোদুল্যমানতা যেমন প্রতিফলিত হয়েছে গল্পে তেমনি মানুষের সম্ভাবনা, সমাজবাস্তবতা, রাজনৈতিক প্রবণতা ফুটে উঠেছে শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতায়।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় গল্পকার হিসেবে নিজেদের উচ্চ অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তারা হলেনÑরশীদ করিম, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু রুশ্দ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সিকান্দার আবু জাফর, শওকত ওসমান, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, রিজিয়া রহমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হাসান আজিজুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জহির রায়হান, সেলিনা হোসেন প্রমুখ। বাংলাদেশের ছোটগল্পে রূপায়িত হয়েছে সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধতা, পশ্চাৎবর্তিতা, ধর্মান্ধতা, পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য সংকট, নিম্নবর্গের অনুভূতি, জীবন জটিলতা, প্রগতিশীলতা, মুক্তির আকাক্সক্ষা, শোষণের বিরুদ্ধে দ্রোহ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ।

১৯৪৭ সালের পরবর্তী পুরো পাকিস্তান আমলে বাঙালির মধ্যে রয়েছে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রবল দ্রোহচেতনার পরিচয়। ৪৮ থেকে ৫২ সালের পটভূমিতে গয়ে ওঠা চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে গল্পে। দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক ঘটনার কুপ্রভাব, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবাদর্শ ও সামাজিক প্রগতির চেতনা সক্রিয় ছিল এ সময়কার গল্পকারদের মধ্যে। আলাউদ্দিন আল আজাদের বেশ কয়টিগল্প পাঠক মহলে সাড়া জাগিয়েছিল । আবু ইসহাকের ‘বনমানুষ’ আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘উজান তরঙ্গে’ ‘দুপুরে প্রস্থান’; রিজিয়া রহমানের ‘এক কান্নার স্বাদ’ প্রভৃতি উল্লেখ্য। শওকত ওসমানের গল্প ‘আখেরী সংক্রান্ত’ ‘মন্ত্রগুণ’ হাসান হাফিজুর রহমানের ‘মানিকজোড়’ ; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ শীর্ষক গল্পটিও উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও হাসান আজিজুল হকের গল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ ‘খাঁচা’ প্রভৃতিতে রয়েছে সমাজচিন্তার প্রতিফলন।

১৯৪৭-এর দেশবিভাগের গল্পে মধ্যবিত্তের জীবনকথা আছে, দেশভাগের দুঃখকথা আছে, প্রগতিচেতনায় জাগ্রত হওয়ার কামনা আছে, নিপীড়িত নিম্নবর্গীয় দ্রোহচেতনার প্রকাশ আছে, ভাষা ও সংস্কৃতির সত্তায় হামলাকারীদের প্রতিরোধের প্রবণতা আছে। সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের গল্পভুবনেও পাওয়া যায় আর্থ-রাজনৈতিক অস্থিরতার চিত্র, মূল্যবোধের স্বাক্ষর আর পরাধীন অর্থনীতি ও বেসরকারি সংস্থাসমূহের তৎপরতার প্রতিচ্ছবি। এ সময়ের গল্পকাররা সমাজবাস্তবতা বিষয়ে সচেতন হয়ে লিখেছেন, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব আলোকে শিল্পসুষমার পরিচয় দিয়েছে গল্প রচনায়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা, রাজনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা, প্রগতিশীল গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার গণ আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি ।

এরই ধারাবাহিকতায় শামসুদ্দিন আবুল কালামের ‘শাহের বানু’, আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’, আবু ইসহাকের মহাপতঙ্গ-এর মাধ্যমে। তাদের গল্পে রূপায়িত হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, আর্থিক মন্দা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অভিজ্ঞতা, উদ্বাস্তু সমস্যা, দুর্নীতি ও বৈষম্যের ঘনঘটা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, গ্রাম ও শহরের ব্যবধান, সামাজিক অধিকার, নিপীড়ন-নির্যাতন, মানবীয় হীনম্মন্যতা প্রভৃতি প্রতিফলিত হয়েছে পঞ্চাশের দশকের গল্পকার ও উপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান, শওকত আলী, আলাউদ্দিন আল আজাদ,হাসান হাফিজুর রহমান, আবু রুশ্দ, রশীদ করীমের গল্পভাষ্যে।

বাংলাদেশের ছোটগল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন ও প্রভাব লক্ষণীয় বিষয়। বাংলাদেশ নামক সার্বভৌম রাষ্ট্রটি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে আছে বাংলাদেশের জন্মবেদনা থেকে সৃষ্টিসুখের উল্লাস। এরই ধারাবাহিকতা ধারণ করে গল্পকাররা অগ্রসর হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প লিখেছেন হাসান আজিজুল হক ‘নামহীন গোত্রহীন’; সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’। শওকত ওসমান এর ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘আমার রক্ত’ ‘স্বপ্ন খামার’; আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’; ‘খোয়ারি’, ‘দুধেভাতে উৎপাত’ ‘দোজখের ওম’, ‘জাল স্বপ্ন : স্বপ্নের জাল’ ইত্যাদি পাঠকসমাজে ব্যাপক নন্দিত হন।

উপর্যুক্ত আলোচনার পেক্ষিতে বলা যায়, গল্পের পটভূমি, বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপনা ঢঙ, কাহিনির বিন্যাস ও বিস্তার, সমাজবাস্তবতার বয়ানসূত্র, চরিত্রের গঠনকৌশল এবং শৈল্পিক সমাপ্তি সংযোজনে বাংলাদেশের ছোটগল্প। সমকালীন মানুষের যাপিত জীবনযাত্রার ব্যক্তিক থেকে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ-প্রতিবেশে সংঘটিত নানামুখী সংকট ও সমস্যা বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে এই পর্বের গল্পে উপস্থাপিত।

সালেক শিবলু. এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর