সুলতানি আমল এর সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

সুলতানি আমল
সুলতানি আমল
সুলতানি আমল এর বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। অথবা, সুলতানি আমল বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ/ মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের শ্রী বৃদ্ধি হয়েছিল)

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনটি যুগ রয়েছে। এর মধ্যে মধ্যযুগ অন্যতম। সুলতানী আমলের সাহিত্য মধ্যযুগের সাহিত্য। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ১২০৪ সালে বঙ্গদেশ জয় করেন। এর পরেই এ দেশে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। মুসলিম শাসন আমলকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি খিলজি আমল, অন্যটি সুলতানী আমল। সুলতানী আমলের শাসকবৃন্দ সাহিত্যিকদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ফলে এ সময় বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক উন্নতি হয়। বিষয়টি নিম্নে আলোচনা করা হলো-

ইলিয়াস শাহী বংশের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলায় সুলতানী আমলে সূচনা হয়। এরপর দুইশত বছরের বেশি সময় মুসলিম শাসকরা দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তারা উদার মনের মুসলিম ছিলেন। তাদের সহযোগিতায় গৌড় দরবারের সাহিত্য চর্চা সমৃদ্ধি লাভ করে। মুসলিম শাসকরা সাহিত্যচর্চা পছন্দ করতেন। তারা নানাভাবে সাহিত্যিক, লেখক ও শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন। ফলে এ সময় বাংলা সাহিত্যের মৌলিক ও অনুবাদ সাহিত্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ শাখা ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। অনুবাদ সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, মঙ্গলকাব্য, চরিত সাহিত্য, জীবনী সাহিত্যের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শাখা মুসলিম শাসকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করে।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর। তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘ইউসুফ জোলেখা’র মতো অমর কাব্য রচনা করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন। কৃত্তিবাস ওঝা অনুবাদ সাহিত্যে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘রামায়ণ’ এর মতো মহাকাব্য তিনি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন। এবং এখন পর্যন্ত তিনি রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক হিসেবে বিবেচিত হোন। সুলতান জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ‘রামায়ণ’ গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। মালাধর বসু একজন অন্যতম কবি। তিনি ‘ভাগবত’ গ্রন্থটি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন। সুলতান রুকনুদ্দিন বরবক শাহ মালাধর বসুকে এ কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেন। তার সহযোগিতায় মালাধর বসু এ রকম একটি অসামাণ্য কাজ শৈল্পিকভাবে সম্পন্ন করেন এবং অনূদিত গ্রন্থটির নাম রাখেন ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’। সুলতান কবির উপর অত্যন্ত খুশি হয়ে ‘গুণরাজ খাঁ’ উপাধি প্রদান করেন। জৈনুদ্দিন মধ্যযুগের একজন অন্যতম কবি। তিনি সুলতান ইউসুফ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘রসুলবিজয়’ নামক একটি কাব্য রচনা করেন।

আলাউদ্দিন হুসেন শাহ সুলতানী আমলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি ব্যাপক অনুরক্ত ছিলেন। তিনি গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং এ সময় বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ কবি বিজয়গুপ্তকে ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনায় প্রেরণা দেন। সুলতানের প্রেরণা ও উৎসাহে কবি বিপ্রদাস ‘মনসাবিজয়’ নামক একটি বৃহৎ মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন। তিনি কবি যশোরাজ খানকে বৈষ্ণব পদাবলি রচনায় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সুলতান আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পরে সেনাপতি পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় কবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর ‘পরাগলী মহাভারত’ করেন। এরপর ছুটি খাঁনের সহযোগিতায় কবি শ্রীকর নন্দী ‘ছুটিখান মহাভারত’ রচনা করেন। এ দুটি মহাভারত বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। শাসকরা পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন বলেই কবিরা তাদের নামের সাথে মিল রেখে কাব্য দুটির নামকরণ করেছেন ‘পরাগলী মহাভারত’ ও ‘ছুটিখান মহাভারত’। এতে সহজেই বোঝা যায়, বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের গভীর ভালোবাসা ছিল । তাই তার সময়ে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। কবি শ্রীধর মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম কবি। তিনি বিদ্যা ও সুন্দরের প্রেমকাহিনি অবলম্বনে সুলতান নুসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনা করেন। এ রকম রোমান্টিক প্রেমের কাব্য বাংলা সাহিত্যে খুব কম আছে। সুলতানী আমলে বেশ কিছু জীবনী সাহিত্য রচিত হয়েছে। কবি বৃন্দাবন দাস মধ্যযুগের একজন অন্যতম কবি। তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় চৈতন্যদেবের জীবনী অবলম্বনে ‘চৈতন্যভাগবত’ নামে একটি কাব্য রচনা করেন। এ সময় কবি লোচনদাস ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে আরো একটি জীবনীকাব্য রচনা করেন। এভাবে পর্যায়ক্রমে সুলতানী আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায়, সুলতানী আমলে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। এ সময়ে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, গিয়াসউদ্দিন আযম শাহ, জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ, সুলতান রুকনুদ্দিন বরবকশাহ, সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ প্রভৃতি মুসলিম শাসক বাংলা সাহিত্য চর্চায় লেখকদের সার্বিক সহযোগিতা করেছেন। এমন কি পরাগল খান এবং ছুটখানের মতো সেনাপতিরাও এ সময় সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় কবি সাহিত্যিকদের ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এ কারণে আমরা ‘পরাগলী মহাভারত’ ও ‘ছুটিখানি মহাভারত’ নামে দুটি সফল কাব্যগ্রন্থ পেয়েছি। তাই সার্বিক বিষয় বিবেচনায় দেখা যায়, এ সময় বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। তাই কেউ কেউ সুলতানী আমলকে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ বলে থাকেন। ড. দীনেশচন্দ্র সেন এ সময়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে এর নাম দিয়েছেন ‘গৌড়ীয় যুগ’।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।

সুলতানি আমল এর বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। অথবা, সুলতানি আমল বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ/ মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্যের শ্রী বৃদ্ধি হয়েছিল)