শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাস হিসেবে কতটুকু সফল আলোচনা কর। 211003

ক্রীতদাসের হাসি
শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাস হিসেবে কতটুকু সফল আলোচনা কর। (শিল্পমূল্য)

শওকত ওসমান বাংলাদেশের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, অনুবাদ প্রভৃতি ক্ষেত্রে স্বীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তবে কথাশিল্পী হিসেবেই তিনি সমধিক পরিচিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো- জননী, বনি আদম, ক্রীতদাসের হাসি, সমাগম, বেড়ী, দুই সৈনিক, চৌরসন্ধি, জাহান্নাম হতে বিদায়, রাজা উপাখ্যান প্রভৃতি। ক্রীতদাসের হাসি (১৯৬৩) তাঁর অন্যতম উপন্যাস। এ উপন্যাসের সফলতা / শিল্পমূল্য নিচে আলোচনা করা হলো –

ক্রীতদাসের হাসি উপন্যাসের কাহিনিসূত্রে যতটুকু জানা যায় যে, খলিফা হারুনর রশীদ আব্বাসীয় বংশের মানুষ। খলিফা হিসেবে বা প্রশাসক হিসেবে হারুনর রশীদ চরিত্রটি প্রজাদের কাছে মোটেই প্রিয়পাত্র নয়। খলিফা সব সময় নর্তকীবেষ্টিত থাকে। মশরুর তার প্রিয় পাত্র, কারণ সে সব জ্ঞান রাখে। খলিফার মনতুষ্টির জন্য তথা আমোদ-প্রমোদের জন্য সুদূর আর্মেনিয়া থেকে একশত নর্তকী আনতে দেখা যায়। আবার মহলে খলিফার স্ত্রীদের সংখ্যাও কম নয়।খলিফার অন্দরমহলে বেগম আর বাইরে নর্তকী, তবুও তার শান্তি নেই। সহায়-সম্পদ, রাণী-রাজত্ব আর নর্তকী-তবুও খলিফার মনে কোন প্রশান্তি নেই। অন্যের সুখ দেখলে ঈর্ষা হয়। এমনকি হাবশী গোলাম তাতারীর ও বাঁদী মেহেরজানের প্রশান্তিময় হাসি শুনে খলিফার ঈর্ষায় জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। খলিফার নিজের উক্তিতেই তার মনের অশান্তির স্বরুপ আমরা বুঝতে পারি। খলিফা বলছেন-‘আমি বগদাদ-অধীশ্বর, সুখ-ভিক্ষুক’।

খলিফা হিসেবে তাঁর কোন ন্যায়পরায়ণতা ছিল না। বিচার-আচার নিজের ইচ্ছামত করতো। নিজের সহোদর বোন আব্বাসাকে উজির জাফর বার্মেকীর সঙ্গে মিলিত হবার অপরাধে আব্বাসাকে মাটিতে পুঁতে হত্যা করে, আর জাফর আজমীকে কতল করে। খলিফা হারুনর রশীদ বিচারের ক্ষেত্রেও একনায়কতন্ত্রের ভূমিকা পালন করতেন। বেগম জুবায়দা মেহেরজানকে হাবশী গোলাম তাতারীর সঙ্গে বৈধভাবে শাদি দেয়। তারা গোপনে মিলিত হয়। খলিফা তাদের এ মিলন হাতেনাতে ধরে ফেলে। তখন তাদের শাদি মেনে নেয় নি। কারণ খলিফার আদেশ ছাড়া এ রাজ্যের কোন নারী পুরুষ শাদি পর্যন্ত করতে পারে না। এ অপরাধে খলিফা হারুনর রশীদ তাদের শাস্তি দেয় অত্যন্ত কৌশলে। তাতারীকে স্বাধীন করে দেয়, খলিফার ঘোষণা-‘আমি ঘোষণা করছি যে, এই মুহূর্ত থেকে হাবশী তাতারী কয়েক মুহূর্ত আগে যে গোলাম ছিল, বগদাদ শহরের পশ্চিমে আমার যে বাগিচা আছে সেই বাগিচা এবং তার যাতীয় গোলাম বান্দী, মালমত্তা, আসবাব সব কিছুর সে মালিক। তার সমস্ত লেবাস ও দিনগুজরানের খরচ আজ থেকে খাজাঞ্চিখানা বহন করবে’। আর মেহেরজানকে মহলে নিয়ে আসে। মহলে এতো বেগম ও নর্তকী থাকা সত্ত্বেও খলিফা মেহেরজানের লোভ সামলাতে পারে নি। তাই আলেম কুদ্দুসকে দিয়ে ফতোয়া তার পক্ষে জারি করে কৌশলে মেহেরজানকে বেগম করবার ব্যবস্থ্যা করে।

খলিফা হারুন নর রশীদ জীবনে ও মনে কোন শান্তি পায় নি। হাবশী গোলাম তাতারীর হাসি শোনবার জন্য ব্যাকুল থাকতো। এ জন্য তাতারীকে কতনা কিছুই দান করেছে। বগদাদ নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ নর্তকী বুসায়নাকে তাতারীর কাছে পাঠিয়েছে। কিন্তু বুসায়না তাতারীকে হাসাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই বাজিতে বুসায়না হেরে গেলে নিজেই আত্মহত্যা করে। খলিফা হারনর রশীদ এ ঘটনা জানতে পেরে তাতারীকে হত্যাকারী হিসেবে রায় দেয়। তারপর তাতারীর উপর নেমে আসে অমানষিক অত্যাচার।

উপন্যাসের কাহিনিসূত্রে বোঝা যায় যে, খলিফার সব কিছু থাকলেও একটি জিনিস তার ছিল না। সেটা হলো মনের শান্তি। গভীর রাতে তাতারী আর মেহেরজানের হাসি শুনে খলিফা কিছুটা শান্তি পেয়েছিল হয়তোবা। তাই একটু শান্তির আশায় খলিফা তাতারীকে এতকিছু দান করে একটু হাসি শোনার জন্য। কিন্তু তাতারী হাসে নি, এমনকি একটি কথাও বলে নি।। তাই খলিফা তাতারীর উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয় এবং অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। খলিফার তাতারীকে সময় দিয়েছে, কিন্তু কাজ হয়নি। এ প্রসঙ্গে খলিফার উক্তিÑএকটি জবাব দাও…একটি জবাব….একটি হাসি…আচ্ছা, হাসি জাহান্নামে যাক, একটা জবাব দাও। আমি তোমার সব অপরাধ মাফ করে দেব। যা চাও তাই পাবে। সময় দিলুম..।’

চাবুকের আঘাতে তাতারীর সমস্ত শরীর রক্তাক্ত হয়েছে, তবু হাসে নি; এমনকি একটি কথা ও বলেনি। তবে খলিফার প্রতি তাতারীর ঘৃণা জমে ছিল। খলিফা তাতারীর বিবাহিত বৈধ স্ত্রী মেহেরজানকে কেড়ে নিয়েছে এবং ভোগ করেছে। তাই তাতারী হাসতে পারে নি, হাসতে পারে না। তার পরিবর্তে খলিফার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছে। খলিফাকে তাতারী তুচ্ছার্থে তুই বলে সম্বোধন করেছে। এ প্রসঙ্গে তাতারীর উক্তিটি উল্লেখ্য-‘শোন, হারুনর রশীদ। দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে। বন্দি কেনা সম্ভব! কিন্তু-কিন্তু- ক্রীতদাসের হাসি না-না- না-’। শেষ পর্যন্তও খলিফা তাতারীর কাছ থেকে ঘৃণা ছাড়া আর কিছু পায়নি।

মন্তব্য : উপর্যুক্ত আলোচনা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, খলিফা হারুনর রশীদ শাসক হিসেবে প্রজাবান্ধব ছিলেন না। নারীর প্রতি তার যথেষ্ট আসক্তি দেখতে পাওয়া যায়। অন্দরমহলে এত বেগম থাকা সত্তেও সে দাসীর প্রতি হাত বাড়াতে এতটুকু দ্বিধা করে নি। প্রশাসনিক ও বিচারিক কাজে তার সে রকম কোন দক্ষতা পাওয়া যায় নি। একটু মনের শান্তির জন্য সব কিছু করেও শেষ পর্যন্ত সে শান্তিটুকু পায় নি। তাই এ চরিত্র এক প্রকারে হাহাকারের মধ্যেই সমাপ্ত হয়েছে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *