ট্যাজেডি হিসেবে নীল দর্পণ নাটকের সার্থকতা বিচার কর।
বাংলা সাহিত্যে নাটক একটি বিশেষ প্রকরণ। দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীল দর্পণ’(১৮৬০) বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম নাটকের কাহিনি, ঘটনা, আঙ্গিক পরিকল্পনা, গঠনবিন্যাস-এসব বিচারে ‘নীল দর্পণ’ একটি সফল নাটক। ট্যাজেডি নাটক হিসেবে ‘নীল দর্পণ’ নাটকটি বেশ সফলতা লাভ করেছে। ঘটনা নয়, চরিত্র নয়, নাট্যকারের বিশিষ্ট চিন্তার প্রকাশই ‘নীল দর্পণ’ নাটকের ট্র্যাজেডির মুখ্য বৈশিষ্ট্য। নিম্নে প্রাসঈিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হল :
অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা নির্দেশ করে বলেন-
Tragedy is an imitation of an action that is serious, complete,and of a certain magnitude, in language embellished with each kind of artistic, ornament, the several kinds being found in separate parts of the play, in the form of action, not of narrative; through pity and fear effecting the proper purgation of these emotions
এ সংজ্ঞার আলোকে বলা যায়-
১. ট্র্যাজেডিতে কোন জীবন ক্রিয়মান হয়ে ঘটনার ঘাতপতিঘাতের মধ্যে দিয়ে রূপায়িত হয়।
২. নাটকীয় ঘটনাবস্তু সুগভীর ও পূর্ণ বলিিয়ত আকারে ট্র্যাজেডিতে প্রস্ফুটিত হয়।
৩. ভাবগৌরবে, শব্দসম্পদ ও গীতাদি সংযোগে এর বহিরাবরণে প্রসাধন সংসাধিত হয়।
৪. নাটকীয় ঘটনাবস্তু একটিমাত্র পরিণামমুখিতার সুরকে উদ্রেক করে।
৫. ট্র্যাজেডি ঘটনাত্মক, বর্ণনাত্মক নয়।
৬. সামাজিকের মনে করুণা ও ভীতির সঞ্চার করে তা নিরসন করে ট্র্যাজেডি তার মানস স্বাস্থ্য সংবিধান করে।
এ সব বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি ধারণ করে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটক ট্র্যাজেডির মর্যাদা লাভ করেছে কিনা; নাটকটি পর্যালোচনা করে এর সত্যতা নিরূপণ করতে চাই।
নীল দর্পণ
নাটকের পাত্রপাত্রীর যন্ত্রণা যখন শিল্পের আঙিনা ছেড়ে পাঠক ও দর্শকদের সিক্ত করে, তখন তাকে ট্যাজেডি বলে। বাংলা সাহিত্যে ট্যাজেডি দুই প্রকারের একটি হলো শেকসপিরীয়ান ট্যাজেডি যা নায়কের ব্যক্তিগত ভুলের ফলে পরিণামে করুণ পরিণতি। আর অন্যটি হলো গ্রীক ট্যাজেডি যা নিয়তি নির্ধারিত। ‘নীল দর্পণ’ নাটকটিতে দুই ট্যাজেডির কিছুটা মিথস্ক্রিয়া দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটক বাংলাদেশে নীলচাষ, নীলকরদের অত্যাচার, এবং অংশত নীল আন্দোলনের দর্পণ। নাটকের কাহিনিসূত্রে দেখা যায় যে, এখানে নিয়তির সাথে নাটকের কোন চরিত্রের সংঘাত ঘটেনি। যতটুকু সংঘাত হয়েছে তা মানুষে মানুষে। দুটি অসম শক্তি এ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। একদিকে নীলকর, অন্যদিকে কৃষক প্রজাবৃন্দ, এক কথায় নীলচাষীরা। এ নীলচাষীদের মধ্যে রয়েছে গোলক বসু, নবীনমাধব, বিন্দুমাধব, তোরাপ, সাধুচরণ, রায়চরণ ইত্যাদি। অন্যদিকে নারী চরিত্রগুলো হলো সরলতা, সৈরিন্ধ্যি, ক্ষেত্রমনি প্রভৃতি। ট্যাজেডি নাটকের চরিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় নায়ক চরিত্র হবে অত্যন্ত শক্তিমান। এবং এ চরিত্র অবশ্যই সংগ্রামশীল হতে হবে। কিন্তু ‘নীল দর্পণ’ নাটকে তেমন শক্তিমান কোন কেšদ্রীয় নায়ক বা নায়িকা চরিত্র নেই। এ নাটকে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ মিলিয়ে বেশ কিছু চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। কিন্তু ট্যাজেডি নাটকের মতো বিকশিত কোন চরিত্র নেই। নবীনমাধবের ভেতরে নায়কের কিছুটা গুণ থাকলেও শেষ পর্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারেনি। ‘নীল দর্পণ’ নাটকের কাহিনি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার ছিল না। নীলকরদের অত্যারের বিরুদ্ধে নায়োকচিত কোন ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তাই ট্যাজিক নায়কের স্বরূপ তার মধ্যে বিকশিত হয়নি। অন্যদিকে নারী চরিত্রের মধ্যে ক্ষেত্রমনি কিছুটা উজ্জ্বল। আত্মরক্ষার সংগ্রামে কিছুটা সাহসের পরিচয় দেখালেও তা যৎসামান্য। তার মধ্যে ট্যাজেডির বীজ সুপ্ত ছিল, কিন্তু বিকাশ লাভ করেনি। কেননা ক্ষেত্রমনি কাহিনির নায়ক বা নায়িকা নয়। মূল কাহিনির ধারা সে কোন দিক থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আর তাই এ নাটকে ট্যাজেডির মর্যাদা পাবার মতো কোন কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই।
গ্রীক ট্যাজেডির মতো কোন নিয়তিবাদ এ নাটকে নেই। শেকসপীরিয়ান নাটকে মানবিক ছিদ্র পথে নায়কের পতনের বীজ প্রবেশ করে, এবং পতন অনিবার্য করে তোলে। এ নাটকে তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি। এ নাটকের চরিত্রগুলো অবস্থার বিরুদ্ধে জোড়ালো কোন সংগ্রাম করেনি। বরং ঘটনার স্রােতে গা ভাসিয়েছে। অন্তর্দ্বন্দ্ব ট্যাজেডি নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু ‘নীল দর্পণ’ নাটকে চরিত্রগুলোর মধ্যে কোন অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই। এ নাটকে পাঁচটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কোন মৃত্যুই অনিবার্যভাবে আসেনি বা মৃত্যুর মতো পটভূমিই তৈরি হয়নি। বরং মৃত্যুগুলোতে এমন কিছু ত্রুটি আছে যা ট্যাজেডি সৃষ্টির অন্তরায়। ক্ষেত্রমনির মৃত্যু পাঠককে নাড়া দিয়েছে, স্বাভাবিকতার গুণে সার্থক করুণ রস সৃষ্টিতে সক্ষম; কিন্তু নাটকের ট্যাজেডিকে গৌরব দিতে পারে নি। তাই এটি একটি বিয়োগান্তক নাটক। চরিত্রের দিক দিয়েই হোক, আর ঘটনা বিন্যাসের দিক দিয়েই হোক; ‘নীল দর্পণ’ নাটকে ট্যাজেডির যথার্থ উপকরণ ছিল। কিন্তু তা বিকশিত হয়নি। নাট্যকারের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির কারণে ‘নীল দর্পণ’ নাটকে অনেক মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে। নাটকটি রচনার পিছনে নাট্যকারের প্রধান উদ্দেশ্য বিদেশি নীলকরদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। তাই তিনি এ নাটকে নীলকরদের অত্যাচার, কৃষক সমাজের দুঃখ-দুর্দশা কয়েকটি শোকাবহ মৃত্যুর দৃশ্যকে সুষ্পষ্টরেখায় চিহ্নিত করেছেন। তাই এটি একটি করুণ রসাত্মক বা বিয়োগান্ত নাটকে পরিণত হয়েছে।
উপর্যুক্ত বিষয়ের পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, দীনবন্ধু মিত্র রচিত ‘নীল দর্পণ’ নাটকে ট্যাজেডির মতো নায়ক সৃষ্টি হয়নি। প্রতিটি চরিত্র দুর্বল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো কোন সামর্থ তাদের নেই। তাছাড়া এ চরিত্রগুলো কোন অন্তর্দ্বন্দ্ব বা বহির্দ্বন্দ্ব নেই। তাদের মৃত্যুতে পাঠকের মনে করুণার উদ্বেক করে। তাই সার্বিক বিচার বিশ্লেষণে বলা যায় যে, ‘নীল দর্পণ’ ট্যাজেডি নাটক হিসেবে সফল হযনি। বরং এটি করুণ রসাত্মক বা বিয়োগান্তক নাটক হিসেবে সফল।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।