বৈষ্ণব সাহিত্যে রস কত প্রকার ও কীকী? আলোচনা কর।

অনার্স ৩য় বর্ষ
অনার্স ৩য় বর্ষ

বৈষ্ণব সাহিত্যে রস কত প্রকার ও কীকী? আলোচনা কর।

 ‘রস’ কথাটির সাধারণ অর্থ -‘স্বাদ’ অর্থাৎ যে স্বাদ আমরা আস্বাদন করি তাই রস। এক কথায় বলতে গেলে আস্বাদনই রস। সাহিত্যের রস আস্বাদন করতে হয় অন্তরের অনুভূতি দিয়ে। সাহিত্যের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আনন্দ দান, রস সৃষ্টি। রসের ব্যঞ্জনাই বাক্যকে কাব্যরূপ দান করে। রস সম্পর্কে নানা প-িত নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। প্রাচীন প-িত ও মনীষী আচার্য ভরতমুনি তাঁর ‘নাট্যশাস্ত্র’ গ্রন্থে আমরা যাকে ‘রস’ বলেছি, সেই ‘রস’ বলতে তিনি ‘নাট্যরস’ কেই বুঝিয়েছেন। সংস্কৃত প-িত আনন্দবর্ধন ভরতমুনির নাট্যরসকে কাব্যরস বলে গ্রহণ করে বলেছেন, ‘রস যেমন নাট্যের প্রাণ, তেমনই কাব্যেরর প্রাণ’।

আরেকজন বিখ্যাত সংস্কৃত প-িত আচার্য বিশ্বনাথ কবিরাজ রস সম্পর্কে বলেছেন ‘বাক্যং রসাত্মং কাব্যং’ অর্থাৎ কাব্য হচ্ছে সেই বাক্য ‘রস’ যার আত্মা। সুতরাং বলা যেতে পারে, মনের রসনায় আস্বাদিত হয়ে যা হৃদয়কে দ্রবীভূত করে, আনন্দময় মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করে-তাকেই রস বলে।

রসের শ্রেণিবিভাজন :

১.শৃঙ্গার রস : রতি স্থায়ীভাব থেকেই শৃঙ্গার রসের উৎপত্তি। নারী-পুরুষের পরষ্পর আকর্ষনমূলক ভাবকে অবলম্বন কওে যে রসের উৎপত্তি হয় তাকে আদি রস বা শৃঙ্গার রস বা মধুর রস বলে। বিশ্বনাথ কবিরাজের মতে-‘প্রিয়বস্তুর প্রতি মানবমনের সহজ অনুরাগই রতি’। শৃঙ্গার রসের উদাহরণ :‘তোমারেই যেন ভালো বাসিয়াছি শতরুপে শতবার’।

২.বীর রস : দেশপ্রেম, দয়া, ধর্ম, দান, সংগ্রাম প্রভৃতি ভাবকে অবলম্বন করে যে রস সৃষ্টি হয় বীর রস বলে। ভরতমুনি বীররসকে দানবীর, ধনবীর, এবং যুদ্ধবীর এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। বিশ্বনাথ কবিরাজ এর সঙ্গে ‘দয়াবীর’ যোগ করেছেন। বীর রসের উদাহরণ : বল বীর/ বল উন্নত মম শির/ শির নেহারি, আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির’।

৩.করুণ রস : বিয়োগজনিত কারণে শোক নামে যে স্থায়ী ভাবের সৃষ্টি হয় তাকে করুণ রস বলে। মানবজীবনে দুঃখ, কষ্ট, শোক, হতাশা, যখন অবধারিত হয়ে ওঠে তখন তার হৃদয় স্বাভাবিকভাবে শোকভাবে বারাক্রান্ত হয়। লৌকিক জীবনের এ শোকই কাব্যসাহিত্যে করুণরসের সৃষ্টি করে, যা পড়লে বা শুনলে দর্শকহৃদয়ও শোকে আপ্লুত হয়। করুণরসের উদাহরণ : ‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে / অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।’

৪.অদ্ভুত রস : যে রস বিস্ময় সৃষ্টি করে চিত্তকে অভিভূত বা আপ্লুত করে তাকে অদ্ভুত রস বলে। বিস্ময় স্থায়ীভাব থেকে অদ্ভুত রসের সৃষ্টি। অদ্ভুত কোনো বিষয় এ রসের আলম্বন বিভাব এবং এ বিষয়ের নানা তাৎপর্য অদ্ভুত রসের উদ্দীপন বিভাব। উদাহরণ : ‘দুধে জলে বিশ মন করিল জলপান / আশি মন খানা পুন খায় সোনাভান।’

৫.বীভৎস রস : ঘৃণার স্থায়ীভাব থেকে বীভৎস রসের সৃষ্টি। মানুষ যখন কোন অরুচিকর বিষয় বা বস্তু দেখে বা শুনে তখন তার মধ্যে ঘৃণার ভাব জেগে ওঠে। এ ঘৃণাজনিত ভাবকে অবলম্বন করে যে রসের উদয় হয়, তাকে বীভৎস রস বলে।

৬.রৌদ্র রস : ক্রোধের ভাবকে অবলম্বন করে যে রস গড়ে ওঠে তাকে রৌদ্র রস বলে। ‘ক্রোধ’ স্থায়ীভাব থেকে রৌদ্ররসের সৃষ্টি হয়। সাধারণত প্রতিপক্ষ শত্রু এর আলম্বন বিভাব এবং এর চেষ্টাদি উদ্দীপন বিভাব বলে ধরে নেওয়া হয়। কোন অন্যায় অপরাধীর প্রতি স্বাভাবিক রাগ বা ক্রদ্ধভাব থেকেই এ রসের সৃষ্টি।

৭.শান্ত রস : যে রস সুখ, দুঃখ, রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি সর্ববিধ মনেবৃত্তিতে বিমুখ বৈরাগ্যমূলক ভাব থেকে উৎপন্ন হয় তাকে শান্ত রস বলে। পরম শান্তি ও নির্মোহ অনুভূতি থেকেই এ রসের উৎপত্তি। যেমন : ‘আামার মাথা ন’ত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে।’

৮.ভয়ানক রস : ভয় স্থায়ীভাব থেকে ভয়ানক রসের সৃষ্টি হয়। ভয় থেকে সৃষ্ট আমাদেও চিত্তগত ভীতি-ভাবটি যখন কাব্যে আস্বাদন হয়ে ওঠে, তখন তাকে ভয়ানক রস বলে। বিভীষিকা এর আলম্বন বিভাব এবং ভয়জনিত চেষ্টা ইত্যাদি এর উদ্দীপন বিভাব। উদাহরণ : ‘অবহেলি জলধির ভৈরব গর্জন / প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জন’।

৯.হাস্যরস : হাস্যভাব থেকে যে রস সৃষ্টি হয় তাকে হাস্য রস বলে। বিকৃত চেহারার বর্ণনা, অসামঞ্জস্যপূর্ণ কা-কারখানা নিয়ে লেখাকে কেন্দ্র করে হাস্যরস উৎপন্ন হয়। সংস্কৃত নাটকে এবং যাত্রার ভাঁড় এর চরিত্র সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এ রকম হাস্যরস সৃষ্টি হয়। যেমন : ‘সফদার ডাকতার মাথাভরা টাক তার / ক্ষিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে / চেয়ারেতে রাতদিন, বসে গ’ণে দুইতিন / পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *