মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলির প্রধান কবিদের অবদান আলোচনা কর। অথবা, বৈষ্ণব পদাবলিরউদ্ভব/বিকাশ/সামাজিক-সাস্কৃতিক পটভূমি)
বৈষ্ণবপদাবলি মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা। পদাবলি সাহিত্য চৈতন্য-প্রবর্তিত বৈষ্ণব মতকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু এ পদ সাহিত্য চৈতন্যজন্মের পূর্বেই উদ্ভব হয়। রাধা এবং কৃষ্ণকে অবলম্বন করে এ পদসাহিত্য রচিত হয়েছে। নি¤েœ বৈষ্ণব পদাবলির উদ্ভব, বিকাশ ও প্রধান প্রধান কবিদের অবদান আলোচনা করা হলো-
পদাবলি সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ কোন এক সময়ে হয় নি। বাংলাদেশে মুসলিম শাসন জারি হওয়ার পর দেশে রাজনৈতিক অবস্থার যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন হয়। হিন্দু সমাজের কৌলিন্য প্রথা, ব্রাহ্মণ্য সংস্কার নানাবিধ সামাজিক বিধি-বিধান মানুষের নিকট অসহনীয় ছিল। জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা বাঙালি সমাজ জীবনকে বিষিয়ে তুলেছিল । দেবতার ভোগে অধিকার ছিল না সাধারণ মানুষের। ফলে ধর্মীয় পরিমন্ডলে একাধিপত্য বিস্তার করেছিল ব্রাহ্মণ কায়স্থ সম্প্রদায়। সংখ্যায় তারা ছিল অল্প, কিন্তু ক্ষমতা ও প্রতাপে তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তারা সেন আমলের উত্তরাধিকার বহন করে চলছিল। আর সাধারণ মানুষ লোককথা, লোকজীবনের ধারা জীবন ও সংস্কৃতিতে অনুশীলন করতো। ফলে দুটি ধারা বাঙালি সমাজে প্রচলিত ছিল। একটি স্মৃতিশাস্ত্র, অন্যাটি লোককথা। ক্রমে স্মৃতিশাস্ত্র দূর্বল হয়ে যায় এবং লোকসংস্কৃতির ধারা প্রবল হয়ে ওঠে। এই ধারায় মিশেছে বৌদ্ধ মতবাদ এবং সুফি চিন্তাধারা। প্রেম মানুষের সবচেয়ে বড় প্রেরণা, আর এই প্রেমধারায় উৎসারিত হয়েছে আধ্যাত্বিক চিন্তা ও মানবিক আত্মার আনন্দ থেকে। এ দু ধারার সম্মিলন লক্ষ্য করা যায় বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যে। বৈষ্ণব মতবাদী সম্প্রদায় রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে আধ্যাত্মিক পরিমন্ডলে স্থাপন করে জীবত্মা ও পরমাত্মার সন্ধান করেছেন।
বৈষ্ণব পদাবলির উদ্ভবকাল চৈতন্যজন্মের পরে নয়, আগে। পদাবলির যে প্রেম কথা বর্ণিত হয়েছে তা ব্যক্তি হৃদয় থেকে মুক্ত নয়। কবিরা ছিলেন স্বকালের সাক্ষী। তাই তাঁদের কাব্যে ধর্মীয়চেতনার পাশাপাশি মানবিকবোধ উচ্চকিত হয়েছে। ধর্মীয়চেতনা শাস্ত্রশাসেেনর অনুপাত নয়। একান্তই লৌকিক ও জীবন সম্পৃক্ত। নামে রুচি জীবে দয়া- এটাই বৈষ্ণব মতবাদের মূলকথা। বৈষ্ণব পদাবলি বলতে আমরা চৈতন্যপূর্ববতী, সমসাময়িক এবং এর পরবর্তী সময়ে রচিত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কবিতাকে বুঝি। সুতরাং বৈষ্ণব পদাবলির বিশিষ্ট কবিদের মধ্যে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দ দাস ও জ্ঞানদাস অন্যতম। নিম্নে প্রধান প্রধান কবিদের অবদান আলোচনা করা হলো-
বিদ্যাপতি : বিদ্যাপতি মিথিলার কবি ছিলেন। তিনি ব্রজবুলি ভাষায় কবিতা রচনা করতেন, পঞ্চদশ শতকে জন্মগ্রহণ করেন, প্রায় শত বছর জীবিত ছিলেন। তাঁর জন্ম চৈতন্য আবির্ভাবের পূর্বে, তিনি সংস্কৃত ভাষায় প-িত ছিলেন। ‘কবিকণ্ঠহার’ তাঁর উপাধি। তাঁর রচিত পদগুলি রাধাকৃষ্ণের রুপকে নরনারীর প্রেম-মিলন বিরহের গান। মিথিলার কবি হয়েও তিনি বাঙালিদের কাছে বাঙালি কবি হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন।
চণ্ডীদাস : পদাবলি সাহিত্যে বিদ্যাপতির পরেই চ-ীদাসের নাম স্মরণযোগ্য। তিনি যে সব পদ রচনা করেন তা যেমন শিল্পসার্থক তেমনই রসে ভরা। তাঁর পদের ভাষা সহজ, ভাব গম্ভীর। সহজ প্রাণের সহজ কথাটি সহজ নিরাভরণ ভাষায় বাণীরুপ দিয়েছেন চণ্ডীদাস । তাঁর পদে বেদনার সুর প্রধান। সৌন্দর্য বর্ণনায় তিনি সহজ, রাধার আক্ষেপ বর্ণনায় কবি লিখছেন-
সই, কেমনে ধরিব হিয়া
আমার বধূয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া।
গোবিন্দ দাস: গোবিন্দ দাসকে বলা হয় বিদ্যাপতির ভাবশিষ্য। তিনিও ব্রজবুলি ভাষা ব্যবহার করেছেন। ভাব, ভাষা অলংকার প্রয়োগে তিনি বিদ্যাপতিকে অনুসরণ করেছেন। তাঁর রচিত অভিসারের পদগুলো শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। অভিসারের পদ রচনায় গোবিন্দ দাস অদ্বিতীয়।
জ্ঞানদাস: পদাবলি সাহিত্যে জ্ঞানদাস অনন্য প্রতিভার অধিকারি ছিলেন। তাঁকে চ-ীদাসের ভাবশিষ্য বলা হয়। তিনি ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি জন্মগ্রহণ করেন। জ্ঞানদাস বাংলা ও ব্রজবুলি উভয় ভাষাতেই পদ রচনা করেন। জ্ঞানদাসের পদগুলো সহজ, সরল, ও অলংকারবিহীন। যেমন-
সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল।
অমিয় সাগরে সিনান করিতে
সকলি গরল ভেল।
এ চারজন পদকর্তা ছাড়াও আরও অসংখ্য কবি বৈষ্ণবপদ রচনা করেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- বলরাম দাস, যদুনন্দন, নরোত্তম দাস, কবি রঞ্জন, বংশীদাস প্রমুখ।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।