বাংলার চিত্রশিল্প সম্পর্কে একটি নিবন্ধ রচনা কর।
মানুষ সৌন্দর্যপ্রিয়। মনের বিচিত্রভাবকে দৃষ্টিনন্দন করে প্রকাশ করতে মানুষ নানা কিছুর আশ্রয় নেয়। আদিকালের মানুষ পর্বতের গুহায়, প্রস্তরফলকে তার মনের বিচিত্র ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলেছে। সে সবগুলো যে কালের সাক্ষি হয়ে টিকে আছে, তাও নয়। কিছু টিকে আছে, আবার কিছু কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বাংলার চিত্রশিল্প সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১.বাংলার চিত্রশিল্পের সূচনাপর্ব: বাংলার চিত্রশিল্পের প্রাচীনতম নিদর্শনগুলো যা পাওয়া গেছে, তা একাদশ ও দ্বাদশ শতকের। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বৌদ্ধদের লেখা তাল পাতার কয়েকটি পুঁথি রক্ষিত আছে। এ সব পুঁথিগুলোতে বৌদ্ধদের নানারকম মুদ্রা ও নামের ছবি আছে। বৌদ্ধদের ছবিতে দেবীদের মূর্তিও আছে। বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির চিত্র, যেগুলোতে তালপাতা ও কাগজে হাতের লেখা পুঁথির উপর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ছবি আঁকা। ছবিগুলো স্বল্পায়তনের হলেও তার উপর কারুকার্য ও গভীর ভাবনা কল্পনার ইঙ্গিত আছে।
২.চিত্রশিল্পের প্রাচীন পাণ্ডলিপি: যে সব পাণ্ডলিপিতে প্রাচীন বাংলার চিত্রশিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় সেগুলো হলো- মহিপালের রাজত্বকালের পঞ্চম ও ষষ্ঠবছরে অনুলিখিত ও চিত্রিত অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞা পারমিতার দুটি পাণ্ডলিপি, রামপালের শাসনকালের ৩৯তম বছরে অনুলিখিত ও চিত্রিত অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার একটি পাণ্ডলিপি, জাপানের সোয়ামুরা পাণ্ডলিপি, বিভিন্ন শৈবগ্রন্থের পাণ্ডলিপি প্রভৃতি।
৩.চিত্রশিল্পের বিষয়বস্তু: অধিকাংশ চিত্র বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে অঙ্কিত হয়েছে। ধর্মের কারণেই পুঁথিগুলো অনুলিখিত ও চিত্রিত হয়েছে। ফলে তন্ত্রসম্মত ধ্যানসূত্রের অনুসরণে বিভিন্ন মহাযানী, বজ্রযানী দেবদেবীর চিত্র রূপায়িত হয়েছে। কতকগুলো চিত্রের বিষয়বস্তু হয়েছে বুদ্ধজীবনের অলৌকিক কাহিনি এবং জাতক কাহিনি।
৪.চিত্রের ধরন: পালযুগের চিত্রগুলো স্বল্পায়তনের নয়। এগুলো দেয়ালচিত্রের ক্ষুদ্রাায়িত রূপ। চিত্রগুলোর সার্বিক পরিকল্পনা, রেখাশৈলি, বর্ণবিন্যাস, শৈল্পিক ভাবনার বিস্তৃতি, গভীরতা ও দৈঘ্য স্বল্পায়তন চিত্র থেকে আলাদা। এসব চিত্র বিন্যাসে ভাস্কর্যের প্রতিমা বিন্যাসের রীতি অনুসৃত হয়েছে।
৫.চিত্রে ব্যবহৃত বর্ণ: চিত্রশিল্পের প্রধানতম উপাদান বর্ণ। রঙের আল্পনায় চিত্রগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বাংলার চিত্রশিল্পে ব্যবহৃত বর্ণের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে হলুদ, সাদা, নীল, লাল, সবুজ, ও মিশ্র রঙ।
৬.চিত্রের আকৃতি প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য: আকৃতি প্রকৃতি, শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য এবং ভাবসম্পদের দিক থেকে বাংলার পাল আমলের চিত্রশিল্প পূর্ব ভারতীয় ভাস্কর্যের আমলে সৃষ্টি হয়েছে। এ চিত্রগুলো বজ্রযান তন্ত্রযান বৌদ্ধ দর্শনের গভীরতা থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। চিত্রগুলোতে ত্রিমাত্রিক ডৌরের সৃষ্টি হয়েছে রেখাবর্তনা ও বর্ণবর্তনার সাহায্যে।
৭.চিত্রশিল্পে অজান্তা ও ইলোরার প্রভাব : পূর্বভারতে চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যশিল্প প্রায় সমান্তরাল গতিতে বিকশিত হয়েছে। গুপ্ত শাসনামলে বাংলা ভাস্কর্য শৈল্পিক ঐতিহের সাথে সঙ্গতি রেখে পূর্বভারতে অজান্তা চিত্রের একটি সংস্কার চালু ছিল। রেখাসর্বস্ব চিত্ররীতির সূচনা ইলোরায়।
৮.মোগল আমলের চিত্রশিল্প : মোগলদের পৃষ্টপোষকতায় গড়ে উঠেছিল ক্ষুদ্রাকারের এক ধরনের চিত্র আঁকার রীতি। মোগল শাসকরা ঐতিহাসিক ঘটনা, তাদের দরবার, নিজেদের ছবি আঁকিয়েছিলেন। শায়েস্তা খান, মীর জুমলা, মুর্শিদকুলি খান, আালিবর্দী খান, সিরাজ-উ-দদৗলা প্রমুখের ছবি এর মধ্যে আছে।
৯.চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর : যিনি এক হেঁচকা টানে বাংলার চিত্রকলাকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি চিত্রকলা শিখেছিলেন দু’জন ইউরোপীয় শিল্পীর কাছে। একজন ইটালীয়, অন্যজন ইংরেজ। অবনীন্দ্রনাথের অনুসারীদের মধ্যে নন্দলালবসু, অসিত হালদার, আব্দুর রহমান প্রমুখ বিখ্যাত।
১০.চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : নতুন ধরনের ছবি এঁকেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কোন প্রাাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না কিন্তু চিত্র অঙ্কনে অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। ৬৭ বছর বয়সে তিনি ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন।
১১.চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন : বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম সুপরিচিত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন। চিত্র অঙ্কনে তিনিও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অনেক চিত্রকর্ম অঙ্কন করেছেন, তবে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের চিত্র তাঁকে খ্যাতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেয়।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুর ।