গীতিকবিতার সংজ্ঞাসহ এর বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর। (গীতিকবিতার শ্রেণিবিভাগ)
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে সব সাহিত্য রচিত হয়েছে তন্মধ্যে গীতিকবিতা সবচেয়ে সমৃদ্ধ শাখা। গীতিকবিতা কেবল বাংলা সাহিত্যে নয়, বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ। মধ্যযুগ ছাড়া আধুনিক যুগেও অনেক গীতিকবিতা রচিত হয়েছে। মধ্যযুগের প্রধান প্রধান গীতিকবি হলো বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস জ্ঞান দাস ও গোবিন্দ দাস অন্যতম। সাধারণত রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমকাহিনি নিয়ে এ সব কবিতা রচিত হয়েছে। আধুনিক যুগের কবিরাও অনেক গীতিকবিতা রচনা করেছেন। নিম্নে গীতিকবিতার সংজ্ঞা ও শ্রেণিবিভাগ আলোচনা করা হলো-
গীতিকবিতা বিশেষ এক ধরণের কবিতা। গীতি কবিতার সঙ্গে কবিতা ও সঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য একই সাথে বিদ্যমান থাকে। বাংলা গীতিকবিতায় কবির একান্ত মনের কিছু কথা ব্যক্ত হয়। এই একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি যখন সহজ-সরল ছন্দে সাবলীলভাবে আত্মপ্রকাশ করে, তখনই গীতিকবিতার জন্ম হয়। গীতিকবিতাকে ইংরেজিতে লিরিক বলা হয়ে থাকে। সাধারণত বিশেষ ধরণের ছোট কবিতা যা বাদ্যযন্ত্রের সাহায্যে গানের মতো গাওয়া যায়। এই কবিতা গান ও কবিতা-এই দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য একই সময়ে ধারণ করে। এ গুলো কবিতা হিসেবে পাঠ করা হোক, আর গান হিসেবে গাওয়া হোক; পাঠক-শ্রোতার হৃদয়ে বিশেষ আকর্ষন সৃষ্টি করে। যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের কবিতা এবং বৈষ্ণব পদাবলি এই ধরনের গীতিকবিতা। গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য :
১. একটুখানির মধ্যে একটি মাত্র ভাবের প্রকাশ ঘটে। (রবীন্দ্রনাথের মত)
২. গীতিকবিতা কবির আত্মমকুর।
৩. কথা ও গানের সমন্বয়।
৪. সুরের সমন্বয়।
৫. একটি মাত্র ভাব-কল্পনা থাকে।
৬. কবির একান্ত কামনা-বাসনার প্রকাশ।
৭. আবেগমাখা সুর।
৮. ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার প্রকাশ।
৯. গতি স্বাচ্ছন্দ্য থাকে।
১০. কবির একান্ত ভাবনার বিশেষ শৈল্পিক প্রকাশ।
গীতিকবিতার প্রকারভেদ :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র দাশ নিমোক্তভাবে গীতিকবিতার শ্রেণিবিভাজন করেছেন।
১. ভক্তিমূলক গীতিকবিতা : এই কবিতায় কবি-মনের ভক্তি-ভাব প্রকাশ হয়। যেমন : অক্ষয়কুমার বড়ালের ‘কোথা তুমি’, রামপ্রসাদের ‘পদাবলী’, গোবিন্দ দাসের ‘বন্দনাগীতি’। বন্দনামূলক গানও ভক্তিমূলক গীতিকবিতার অন্তর্ভুক্ত। যেমন : নিশিকান্তের ‘অরবিন্দ-বন্দনা’।
২. স্বদেশপ্রীতিমূলক গীতিকবিতা : যে গীতিকবিতায় স্বদেশ প্রেম প্রকাশ হয়, তাকে স্বদেশপ্রেম মূলক গীতিকবিতা বলে। যেমন : সাহিত্য স¤্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে-মাতরম’ সঙ্গীত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জনগণ মন অধিনায়ক’, অক্ষয় কুমার বড়ালের ‘বঙ্গভূমি’, যদুগোপালের ‘জন্মভূমি’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ভারতবর্ষ’ ইত্যাদি।
৩. প্রেমমূলক গীতিকবিতা : আশা-ভালবাসা, বিরহ-বিচ্ছেদ, বেদনা-মধুরতা-প্রভৃতিকে আশ্রয় করে প্রেমমূলক গীতিকবিতা গড়ে ওঠে। যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বর্ষার দিনে’, গোবিন্দ দাসের ‘আমি তোরে ভালবাসি’ এবং জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’। ইত্যাদি।
৪. প্রকৃতি বিষয়ক গীতিকবিতা : প্রকৃতির রুপ-রস-গন্ধ-স্পর্শকে বুকে ধারণ করে অন্তররসে রসায়িত হয়ে এ গীতিকবিতায় কবি মনের ভাব প্রকাশ করেন। যেমন : রবীন্দ্রনাথের ‘বর্ষামঙ্গল’, নজরুল ইসলামের ‘বাদল দিনে’, সত্যেনদত্তের ‘ঝর্ণা’, কালিদাসের ‘বাংলার দীঘি’, মোহিতলালের ‘কাল বৈশাখী’ ইত্যাদি।
উল্লিখিত গীতিকবিতা ছাড়াও আরো কিছু গীতিকবিতা রয়েছে। যেমন : সনেট, স্তোত্র গীতিকবিতা, চিন্তামূলক গীতিকবিতা, শোক জাতীয় গীতিকবিতা ইত্যাদি।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, গীতিকবিতা বিশেষ ধরণের কবিতা। তবে এ কবিতায় আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আধুনিক গীতিকবিতা লৌকিক বিষয় জীবন ও জগতের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতে পেরেছেন যে, ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর’। আধুনিক বাংলা গীতিকবিতায় পরিপূর্ণ জীবনের ইঙ্গিত নেই। ইহা কবির একান্ত ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ। কবির একান্ত ভাল লাগা, মন্দ লাগা, কামনা-বাসনা, হৃদয়ের বস্তুনিষ্ঠ রুপ নিয়ে আধুনিক গীতিকবিতা গড়ে উঠেছে।