ভাব কী? ভাবের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর?
ভাব সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শব্দটি সংস্কৃত ‘ভূ’ ধাতু থেকে সৃষ্টি হয়েছে । শব্দটি প্রত্যয় যোগে গঠিত হয়েছে এভাবে √ভূ+অ=ভাব, ‘বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ অনুয়ায়ী শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো জন্ম, সৃষ্টি, উৎপত্তি ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থ হলো মানবমনের অবস্থা, অভিপ্রায়, প্রবণতা, মনের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি। অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী ভাব শব্দ দ্বারা মানবমনের নানা রকম প্রবৃত্তিকে বোঝায়। ‘রসতত্ত্ব’-এ ‘ভাব’ শব্দ দ্বারা রতি বা নর-নারীর আসক্তি, প্রেম, অনুরাগ ইত্যাদিকে বোঝায়। ড. সুধীর কুমার দাশগুপ্ত ভাব শব্দ দ্বারা নর-নারীর প্রেমসম্পর্কিত অনুভূতি ও শোক বুঝিয়েছেন। ড. সুশীল কুমার দে ‘History of Sonskrit Poeties’ নামক গ্রন্থে ‘ভাব’ শব্দটির ইংরেজি ‘Emotion’ উল্লেখ করেছেন। সুতরাং ‘ভাব’ হলো মানবমনের বিশেষ অলৌকিক অনুভূতি যা এক সময়ে অলৌকিক থেকে লৌকিকে রুপান্তরিত হয়।
ভাবের প্রকারভেদ :
ভাব প্রধানত দুই প্রকার : নিম্নে দুই প্রকার ভাবের বিস্তারিত আলোচনা পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করা হলো :
স্থায়ী ভাব : মানবমনে নানা রকম ভাবের জন্ম হয়। এ সব ভাবের মধ্যে কোনটা তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত হয়, আবার কোনটা চিরকাল স্থায়িভাবে মনের গভীরে রয়ে যায়। যে ভাবগুলো স্থায়ীভাবে মনে রয়ে যায়, তাকে স্থায়ী ভাব বলে। আলংকারিকদের মতে স্থায়ীভাব নয়টি। এ গুলো : রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিষ্ময় ও শম ভাব।
সঞ্চারী ভাব : যে ভাবগুলো মানবমনে স্থায়ী হয় না, তাকে সঞ্চারী ভাব বলে। সঞ্চারীভাবকে ব্যভিচারীভাব বলা হয়। সঞ্চারীভাবের মাধ্যমেই স্থায়ীভাব রসে পরিণত হয়। মানবমনে নানা রকম ভাবের জন্ম হয়। এ সব ভাবের মধ্যে একটি ভাব প্রধান হয়ে উঠে, আর অন্য ভাবগুলো অপ্রধান হয়ে যায়। এই অপ্রধান ভাবই সঞ্চারী ভাব। কবি লালমোহন একটি কবিতার মাধ্যমে ৩৩টি সঞ্চারী ভাবের উল্লেখ করেছেন। এ মধ্যে আবেগ, বিষাদ, হর্ষ, দৈন্য, চিন্তা, জড়তা অন্যতম।
তাছাড়া অলংকারশাস্ত্রে আরো ২ প্রকারের ভাব আছে। এ গুলো হলো : ১. বিভাব ২.অনুভাব
বিভাব : অলংকার শাস্ত্র অনুযায়ী যে বিষয়ের কারণে মানবমনে রসের উৎপত্তি ঘটে, সহজ কথায় তাকে বিভাব বলে। যেমন : কোন অন্যায় কাজ দেখলে ক্ষুব্ধ হই, কারো মৃত্যুশোক দেখলে আমরা ব্যথিত হই, রাধা-কৃষ্ণের যমুনার জলে মিলনের কথা পড়লে আমাদের মনে রতিভাব জাগে।
বিভাব ২ প্রকার :
(ক).আলম্বন : যে বস্তুকে অবলম্বন বা আশ্রয় করে রসের জন্ম হয়, তাকে আলম্বন বিভাব বলে। ‘শকুন্তলা’ নাটকে রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা একে অপরকে দেখে এবং তাদের মধ্যে প্রেমভাব জেগে উঠে। তাই রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলা একে অপরের আলম্বন বিভাব।
(খ).উদ্দীপন বিভাব : যার দ্বারা রস সৃষ্টির অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাকে উদ্দীপন বিভাব বলে। যেমন : ‘মেঘদূত’ কাব্যে বর্ষা যক্ষের মনে বিরহ সৃষ্টি করে। বর্ষা এখানে উদ্দীপন বিভাব।
অনুভাব : স্থায়ীভাবের প্রভাব ও লক্ষণকে অনুভাব বলে। অন্যভাবে বলা যায়, স্থায়ীভাবের লক্ষণ যা থেকে রসের উৎপত্তি হয়, তাই অনুভাব। যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাসররাত সম্পর্কে কবিতায় বলেছেন :
দ্বিধাজড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্র নেত্রপাতে
স্মিত হাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসর শয্যাতে
স্তব্ধ অধরাতে
এই উদাহরণ দ্বারা বোঝা যায় যে, বাসর রাতে নায়ক-নায়িকার মধুর মিলনে নায়িকার লজ্জার ভাবটি যে লক্ষণ দ্বারা প্রকাশ পায়, তাই অনুভাব।