বাকধ্বনি কী ? বাকধ্বনি উচ্চারণের সাহায্যকারী বাক-প্রত্যঙ্গগুলো সচিত্র বিবরণ দাও । 241007

বাকধ্বনি কী ? বাকধ্বনি উচ্চারণের সাহায্যকারী বাক-প্রত্যঙ্গগুলো সচিত্র বিবরণ দাও ।

আমরা জানি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তা করা এবং রক্তশোধন করা ফুসফুসের অন্যতম কাজ। তবু ফুসফুসই শেষ পর্যন্ত মানুষের বাগধ্বনি উৎপাদনের কেন্দ্র। প্রাণধারণের জন্য মানুষ ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাস গ্রহণ করে এবং শ্বাস ত্যাগও করে। শ্বাসবায়ুর বহির্গমনকালে গলনালী ও মুখবিবরের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এ সংঘর্ষের স্থান, রূপ ও পরিমাণ অনুসারে বিভিন্ন ধ্বনি উৎপন্ন হয়। তার মধ্যে অর্থবোধক ধ্বনিগুলোই মানুষের বিভিন্ন ভাষার বাগধ্বনি। ধ্বনি বিভিন্ন ভাবে সৃষ্টি হলেও বাগযন্ত্ররে সাহায্যে উচ্চারতি ধ্বনিকেই বলা হয় বাগধ্বনি বা ঝঢ়ববপয ঝড়ঁহফ বলে । বাক-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে মানুষ ধ্বনি উচ্চারণ করে কথা বলে। ধ্বনি উচ্চারণের সুবিধার জন্য মানুষের শরীরে নানা সহায়ক অঙ্গ আছে। সেই সহায়ক অঙ্গগুলোকে বাক-প্রত্যঙ্গ [Organs of Speech] বলা হয়।

মানবদেহের যেসব প্রত্যঙ্গ ধ্বনির উচ্চারণের সঙ্গে যুক্ত সেগুলিকে বাগযন্ত্র বা বাপ্রত্যঙ্গ বলে। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া আর খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি এগুলির সাহায্যে মানুষ কথাবার্তা বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করে। বাগযন্ত্র বলতে শরীরের উপরিভাগে অবস্থিত মধ্যচ্ছদা থেকে ঠোঁট পর্যন্ত শ্বাসবাহী বিশেষ প্রত্যঙ্গগুলিকে বোঝায়। কিন্তু বাস্তবে এর পরিধি আরও ব্যাপক। কেন্দ্রীয় ও প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রও বাগ্ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে বাগযন্ত্রের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের বিবরণ পর্যায়ক্রমে উপস্থাপন করা হল।

মধ্যচ্ছদা : বক্ষগহ্বরের পিছনে আছে মেরুদ- ; আর সামনের দিকে আছে পাঁজর ও বুকের হাড়। বক্ষগহ্বরের একবারে নীচে রয়েছে গম্বুজাকৃতি একটি পেশিপর্দা। এর নাম মধ্যচ্ছদা। পাকস্থলী থেকে বক্ষগহ্বরকে মধ্যচ্ছদা বিচ্ছিন্ন করেছে। বাগধ্বনি উচ্চারণ করার সময়ে মধ্যচ্ছদাকে উপরে উঠিয়ে ফুসফুস থেকে বাতাস মুখগহ্বরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়।

ফুসফুস : বক্ষগহ্বরের ভিতরে হৃদযন্ত্রের দুপাশে অবস্থিত এবং স্পঞ্জের মতো সংকোচন ও প্রসারণশীল প্রত্যঙ্গ হল ফুসফুস। ধ্বনির সৃষ্টিতে ফুসফুস বায়ুপ্রবাহের শক্তি জোগান দেয়। ফুসফুসের সঞ্চালনের ফলেই শ্বাসপ্রবাহ অব্যাহত থাকে। ফুসফুসের বায়ু সঞ্চালন দু রকম : শ্বাস গ্রহণ (প্রশ্বাস) ও শ্বাস ত্যাগ ( নিশ্বাস ) । ফুসফুসে বাতাসের আগমন ও নির্গমণকে চিহ্নিত করা হয় দুভাবে : ফুসফুসের বহির্গামী বাতাস হিসাবে এবং ফুসফুসের অন্তর্গামী বাতাস হিসাবে । ফুসফুস থেকে যে বাতাস বেরিয়ে আসে তা ফুসফুসের বহির্গামী বাতাস। অধিকাংশ ধ্বনি এই বাতাস থেকে উৎপন্ন হয়। বাইরে থেকে বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করলে তাকে বলে অন্তর্গামী বাতাস। এ প্রক্রিয়ায় বাগ্ধ্বনি উচ্চারণ করা সম্ভব। কিন্তু ভাষায় কদাচিৎ তার ব্যবহার হয়। বাংলা ধ্বনির উচ্চারণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্গামী বাতাসের ব্যবহার নেই।

শ্বাসনালি : শ্বাসনালি ফুসফুস সংলগ্ন ডান ও বাম দিকের বায়নালির মিলনস্থল থেকে গলদেশের মধ্য দিয়ে একটি নল উপরের দিকে উঠে গেছে। এর নাম শ্বাসনালি। শ্বাসনালি দিয়ে বাতাস স্বররন্ধ্রের ধ্বনিদ্বার হয়ে উপরে উঠে মুখ, কখনও বা নাক দিয়ে নির্গত হয়। ধ্বনিদ্বার দুটি বিশেষ এক অবস্থানে থাকলে বাতাসের ধাক্কায় তা কম্পিত হয় এবং বাগ্ধ্বনির প্রাথমিক রূপ সৃষ্টি হয় । অসংখ্য বলয়ের সাহায্যে তৈরি ওই নলটিই শ্বাসনালি ।

গলবিল: জিভের গোড়া থেকে ফুসফুস পর্যন্ত প্রসারিত নলের মতো প্রত্যঙ্গটিই হচ্ছে গলবিল। মুখ-গহ্বর, নাসিকা-গহ্বর ও স্বরযন্ত্রের গমনপথ হিসাবে গলবিল গুরুত্বপূর্ণ গলবিলের জৈবিক কাজ মূলত দুটি : খাদ্যকে মুখগহ্বর থেকে খাদ্যনালিতে পৌছে দেওয়া এবং বাতাসকে নাসিকা-নালি থেকে ধ্বনিদ্বারে চালান করা। মুখ গহবর ও গলবিলের মধ্যে সংযোগকারী অংশই হচ্ছে নাসিক্য গলবিল। যে গলবিল স্বরযন্ত্রের অংশ তা স্বরযন্ত্রীয় গলবিল। শ্বাসনালির সঙ্গে এ অংশ যুক্ত।

স্বরযন্ত্র : শ্বাসনালির উপরের অংশে চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ মেরুদ-াস্থির দিকে খাড়াখাড়ি অবস্থায় নলের মতো যে অংশ রয়েছে তার নাম স্বরযন্ত্র। বাগযন্ত্র হিসাবে স্বরযন্ত্র সবচেয়ে জটিল। ধ্বনি উচ্চারণে স্বরযন্ত্রের ভূমিকাও অপরিসীম। ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসা বাতাস স্বরযন্ত্রে প্রথম বাধা পায়। বাগ্ধ্বনি উৎপাদনে স্বরযন্ত্রকে গুরুত্ব দিয়ে ধ্বনিগুলিকে দুই ভাবে দেখানো হয়Ñ স্বরযন্ত্রীয় ও অস্বরযন্ত্রীয়। স্বরযন্ত্রে রয়েছে ৯ টি উপাস্থি কিন্তু ধ্বনি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ হল ৫ টি ।

ধ্বনিদ্বার ও স্বররন্ধ্র : স্বরযন্ত্রের মধ্যেই ধ্বনিদ্বারের অবস্থান । নারী-পুরুষ ও বয়স ভেদে ধ্বনিদ্বারের আকারগত বৈচিত্র্য রয়েছে। পুরুষদের তুলনায় নারী ও শিশুদের ধ্বনিদ্বার ছোট ও সংকীর্ণ । ফলে তাদের কণ্ঠস্বর চিকন ও সুরেলা। নীরব থাকলে ধ্বনিদ্বার অক্রিয় ও অনেকটা খোলা থাকে। ফলে বাতাস সহজে ফুসফুসে প্রবেশ করে ও ফুসফুস থেকে বাতাস বেরিয়ে আসে। মাত্রার উপরে স্বরগ্রামের উচ্চতা নিভর্র করে। ধ্বনি উৎপাদনে ধ্বনিদ্বারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

অধিজিহ্বা : স্বরযন্ত্র যে উপাস্থি দিয়ে ঢাকা থাকে তা ই হল অধিজিহ্বা। এর কাজ খাদ্য গ্রহণকালে স্বরযন্ত্রে ও অবস্থান জিতের পিছনে অধিজিহ্বার শ্বাসনালিতে খাদ্যের প্রবেশ রোধ করা । আমরা লক্ষ করি যে, উচ্চারণে ভূমিকা অনুযায়ী মুখগুহাকে সামনে থেকে পিছনে একটি কাল্পনিক অনুভূমিক রেখা দিয়ে ঊর্ধ্বাংশ ও নিম্নাংশ ভাগ করা যায়। ঊর্ধ্বাংশে পড়ে উপরের ঠোঁট থেকে আলজিভ পর্যন্ত বিস্তারিত ক্ষেত্র । এগুলি নানা অংশ ধ্বনির উচ্চারণ স্থান হিসাবে কাজ করে । বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে যুক্ত এখানকার এই কয়টি ক্ষেত্রকে নির্দেশ করা যায়-

১.ওষ্ঠ ২. দন্ত ৩. দন্তমূল ৪. মূর্ধা ৫. তালু ৬. নরমতালু, ৭.আলজিভ. ৮.গলনালি

অন্য দিকে মুখের তলার অংশে আছে অপেক্ষাকৃত সক্রিয় দুটি বাগযন্ত্র নীচের ঠোঁট ও জিহ্বা। এ দুটির মধ্যে জিহ্বার ভূমিকা অতিশয় প্রধান, কাজেই সে প্রধান উচ্চারক । নীচের ঠোঁট গৌণ উচ্চারক। চোয়াল নীচের ঠোটের উচ্চারকের ভূমিকায় সহায়তা করে। স্বরধ্বনির উচ্চারণে দুটি ঠোটের আকৃতি নির্মাণেও চোয়ালের যথেষ্ট ভূমিকা থাকে ।

জিভ : ধ্বনি উৎপাদনে জিভের ভূমিকা ও কার্যকারিতা অনুসারে জিভের বিভিন্ন অংশকে এভাবে ভাগ করে দেখানো যেতে পারে-

সম্মুখ জিভ : শক্ত তালুর বিপরীতে অবস্থিত জিভের অংশ ।
পশ্চাৎ জিভ : নরম ও শক্ত তালুর মিলনস্থলের বিপরীতে অবস্থিত জিভের অংশ।
জিহ্বাফলক : দন্ত-মাড়ির সঙ্গে লেগে থাকা জিভের ক্রমশ সূক্ষ্ম হয়ে আসা অংশ; অর্থাৎ জিভের প্রান্তিক অংশ ।
জিহ্বাশিখর : জিভের একেবারে সামনের অংশ; এবং
জিভের বেড় : একেবারে সামনের অর্ধবৃত্তাকার অংশ।

তালু : মুখের ছাদকে বলা হয় তালু । তালু মূলত দুটি অংশে বিভক্ত ।
শক্ত তালু : মুখের সম্মুখ ভাগের দন্তমূলের শুরু থেকে পিছনের দিকের নরম বা কোমল তালু পর্যন্ত বিস্তৃত অংশ । জিভের অগ্রভাগ দিয়ে শক্ত তালু স্পর্শ করে তালব্য ধ্বনিগুলি উচ্চারিত হয়। দন্তমূলের পিছনে শক্ততালুর উত্তল অংশের উচ্চতম স্থানের নাম মূর্ধা ।

কোমল তাল : তালুর পশ্চাদৃভাগই কোমল তালু । তার সর্বশেষ অংশ আলজিভ, উপর থেকে ঝুলে থাকে। স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসে ও নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে কোমল তালু কিছুটা নীচু হয়ে থাকে। অনুনাসিক স্বরধ্বনি উচ্চারণেও কোমল তালু নীচে নামে। বাগ্ধ্বনি বিচারে কোমল তালুর ভূমিকা তাই গুরুত্বপূর্ণ।

আলজিভ : কোমল তালুর পিছনে টিসু বা কলাতন্ত্রর সাহায্যে তৈরি ঝুলন্ত মাংসপিগুটি হল আলজিভ। বাংলা নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণে আলজিভ সহায়তা করে মাত্র। এর বাইরে তার কোনো সক্রিয় ভূমিকা নেই ।

দাঁত ও ওষ্ঠ : ধ্বনি উচ্চারণে উপরের মাড়ির দাঁতগুলির ভূমিকাই মুখ্য। জিভের সামনের অংশ দিয়ে উপরের পাটির দাঁত স্পর্শ করে কিছু ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারিত হয়। ঠোঁট বলতে উপরের ও নীচের উভয় ঠোঁটকেই বোঝানো হয়। উপরের ঠোঁটকে ওষ্ঠ আর নীচের ঠোঁটকে অধর বলে । কিন্তু ধ্বনিবিজ্ঞানের এই আলোচনায় ওষ্ঠ বলতে উভয় ঠোটকেই বোঝনো হবে। ধ্বনি সৃষ্টিতে ঠোঁটের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। দুই ঠোঁটের মধ্যকার ফাঁকের তারতম্য ভেদে স্বরধ্বনির প্রকৃতি নির্ণয় করা হয়। উচ্চারণস্থান ও উচ্চারণরীতি অনুসারে ব্যঞ্জনধ্বনি বিচারেও ঠোটের গুরুত্ব অপরিসীম ।

দন্তমূল : উপরের পাটির দাঁত ও শক্ত তালুর মধ্যবর্তী উঁচু স্থানটি দন্তমূল। জিহ্বাফলকের সাহায্যে সহজেই দন্তমূল স্পর্শ করা যায়।

চোয়াল : মুখের যে অংশের সঙ্গে দাঁতের পাটি যুক্ত থাকে, সে অংশের নাম চোয়াল। উপরের চোয়াল নিষ্ক্রিয়, কিন্তু নীচের চোয়াল সক্রিয়; তা সামনে পিছনে, ডানে ও বামে সঞ্চালন করা যায়। চোয়াল থেকে সরাসরি কোনো ধ্বনি উচ্চারিত হয় না । কিন্তু চোয়ালের গতিশীলতা ছায়া স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ সম্ভব নয়। বাপ্রত্যঙ্গ হিসাবে তাই চোয়ালের গুরুত্ব কম নয়।

(প্রতিটি পয়েন্ট সংক্ষিপ্ত টীকা হিসেব পরীক্ষায় আসতে পারে)

সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক,বাংলা বিভাগ, জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
Scroll to Top