রস ও কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ’-আলোচনা কর। (ভাব ও রসের সম্পর্ক নির্ণয় কর)
রস ও ভাব কাব্যসাহিত্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদান। এই দুটি উপাদানের মধ্যে অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক রয়েছে। রস ও ভাব দুটি বিষয়ই অলৌকিক অর্থ্যাৎ এই দুটি বিষয় চোখে দেখা যায় না। কিন্তু অনুভব করা যায়। তাই কাব্যসাহিত্যে এই দুটি বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিষয়টি নিম্নে আলোচনা করা হলো-
‘রস’ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। √রস্+অ=রস এভাবে প্রত্যয়যোগে শব্দটি গঠিত হয়েছে। অলংকারশাস্ত্রে ‘বাক্য’ বলতে কাব্য বা কবিতাকে বোঝায়। বাক্যে রস থাকলেই তাকে কাব্য বলা যায়। রস ছাড়া কোন বাক্য কাব্য হয় না। বাংলায় অনেক রসহীন কাব্য রয়েছে। এগুলোকে চিত্রকাব্য বলা হয়। তবে এগুলো দূর্বল শ্রেণির কাব্য। উৎকৃষ্ট কাব্যে অবশ্যই রস থাকতে হবে। যে বাক্য থেকে রস আস্বাদন করা যায় তাকেই কাব্য বলা হয়। বিশ্বনাথ কবিরাজ ‘রসতত্ত্ব’ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেছেন এবং রসাত্মক বাক্যই কাব্য বলে মতামত দিয়েছেন। তাই ‘রস’ কাব্যের অপরিহার্য উপাদান। রস কাব্যের এমন একটি উপাদান যা পাঠ করে পাঠক ভাবে তন্ময় হয়ে যায়। রসের কারণেই ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ ইত্যাদি লাভ হয়। মানুষ সব সময় সুন্দরের পুজারী। মানুষ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চায়। কাব্যরস মানবমনের এই চিরন্তন সৌন্দর্যের তৃষ্ণা মেটায়। কাব্যের ভাব রসের মাধ্যমে পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। সুতরাং রস কাব্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং এই রস কাব্যের দেহে যুক্ত হয়ে পাঠকের মনে আনন্দ, বেদনা, হর্ষ, বিষাদ ইত্যাদি জাগিয়ে তুলে পাঠকের মনে তৃপ্তি সাধন করে। তাছাড়া উপমহাদেশের ধর্ম ও দর্শন শাস্ত্রের প-িতরাও রসের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের বিষয় বর্ণনা করেছেন। ব্রহ্মার স্বরুপ বিশ্লেষণে ঋষিগণ ‘রস’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
এবার ‘ভাব’ নিয়ে আলোচনা করা যায়। ‘ভাব’ সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । রসের সঙ্গে ভাবের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ‘ভাব’ ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। শব্দটি সংস্কৃত ‘ভূ’ ধাতু থেকে সৃষ্টি হয়েছে। শব্দটি প্রত্যয় যোগে গঠিত হয়েছে এভাবে √ভূ+অ=ভাব, শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো জন্ম, সৃষ্টি, উৎপত্তি ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থ হলো মানবমনের অবস্থা, অভিপ্রায়, প্রবণতা, মনের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি। অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী ‘ভাব’ শব্দ দ্বারা মানবমনের নানা রকম প্রবৃত্তিকে বোঝায়। ‘রসতত্ত্ব’-এ ‘ভাব’ শব্দ দ্বারা রতি বা নর-নারীর আসক্তি, প্রেম, অনুরাগ ইত্যাদিকে বোঝায়। অলংকার শাস্ত্রে অনেক রকম ভাব আছে। যেমন বিভাব, অনুভাব, সঞ্চারী ভাব ইত্যাদি। এ সব ভাব থেকে রসের উৎপত্তি হয়। আলংকারিকদের মতে স্থায়ীভাব নয়টি। এ গুলো : রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিষ্ময় ও শম ভাব। এ গুলো মানবমনের নানা রকম অবস্থা। কবি তো কাব্যে মনের এ সব অবস্থাই নানা রকম অলংকার-উপমা সহকারে তুলে ধরেন। পাঠক যখন কাব্য পাঠ করে, তখন তার মধ্যে এ ভাব সঞ্চার হয়, এ ভাব থেকেই রসের উৎপত্তি হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, রস ও ভাবের মধ্যে গভীর আন্তসম্পর্ক রয়েছে। এই অলৌকিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয় লেখকের লেখনী ক্ষমতার যাদুবলে। রস ও কাব্য অলৌকিক, মানুষের মনে কীভাবে রস আসে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রস বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা রসের দুটি উপাদানের কথা বলেছেন। একটি বাহ্যিক উপাদান, আর একটি মানসিক উপাদান। রসের মানসিক উপাদান হলো ভাব, যাকে ইংরেজিতে ‘ইমোশন’ বলা হয়। আর বাহ্যিক উপাদান হলো কাব্যজগৎ। কাব্যজগতের বাহ্যিক উপাদান নানা রকম ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানবমনে রসে রুপান্তরিত হয়। সুতরাং রস জিনিসটি লৌকিক বস্তু নয়, রস অলৌকিক একটি ব্যাপার। কিন্তু রস ভাবে রুপান্তরিত হলে তা লৌকিক হয়। বিষয়টি একটি উদাহরণের সাহায্যে আলোচনা করা যেতে পারে। শোক একটি মানসিক ভাব। এই শোকের নিশ্চয়ই একটি কারণ আছে। পৃথিবীতে নানা কারণে মানুষের মনে শোক জেগে উঠে, আমরা শোকাহত হই। এই লৌকিক শোকের বিষয় ও কারণ নিয়ে কবি প্রতিভাগুণে কাব্যে একটি অলৌকিক চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। তখন পাঠকের মনে করুণ রসের উদয় হয়। যেমন : মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ কাব্যে করুণ রস ও বীর রস রয়েছে। মেঘনাদের মৃতদেহ সাগরতীরে দাহ করার সময় প্রমীলা সহমরণে যায়। তখন পাঠকের মনে করুণ রসের সৃষ্টি হয়। এই করুণ রস পাঠকের চোখে জল নিয়ে আসে। আবার পাঠকের মনে অপূর্ব আনন্দও দেয়। উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ট্ট্যাজেডি নাটকগুলো এবং ইডিপাস ট্ট্যাজেডি পাঠকের মনে করুণ রসের সৃষ্টি করে। কখনো কখনো পাঠকের চোখে জল আসে, পাঠকের হৃদয় বেদনায় নীল হয়-এ সবই সত্য এবং অলৌকিক। আবার এই বিষয়টিও সত্য যে, বিশ্ববিখ্যাত এই ট্ট্যাজেডিগুলো পাঠকমনে আনন্দেরও সঞ্চার করে। তাই রস ও ভাব দুটি পৃথক বিষয় হলেও এদের ভেতরের অত্যন্ত গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কবিগণ কাব্যসাহিত্যে প্রতিভার অসীম ক্ষমতাগুণে এই অলৌকিক সম্পর্ক নির্মাণ করেন। তাই আলংকারিকেরা বলেন, রস ও কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ।