বাংলা উপন্যাসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর অবদান আলোচনা কর।
বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) অপরাজেয় কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত। যে কোন সময়ের বিবেচনায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। তিনি ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনায় যে দক্ষতা দেখিয়েছেন তা আর কোন ঔপন্যাসিক দেখাতে পারেন নি। তাঁর বেশিরভাগ গল্প ও উপন্যাস পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। গল্পের জন্য তিনি ‘কুন্তলীন’ পুরস্কার পেয়েছেন। শরতের গল্প ও উপন্যাসে পুরুষ চরিত্র অপেক্ষা নারী চরিত্র বেশি উজ্জ্বল। তিনি ছিলেন জীবন সন্ধানী শিল্পী। জীবনের বাস্তব সত্যকে তিনি শিল্পে রুপদান করেছেন। তাই শরৎ সাহিত্য পাঠকের নিকট এখনও সবচেয়ে জনপ্রিয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। নিম্নে বাংলা উপন্যাসে শরতের অবদান আলোচনা করা হলো-
শরৎ এ যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তিনি উপন্যাস ও গল্প লিখে পাঠকের কাছে অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প-উপন্যাসগুলোরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘বড়দিদি’, ‘বিরাজবৌ’, ‘বিন্দুর ছেলে’, ‘পরিণীতা’, ‘প-িতমশাই’, ‘মেজদিদি’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বৈকুণ্ঠের উইল’, ‘অরক্ষণীয়া’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘দেবদাস’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘কাশীনাথ’, ‘চরিত্রহীন’, ‘স্বামী’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেনাপাওনা’, ‘পথের দাবী’, ‘শেষ প্রশ্ন’, ‘বিপ্রদাস, শুভদা ইত্যাদি। এ সমস্ত উপন্যাসের কাহিনি প্রায়ই পারিবরিক ও সামাজিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে। শরতের আগে আমরা বঙ্কিমের অনেক উপন্যাস পেয়েছি। সে গুলো ঐতিহাসিক ও রোমান্সধর্মী উপন্যাস ছিল। শরৎ বঙ্কিমের পথে সাহিত্য রচনা করেন নি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইতিহাস আর রোমান্সের যুগ সমাপ্ত হয়েছে। তিনি বাস্তব পরিবেশে চিন্তা-ভাবনা করে মানুষের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে এমন বিষয়গুলোকে কথা সাহিত্যে তুলে এনেছেন। শরৎ সত্য ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিষয় যেমন সমাজ ও জীবনকে একই সাথে তাঁর সাহিত্যকর্মে তুলে এনেছেন। চরিত্র নির্বাচন ও নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। সমাজের অবহেলিত, নিম্নবিত্তের নারী চরিত্রকে সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন। এই সব চরিত্রের মনের সত্য কথাকে তিনি অসাধারণ শিল্পকুশলতায় সাহিত্যে স্থান দিয়েছেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ চ-ীদাসের এই উক্তিটি শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যকর্মে ফুটিয়ে তুলেছেন। মানুষই সত্য, মানুষের প্রেম সত্য, জীবন সত্য-এই সত্যগুলোকে তিনি সাহিত্যে শিল্পরুপ দান করেছেন। প্রেমের বিচিত্র রহস্য বিশ্লেষণে তিনি অসাধারণ শিল্পকুশলতার পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালি সমাজ এক সময় সংকীর্ণ ছিল। প্রেমের স্বাভাবিক প্রকাশ সমাজে সহজ ছিল না। বিশেষ করে নারী চরিত্রের প্রেমবিকাশের সুযোগ সমাজে খুব কমই ছিল। কিন্তু নারীর জীবনেও প্রেম চিরন্তন সত্যরুপে আগমন করে। এই নারী সমাজের চিরন্তন প্রেম শরৎ সাহিত্যে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। নারীর প্রতি অবহেলা শরৎচন্দ্রকে ব্যথিত করেছে। তাই নারীজাতির মনের ব্যথা-বেদনাকে তিনি পরম সার্থকতার সাথে ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসে তুলে এনেছেন।
নারী হৃদয়ের বৈশিষ্ট্য প্রেমের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠে। ভালোবাসার আকর্ষন যেমন প্রবল, প্রত্যাখানের দুঃখ তেমনই তীব্র। ফলে নারী হৃদয়ে গভীর ট্ট্যাজেডির সৃষ্টি হয়। ‘দেবদাস’ উপন্যাসে পার্বতী, ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসে ষোড়শী, ‘বড়দিদি’ উপন্যাসের মাধবী প্রভৃতি নারী চরিত্রের মনের ভালোবাসার সঙ্গে সমাজের প্রচলিত সংস্কারের দ্বন্দ্ব প্রবল রুপ ধারন করেছে। মানবমন, মানব সমাজ, মানবদেহ ভিন্ন জিনিস। ধর্মীয় নীতি অনুসারে নিজের দেহকে শুদ্ধ রাখলেই তাকে সমাজ পছন্দ করে। সমাজের প্রচলিত নিয়ম-নীতির বাইরে কোন নারীর দৈহিক সম্পর্ক থাকলেই তাকে অসতী বলা হয়-এ কথাকে শরৎচন্দ্র বিশ্বাস করেন নি। সতীত্বের মাপকঠি বিষয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একমত হোন নি। তাঁর মতে, মানবপ্রেম সতীত্বের চেয়েও মহত্তর কিছু। শরতের কয়েকটি উপন্যাসে এই মতবাদের সমর্থন পাওযা যায়। ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে দেখা যায় যে, অচলা স্বামী মহিমকে ভালোবাসে। আবার স্বামীর বন্ধু সুরেশকেও ভালোবাসে। ফলে কোন দিকে যাবে অচলা নামের নারী চরিত্রটি। বেশিদিন স্বামীর প্রেমের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পারে নি। একদিন অচলা স্বামীকে ছেড়ে সুরেশের সঙ্গে অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে। ঔপন্যাসিক এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন যে, নারীর ভালোবাসা দিকদর্শন যন্ত্রের মতো সব সময় যে, স্বামীর দিতে নিবেদিত থাকবে তা নয়। যার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হবে নারী তার দিকেই ধাবত হবেÑএটাই শরৎ সাহিত্যের আসল কথা। তাই শরৎ সাহিত্য আমাদের নিকট এতো জনপ্রিয়। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের সংখ্যা কম নয়। তবে যে গ্রন্থগুলো প্রতিনিধিত্ব করে তা হলো ‘চরিত্রহীন’, ‘শ্রীকান্ত’, ও ‘গৃহদাহ’। এই তিনটি উপন্যাসে শরৎ এমন প্রেমকে নিয়ে উপন্যাসের কাহিনি তৈরি করেছেন যা প্রচলিত সমাজ অনুমোদন করে না। কিন্তু সমাজ অনুমোদন করুক আর নাই করুক এটা তো জীবনেরই ঘটনা। সমাজ অনুমোদন না দিলেও মানুষের হৃদয় কীভাবে অনুমোদন দিয়ে দেয় সেটাই শরৎ তাঁর সাহিত্যকর্মে বিশ্লেষণ করেছেন। সমাজে কিছু বিধি-বিধান রয়েছে। আমরা সবাই এগুলো অনুসরণ করে থাকি। কিন্তু মানবমন তো অবুঝ। সব সময় সে সমাজের সুনিদিষ্ট পথরেখায় চলতে পারে না। ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে সতীশ-সাবিত্রী, উপেন্দ্র-দিবাকর-কিরণময়ী চরিত্রগুলো কীভাবে সমাজের প্রচলিত বিধানের বাইরে নিজেদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, এবং এ সব নর-নারীর প্রেমের বিকাশ ও বিশ্লেষণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসে দেখিয়েছেন। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ‘চরিত্রহীন বঙ্গ-উপন্যাস সাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ’। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে প্রধান উপাদান হিসেবে রুপায়িত করে শরৎচন্দ্র সাহিত্যে নর-নারীর চরিত্র নির্মাণ করেছেন। তাই উপন্যাস সাহিত্যে তার জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া এবং তিনি বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বিশেষ মাত্রা যুক্ত করেন। উপন্যাস সাহিত্যে শরতের মতো আর কোন লেখক অবদান রাখতে পারেন নি।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধমে দেখা যায় যে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যকর্মে মানুষের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রেমকে রুপায়িত করেছেন। বিবাহিত বা অবিবাহিত হোক, বিধবা কিংবা সধবা হোক যে কোন সময় ও যে কোন বয়সেই মানুষের জীবনে প্রেম আসতে পারে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় সমাজনিষিদ্ধ প্রেমে কীভাবে মানুষ জড়িয়ে পড়ে এবং প্রেমকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যায়-এই বিষয়গুলো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। তাই সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, শরৎচন্দ্রের উপন্যাস বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে তিনি বিশেষ অবদান রেখেছেন।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর