বাঙালি সংস্কৃতির উৎস অনুসন্ধান কর।
বাঙালি সংকর জাতি বলে তাদের সংস্কৃতির বহুজাতির সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফল। এতে প্রধানভাবে মিশে আছে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় ও মোঙ্গলীয়দের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সংস্কৃতির পরিচয় প্রসঙ্গে বিশিষ্ট গবেষক গোলাম মুরশিদ ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বলছেন-‘মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ এবং জ্ঞানের একটি সমন্বিত প্যাটার্নকে বলা যায় সংস্কৃতি’। প্রশ্নানুসারে নিম্নে বাঙালি সংস্কৃতির উৎস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –
বাঙালি সংস্কৃতির উৎস: বাঙালি সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরানো। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩৫০০ বছর পূর্বে এ দেশে আর্যরা বাস করতো। তার আরও পূর্বে যারা এ দেশে বাস করতো তারা ‘ভেড্ডি’ নামে পরিচিত ছিল। বাংলার মানুষ এই ভেড্ডিদের রক্তধারাকে বহন করছে। তাছাড়া এখানে বসবাস করতো অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, ভোটচেনীয়সহ আরও কত উপজাতি। এদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি বাঙালি সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে। বাঙালি চেতনায় রয়েছে সংখ্যা, যোগ ও তন্ত্রের প্রভাব। তুক-তাক, দারু-টোনা, ঝাড়-ফুক, বাণ-উচাটন, কবজ-তাবিজ, এবং বশীকরণের বিষয় সবই অস্ট্রিক-মঙ্গোলীয়দের সংস্কৃতির প্রভাব।
১.খাদ্য ও আহার বিহার: বাঙালি খাবারের মধ্যে উলে−খযোগ্য ছিল মাছ। পুটি, টেংরা, শিং, গজার, কই, মাগুর, টাকি, পাঙ্গাস প্রভৃতি মাছ বাঙালিরা নিত্যদিন খেত। মাছের এ নামগুলো বাঙালি পেয়েছে অস্ট্রিক-দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয়দের কাছ থেকে। নেশা জাতীয় খাবার ছিল গাঁজা, ধেনো মদ, চরস, সিদ্ধি প্রভৃতি। বিভিন্ন ফলমূলের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন: কলা, তাম্বুল, গুবাক, গাণ্ডারী, জাম্বুরা প্রভৃতি। এগুলো অস্ট্রিক-দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয়দের কাছ থেকে পাওয়া।
২.রন্ধন ক্রিয়া: আদিকাল থেকেই বাঙালি ভোজনরসিক ছিল। রান্নাবান্নায় তারা পটু ছিল। রান্নার ক্ষেত্রে তারা বৈচিত্র্য ও দক্ষতা দেখিয়েছিল। সে সময়ে বাঙালির আহারে ৬৪ রকমের ব্যঞ্জন ব্যবহৃত হতো। রন্ধন ক্রিয়ায় তেল আগেই ব্যবহৃত হতো।
৩.ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কার: ধর্মীয়চেতনা বাঙালি আগে থেকেই লালন করতো। বিভিন্ন রকম পূজা বাঙালির ধর্মীয় জীবনের প্রধান অনুষঙ্গ। এগুলোর মধ্যে শিবপূজা, মাতৃদেবী পূজা, প্রভৃতি বাঙালি পাকআর্য যুগ থেকেই লালন করে আসছে। তন্ত্রেমন্ত্রে বিশ্বাস এবং যোগ অভ্যাস আদিকাল থেকেই বাঙালির জীবনচেতনায় মিশে আছে। আচরিক জীবনে ধান, দূর্বা, হলুদ, আমপাতা, কলাগাছ, কলসি, ঘট, কুলো, দীপ, ধূপ, মাছ, দই, বাঙালির বাঞ্ছাসিদ্ধিতে ভরসা জাগাতো। ওলা-শীতলা-চণ্ডী-ষষ্ঠী কিংবা সাপ, হাতি, বাঘ, কুমিরকে সভয়ে শ্রদ্ধা করে বাঙালি বিশ্বাসের জগতে স্থান দিয়েছে।
৪.বিবাহ-আচার : বিবাহের নানা আচার এবং বিধিনিষেধ আঙালি আদি সংস্কৃতি থেকে পেয়েছে। সামাজিক জীবনে গোত্রবিবাহ, বহুবিবাহ, অগোত্রীয় বিবাহ, বাল্য বিবাহ, অ¯্রবর্ণ বিবাহ, বিধাব বিবাহ, তালাক প্রভৃতি বিধিনিষেধ সমাজে আদিকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। পূর্বে বিয়ের অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হতো।
৫.সামাজিক উৎসব: সমাজে কৃষি সম্পর্কিত উৎসব, যেমন পৌষপার্বণ, নবান্ন, মেয়েদের দ্বারা পালিত ব্রত আদি সংস্কৃতির দান। এছাড়া চড়ক, গাজন প্রভৃতি উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।
৬.হাতিয়ার নিত্য ব্যবহার্য উপকরণ : বাঙালির সেকালের হাতিয়ারের মধ্যে ছিল লাঙ্গল, যোয়াল, ফাল, ঈশ, দা, দড়ি, মই, কোদাল, বর্শা, বাটুল ইত্যাদি। নিত্য ব্যবহার্য উপকরণের মধ্যে ঝুড়ি, করাত, চুপড়ি, হাঁড়ি, সরা, পাতিল, ঝিনুক, নারিকেল মালা, নল, পেটি, ঘটি, চাটাই, ঝাটা, বাখারি ইত্যাদি।
৭.অলঙ্কার: নারী পুরুষ উভয়ের অলঙ্কার ব্যবহার বাঙালির আদি বৈশিষ্ট্য। নারীর ব্যবহার্য অলঙ্কার হার, চুড়ি, নূপুর ইত্যাদি আদি যুগ থেকেই চলে আসছে। বালা ও দুল ব্যবহারের পরিচয় পাওয়া যায়। নারীরা কানে কচি তালপাতার মাকড়ি ব্যবহার করতেন।
৮.নৃত্যগীত, সংগীত চর্চা ও খেলাধুলা: সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান নৃত্যগীত ও খেলাধুলায় নির্মল আনন্দ লাভের জন্য এবং চিত্তের সুখকর অনুভূতি সৃষ্টির জন্য আদিকাল থেকেই বাঙারি নৃত্যগীত ও সংগীত চর্চা করে আসছে। দাবা খেলা সে যুগে প্রচলিত ছিল।
৯.পেশা ও কর্ম: বাঙালি আদিকাল থেকেই বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। হরিণ শিকার, মাছ শিকার, নৌকা চালানো, মদ তৈরি করা, বলদ দ্বারা চাষাবাদ করা সেকালের বাঙালির কাছ থেকেই এ কালের বাঙালি পেয়েছে। এ ছাড়া হস্তিবিদ্যা, রেশমবয়ন, সাংখ্য দর্শন, প্রেক্ষাগৃহ প্রস্তুত, নৌকা বা জাহাজ নির্মাণ বাঙালি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
১০.পোশাক পরিচ্ছদ: লজ্জা নিবারণ ও শীত-গ্রীষ্ম থেকে বাঁচার জন্য পোশাক ব্যবহৃত হতো। নারী ও পুরুষের পোশাকে মিল ছিল। তারা উভয়ে শাড়ি বা ধুতি পরতেন। শাড়ি ও ধুতির মধ্যে পার্থক্য ছিল। ধুতির চেয়ে শাড়ির দৈঘ্য ও ঝুলে বড় ছিল। নারী পুরুষ উভয়ে শরীরের উপরের অংশ খোলা রাখতেন। তাছাড়া জামা, চাদর, অন্তর্বাস প্রভৃতির ব্যবহার প্রচলিত ছিল।
১১.প্রসাধন সামগ্রী: বিভিন্ন রকম প্রসাধন সামগ্রী দ্বারা নারীরা রূপচর্চা করতো। তারা দেহের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করতো। সুগন্ধি তেল দ্বারা তারা মাথার চুল সিক্ত করতো। চোখে কাজল, ঠোঁটে আলতা, এবং কপালে চন্দনের ফোঁটা ব্যবহার করে নারীরা নিজেদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতো। বিবাহিত নারীরা সিঁদুর ব্যবহার করতো।
উপর্যুক্ত আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর সংস্কৃতির মিশ্রণেই আদিকাল থেকে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।