ভারতচন্দ্র নাগরিক কবি-আলোচনা কর। 221003

ভারতচন্দ্র নাগরিক কবি

ভারতচন্দ্র নাগরিক কবি-আলোচনা কর। অথবা, (লৌকিক জীবনধারা/মধ্যযুগের প্রথম নাগরিক কবি/নাগরিক রস বিধৃত)

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে তিনটি যুগে ভাগ করা যায়। প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ। মধ্যযুগের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর (১৭১২-১৭৬০)। তিনি মধ্যযুগের সর্বশেষ বিখ্যাত কবি। ব্যক্তিগত জীবনেরও তিনি আধুনিক মনের মানুষ ছিলেন। সাহিত্যেও আধুনিকতার ছাপ পড়েছে। তিনি অন্নদা মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন । কিন্তু আঙ্গিক ও কাব্যবৈশিষ্ট্যে অনেকাংশে আধুনিক যুগের মত কিছু বৈশিষ্ট্য তার কাব্যে বিদ্যমান আছে। এ কারণে বিশ্লেষকরা তাকে নাগরিক কবি বলে থাকেন। সমকালীন সময়, সমাজ, সমাজের মানুষ ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রকৃতির সুন্দর বর্ণনা তাঁর কাব্যে পাওয়া যায়। নিম্নে ভারতচন্দ্রের কাব্যের নাগরিক গুণ আলোচনা করা হলো-

ভারতচন্দ্র রাজসভার কবি। তিনি কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। মাসে চল্লিশ টাকা বেতন পেতেন। তাই সঙ্গকারণেই মধ্যযুগের কবি হলেও তিনি সমকালীন সময় ও মানুষের যাপিত জীবন সম্পর্কে ভালোভাবে জানতেন। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি নবাবী আমলের কবি। পলাশীর যুদ্ধের কয়েক বছর পরে মৃত্যুবরণ করেন। সুতরাং তার জীবনকাল নবাবী আমলেই কেটেছে। সময়ের পরিক্রমায় এটি মধ্যযুগ হলেও আধুনিক সময়ের বৈশিষ্ট্য সমাজ ও মানুষের মধ্যে আস্তে আস্তে প্রতিফলিত হচ্ছে।এই বিষয়টিই তার কাব্যে বিকশিত হয়েছে। ভারতচন্দ্র বেশ কয়েকটি কাব্য ও নাটক রচনা করেছেন। এর মধ্যে ‘মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যান’ অন্যতম। এ কাব্যে যে সব চরিত্র রয়েছে তন্মধ্যে মানসিংহ, ভবানন্দ মজুমদার, সম্রাট জাহাঙ্গীর, রাজা প্রতাপাদিত্য, দেবী অন্নদা, ঈশ্বরী পাটুনী, হরিহর, নলকুবর, দাসু-বাসু, সাধী-মাধী, চন্দ্রিনী, পদ্মিনী ইত্যাদি।
‘মানসিংহ ভবানন্দ উপাখ্যান’ মূলত একটি মঙ্গলকাব্য। কবি এই কাব্যে দেবী অন্নদার মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন। কিন্তু ভারতচন্দ্র শুধু দেবীকে নিয়েই খুশি থাকেননি। এর সঙ্গে সমাজের সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, চাওয়া-পাওয়া এই কাব্যে সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। কাব্যের শুরুতেই আমরা নলকূবরের নারী সম্ভোগের চিত্র দেখতে পাই। এটি সর্গের ঘটনা। দেবী এক বসন্তরাতে ভরা জ্যোৎ¯œায় সখি বিজয়াকে সঙ্গে করে ভ্রমণে বেড়িয়েছেন। তিনি দেখতে পেলেন যে, নলকূবের চন্দ্রিনী-পদ্মিনী নামে দুই নারী নিয়ে বাগানে আমোদ-প্রমোদ করছেন। নলকূবেরের নারী সম্ভোগের বর্ণনা থেকে আমরা আধুনিক মানুষের পরিচয় পাই। দেবী অন্নদা পুজা প্রার্থনা করলে নলকূবের উত্তরে সরাসরি বলে দিয়েছে যে, এই যুবক বয়সে নারী রস সম্ভোগের সময়, এখন পুজার সময় নয়। এই বক্তব্যটি সবচেয়ে আধুনিক মনের পরিচয় বহন করে। কবিতার মাধ্যমে নলকূবেরের বক্তব্যটি এখানে উপস্থাপন করতে চাই-

এ সুখ যামিনী এ নব কামিনী
এ আমি নব যুবক।
এ রস ছাড়িয়া পূজায় বসিয়া
ধ্যানে রবে যেন বক।

মানুষ শোষণ-বঞ্চনার শিকার ছিল। সমাজে বর্গির উপদ্রব ছিল। তাছাড়া সামন্ত প্রভূরা সমাজের মানুষের উপর অন্যায়ভাবে শোষণের মাত্র বাড়িয়ে দেয়। এই অবস্থায় মানুষের স্বাভাবিক জীবন অতিষ্ঠ ছিল। মানুষের দুবেলা খেয়ে পড়ে বাঁচবার মতো অবস্থা ছিল না। তাই দেবী অন্নদার কাছে ঈশ্বরী পাটুনীর আবেদন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আগামী প্রজন্ম যাতে সুখে থাকে এই কামনাই ঈশ্বরী পাটুনীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ঈশ্বরী পাটনী দেবী অন্নদার কাছে বলেছে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’, যে কোন বিচারে এই উক্তিটি সর্বাংশে একজন আধুনিক সমাজের আধুনিক মানুষের।

ভারতচন্দ্র কাব্যচর্চাকালীন সময়ে রাজসভায় বসবাস করেছেন। তাই রাজসভার মানুষের বিচিত্র কর্মকা- দেখেছেন, তিনি নগরের মানুষ ও তাদের নাগরিক জীবনচিত্র উপলব্ধি করেছেন। যারা গ্রামীণ মানুষ তাদের চিন্তা ও চেতনায় নাগরিকসুলভ ভাবনা ফুটে উঠেছে। নিজের জীবনের সুখ-শান্তিই মানুষের কাছে মুখ্য হয়ে উঠেছে-এটা একই সঙ্গে নাগরিক মানুষের ভাবনা ও সেই সাথে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি । মানসিংহ রাজা প্রতাপাদিত্যকে বন্দি করে দিল্লিতে নিয়ে যায়। সঙ্গে যায় ভবানন্দ মজুমদার আর দাসু ও বাসু নামের দুই চাকর। তারা কিছু উপহার-উপঢৌকন পাবে এমন আশা ছিল। কিন্তু বাস্তবে হিতে বিপরীত ঘটে। স¤্রাট জাহাঙ্গীর তাদের বন্দি করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। দাসু-বাসু প্রবাসে এসে অনেক কষ্ট করে, মনে মনে তাদের স্ত্রীকে তারা অনুভব করে, দাসু-বাসু স্ত্রীর বিরহে দুঃখভোগ করে। সারা দিন পরিশ্রম করে রাতে স্ত্রীকে কাছে নিয়ে যারা বিছানায় ঘুমাতে যায়, তারাই সুখী মানুষ-এই রকম মানসিকতা দাসু-বাসুর উক্তিতে পাওয়া যায়। এখানে প্রাসঙ্গিক কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করতে চাই-দিবসে মজুরি করে রজনীতে গিয়া ঘরে/নারী লয়ে যে থাকে সে সুখী।

ভারতচন্দ্রের কাব্যবৈশিষ্ট্য মঙ্গলকাব্যের অনান্য কবিদের থেকে আলাদা। এখানে ভারতচন্দ্র অধিক যুক্তশীল, শৈল্পিক বিচারে তাঁর কাব্য এক অনন্য মাত্রা লাভ করেছে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে কাব্যশৈলির কিছুটা নমুনা দিতে চাই। ‘এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয় –

যার নামে পার করে ভব পারাবার
ভাল ভাগ্য পাটুনী তাহারে করে পার
ঈশ্বরের নূর বলি দাড়ির যতন
টিকি কাটি নেড়া মাথা এ যুক্তি কেমন

এ সমস্ত উক্তি থেকে দেখা যায় যে, ভারতচন্দ্রের কাব্যরুচি মঙ্গলকাব্যের কবিদের থেকে স্বতন্ত্র ও আধুনিক।

উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের কবি কি›তু তাঁর কাব্যে আধুনিক মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। কবি দেবী অন্নদার মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। সেই সাথে চরিত্রগুলোকে নাগরিক করে তুলেছেন। কবি ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। নতুন জীবনবোধ, নতুন ভাবধারা, জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করবার প্রচেষ্টা সর্বপ্রথম ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেখা যায়। নবনির্মিত আর্থ সামাজিক ও বাংলার মানুষের চেতনাগত ইতিবাচক পরিবর্তন ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেখা যায়। তাই সার্বিক-বিচার বিশ্লেষণে ভারতচন্দ্রকে নাগরিক কবি বলা হয়ে থাকে।

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *