চোখের বালি উপন্যাস অবলম্বনে মহেন্দ্র চরিত্রটি আলোচনা কর।
বাংলা সাহিত্যে একমাত্র নোবেল বিজয়ী লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তিনি মোট তেরটি উপন্যাস রচনা করেছেন। তার মধ্যে ‘চোখের বালি’ (১৯০৬) অন্যতম। এটি কাহিনী প্রধান নয়, চরিত্র প্রধান উপন্যাস। বিভিন্ন চরিত্রের গতি প্রকৃতি এ উপন্যাসে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মহেন্দ্র এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নায়ক চরিত্র। প্রসঙ্গক্রমে আমরা এখন মহেন্দ্র চরিত্রটি আলোচনা করব।
মহেন্দ্রের পরিচয় সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়-সে শৈশবে পিতৃহীন, রাজলক্ষ্মীর সন্তান, বয়স প্রায় বাইশ বছর, এম.এ পাশ করেছে, তারপর ডাক্তারি পড়া শুরু করেছে। যথেষ্ট বয়স ও উচ্চ শিক্ষিত হলেও মানসিক পরিপক্বতা এখনও আসেনি। তাই সব কাজে এখনও মায়ের ওপর নির্ভরশীল। সঙ্গতকারণেই লেখক তাকে ‘ক্যাঙারু শাবক’ এর সাথে তুলনা করেছেন। মহেন্দ্র আলালের ঘরের দুলালের মতো। নিজের ইচ্ছা ও মতামতকে বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্যের মতামত যৌক্তিক হলেও তার কাছে মূল্যহীন। মহেন্দ্র জেদিস্বভাবের চরিত্র।
স্বেচ্ছাচারীতা,ঘামখেয়ালীপনা মহেন্দ্র চরিত্রের একটি বিশেষ দিক। নিজের পছন্দ আর স্বার্থের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। মনমতো না হলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাই রাজলক্ষ্মীর পছন্দের মেয়ে বিনোদিনীকে মহেন্দ্র বিয়ে করতে অস্বীকার করে। আশাকেও প্রথমে বিয়ে করতে অস্বীকার করে, কিন্তু দেখাশুনার পর মহেন্দ্র চিরকালের বন্ধু বিহারীকে বঞ্চিত করে নাটকীয় কাহিনীর মধ্যদিয়ে আশাকে বিয়ে করে। মহেন্দ্র তার কোন ইচ্ছাকে অপূর্ণ রাখতে চায়না।
বিয়েরপর মহেন্দ্র চরিত্রের নতুন পর্ব উন্মোচিত হয়। মহেন্দ্র যে কতটা স্ত্রৈণ স্বভাবের দুর্বল পুরুষ চরিত্র,তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আশার জন্য স্লেট, খাতা, চারুপাঠ কিনে আনে আর লেখাপড়ার অজুহাতে স্ত্রীকে কাছে বসিয়ে রাখে। পত্মীপ্রেমে সে অসংযত, অসংযমী, অন্ধ। লোলুপতা, নারীআসক্তি তার চরিত্রের অন্যতম দিক। প্রকাশ্যে দাম্পত্যলীলায় মেতে থাকে। মহেন্দ্র ব্যাহায়াপনার সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছে এবং লজ্জ্বার মাথা খেয়ে রাজলক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে বলে-“বউকে ঘরের কাজে আমি দাসীর মতো খাঁটিতে দিতে পারিনা।” পত্নী প্রেমের বাড়াবাড়িতে মহেন্দ্র সে বছর ডাক্তারি পরীক্ষায় ফেল করল।
আত্মঅহংকার মহেন্দ্র চরিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এই আত্মগৌরবে মহেন্দ্র বিনোদিনীর সাথে সৌজন্যমূলক সাক্ষাত পর্যন্তও করেনি। কিন্তু চৌদ্দতম অনুচ্ছেদে মহেন্দ্র আত্মগৌরব বিসর্জন দিয়ে বিনোদিনীর কাছে আসে। এ প্রসঙ্গে লেখকের উক্তি- “এমনি করিয়া ছবি তুলিতে তুলিতে আলাপ বহুদূর অগ্রসর হইয়া গেল।” পূর্বে একবার মহেন্দ্র ফটোগ্রাফ শিখতে শুরু করেছিল। বিনোদিনীকে দেখে আবার ফটোগ্রাফ শেখার নেশা চাপে। মহেন্দ্রের প্রেম এ শখের নেশা থেকে উৎপত্তি। বিনোদিনী তার নিটোল যৌবনের মায়াবী ফাঁদ পাতে, আর মহেন্দ্র উড়ে চলা কীটপতঙ্গের মতো সে ফাঁদে ধরা দেয়। মহেন্দ্র মুখে বলে, আমি বিনোদিনীকে ভালবাসিনা কিন্তু পরমুহূর্তে মহেন্দ্রের হৃদয়ে অনুতাপের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
আশা কাশি যাওয়ায় মহেন্দ্র লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। পত্নীপ্রেম শূন্যে নেমে যায়্, মহেন্দ্র পরনারীর প্রতি নেশাগ্রস্ত। বিনোদিনীর দেহ ভরা যৌবনের মোহে মহেন্দ্র ঘর-সংসার,দাম্পত্যজীবন, মা, কাকীমা, বন্ধু সবাইকে পরিত্যাগ করার মত অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত নেয়। বিনোদিনীকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে কোলকাতার পটলডাঙ্গার বাসায় ওঠে। ঘরে অসুস্থ্য মাকে রেখে মহেন্দ্রে নির্লজ্জভাবে পটলডাঙ্গার বাসায় বিনোদিনীর সাথে দেখা করতে যায়।
মহেন্দ্র যে কোন মূল্যে বিনোদিনীকে পেতে চায়। বিনোদিনী তাকে চম্বুকের মত আকর্ষণ করে কিন্তু ধরা দেয় না। মহেন্দ্র বিহারীর বাসায় বিনোদিনীর হাতের লেখা একটি চিঠি পায়। তারপর মহেন্দ্রের মোহ ভঙ্গ হয়। মহেন্দ্র এতক্ষণে বুঝতে পারল বিনোদিনী বিহারীকে পাওয়ার জন্য মহেন্দ্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে মাত্র। তাই মহেন্দ্র ভগবানের কাছে তার মৃত্যু কামনা করে। এখানে মহেন্দ্র চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বিবর্তন দেখা যায়। অনেক দেরিতে হলেও মহেন্দ্র চরিত্রের আত্ম উপলব্ধি ঘটেছে।
উপন্যাসের শেষে দেখা যায়-মহেন্দ্র ব্যাংক থেকে টাকা তুলে মা রাজলক্ষী, আর স্ত্রী আশার জন্য নতুন কিছু কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। মহেন্দ্রকে এলাহাবাদের দোকানে দোকানে ঘুরতে দেখা যায়। মহেন্দ্র নিজের অপকর্মের প্রকৃতি অনুধাবন করছে। অন্নপূর্ণার কাছে নিজেকে পাপিষ্ঠ বলে পরিচয় দেয়। অত্যন্ত দূর্বল ব্যক্তিত্ব আর কাপুরুষিত আচরণের জন্য মহেন্দ্রের হৃদয় আজ ক্ষত-বিক্ষত। এই ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় নিয়ে আশার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। বিহারীর বন্ধুত্বের মর্যাদা পুনপ্রতিষ্ঠিত করে আর জন্ম দুঃখিনী মায়ের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চায়।
উপসংহারে বলতে চাই-মহেন্দ্র যতই আত্মগৌরব ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে,ততই ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদা হারিয়ে কাপুরুষে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ পথ চলতে চলতে ফুরিয়ে যাওয়াই মহেন্দ্র চরিত্রে বৈশিষ্ট্য। তবুও মহেন্দ্র চরিত্রটি বাংলা কথা সাহিত্যে অতুলনীয়।