স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্পের ধারা ও বিষয়ভাবনার স্বরুপ বিশ্লেষণ কর। (বাংলাদেশের ছোটগল্প শিরোনামে নিবন্ধ/তোমার প্রিয় কোন লেখকের গল্প বিশ্লেষণ/হাসান আজিজুল হক)
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই ঐতিহাসিক ঘটনা বাঙালির জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের চেনার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ মিলেমিশে রয়েছে। দেশের যে সব লেখক-সাহিত্যিক রয়েছেন, তাদের জীবনেও মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব বিস্তার করে। তাই সঙ্গতকারণেই বাংলা সাহিত্যেও মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পরেছে। সাহিত্যের যে সব শাখা রয়েছে যেমন কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ সব জায়গায় এ প্রভাব পড়েছে। ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা। এ শাখাটি মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী চেতনাসহ সমাজবাস্তবতার চেতনায় সমৃদ্ধ হয়েছে। এ সময় বাংলা ছোটগল্পে বিষয় ভাবনায় বৈচিত্র্য আমরা দেখতে পাই। নিম্নে ১৯৪৭ উত্তর বাংলা ছোটগল্পে ধারা ও বিষয়ভাবনার স্বরুপ বিশ্লেষণ করা হলো-
১৯৪৭ উত্তর বাংলা ছোটগল্প রচনায় যারা সমকালীন সমাজ-জীবনকে শিল্পিত উপায়ে উপস্থাপন করেছেন, তাঁদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘আয়না’, ‘ফুড কন্সফারেন্স’, ‘আসমানী পর্দা’, ও ‘গালিভারের সফরনামা’ ইত্যাদি। মাহবুবুল আলম, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘তাজিয়া’, ‘পঞ্চঅন্ন’, ‘গোপ সন্দেশ’ ইত্যাদি। আবুল ফজল, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘মাটির পৃথিবী’, ‘মৃতের আত্মহত্যা’ ইত্যাদি। শওকত ওসমান, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘জুনু আপা ও অনান্য গল্প’, ‘সাবেক কাহিনি’, ‘ডিগবাজী’, ‘উপলক্ষ’, ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’, ইত্যাদি। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘নয়নচারা’, ‘দুই তীর ও অনান্য’। সরদার জয়েনউদ্দীন, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘নয়ানঢুলি’, ‘অষ্টপ্রহর’, ‘বেলা ব্যনাজির প্রেম’, ইত্যাদি। আবু ইসহাক, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘মহাপতঙ্গ’, ও ‘হারেম’ ইত্যাদি। শামসুদ্দিন আবুল কালাম, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘পথ জানা নেই’, ‘ঢেউ’, ‘দুই হৃদয়ের তীর’ ইত্যাদি। ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘জেগে আছি’, ‘ধানকন্যা’, ‘মৃগনাভি’, ‘উজান তরঙ্গে’, ‘স্বপ্ন আমার’ ইত্যাদি। জহির রায়হান, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘সূর্যগ্রহণ’, হাসনাত আব্দুল হাই, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘একা’, ‘একসঙ্গে, ‘যখন বসন্ত’ ইত্যাদি। হাসান হাফিজুর রহমান, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘আরো দুটি মৃত্যু’; আল মাহমুদ, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’, ‘আল মাহমুদের গল্প’ ইত্যাদি। শওকত আলী, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ইত্যাদি। রশীদ হায়দার, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘অন্তরে ভিন্ন পুরুষ’, ‘তখন’, ‘আমার প্রেমের গল্প’ ইত্যাদি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, দুধে-ভাতে উৎপাত’ ইত্যাদি। সেলিনা হোসেন, তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘উৎস থেকে নিরন্তর’, ‘খোল করতাল’ ইত্যাদি। আব্দুল মান্নান সৈয়দ তাঁর গল্পগ্রন্থ হলো ‘সত্যের মত বদমাশ’, ‘চলো যাই পরোক্ষে’ প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এ সব গল্পকাররা বাংলা ছোটগল্পকে একটি বিশেষ পর্যায়ে উন্নিত করেছেন। গল্পের প্লট নির্বাচন, কাহিনি বর্ণনা, চরিত্র নির্মাণে তাঁরা দক্ষ শিল্পির পরিচয় দিয়েছেন। শব্দের পর শব্দ বসিয়ে কাহিনি নির্মাণ করেছেন। প্রতিটি গল্পকার এক একজন অভিজ্ঞ সমাজ বিশেষজ্ঞ ও শিল্পনির্মাতা। সমাজকে অত্যন্ত সুন্দর ও স্বচ্ছভাবে গল্পে উপস্থাপন করেছেন। সমকালীন সময়, সমাজ, সামাজিক পরিবেশ ও সমাজস্থ মানুষগুলোর বিবিধ বৈশিষ্ট্য শিল্পিত উপায়ে লেখকেরা এ সব গল্পে উপস্থাপন করেছেন।
গল্প তো মানব জীবন থেকেই নির্মিত হয়। গল্পকাররা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প রচনা করেছেন যেমন প্রেম, ভালোবাসা, বিরহ, রাজনীতি, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি। এ সব গল্পগুলোতে সামাজিক অবস্থার একটি শৈল্পিক রুপায়ণ আমরা দেখতে পাই। সমাজ জীবনে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ উচ্চশ্রেণি, নিম্নশ্রেণি এই দুইভাগে বিভক্ত। আমরা ‘নয়নচারা’ গল্পে সমাজ ব্যবস্থার এই চিত্র দেখতে পাই। গল্পের নায়ক চরিত্র আমু নিম্নশ্রেণির মানুষ। দু’মুঠো ভাতের আশায় আমু গ্রাম থেকে শহরে যায়। কিন্তু দেখতে পায় যে শহরের মানুষ আরো অমানবিক। সমাজ জীবনের এই চিরন্তন সত্যটি লেখক গল্পের মাধ্যমে পাঠকের নিকট উপস্থাপন করেছেন। সমাজের কিছু মানুষ আছে, যারা সব সময় কায়দা-কৌশল করে নিজের স্বার্থ নিশ্চিত করে। তারা সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। ‘ফুড কন্সফারেন্স’ গল্পে আবুল মনসুর আহমদ সমাজের এই মানুষের শ্রেণিচরিত্র উপস্থাপন করেছেন। তাছাড়া আবুল মনসুর আহমদের গল্প রচনার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে সমাজচিত্রের সঠিক রুপায়ণ করা। শওকত ওসমান তাঁর গল্পে সমাজ জীবনের বিচিত্র মানুষের পরিচয়, জীবনের দারিদ্র, সংগ্রাম, ধর্মের বাহ্যিক রীতি-নীতি তাঁর গল্পে স্থান পেয়েছে। গল্পে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপিত হয়েছে। আবু ইসহাক তাঁর গল্পে সমাজের একটি বিশেষ দিক উপস্থাপন করেছেন। এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা সমাজকে জোকের মতো শোষণ করে-এই বিষয়গুলো আবু ইসহাক বাংলা ছোটগল্পে শিল্পিতভাবে তুলে ধরেছেন। শামসুদ্দিন আবুল কালাম এর ছোটগল্পগুলো বৈপ্লবিক সমাজ চেতনায় সমৃদ্ধ। তাঁর বেশিরভাগ গল্পই গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত হয়েছে। লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতায় এ গল্পগুলো শিল্পসফল হয়েছে। ‘পথ জানা নেই’ গল্পে গওহর নামে একটি পুরুষ চরিত্র আছে। সে গ্রামের কাঁচা রাস্তা নিজের হাতে তৈরি করে, আর ভাবে একদিন তার জীবনে সুসময় আসবে, অভাব দূর হবে। কিন্তু তার অভাব দূর হয়নি। বরং সেই রাস্তা দিয়ে তার স্ত্রী পর পুরুষের হাত ধরে চলে যায়। এটি সমকালীন সমাজের একটি বিশেষ দিকের প্রতি লেখক ইঙ্গিত করেছেন। এভাবে দেখা যায় যে, গল্পকাররা নতুন নতুন বিষয় নিয়ে গল্প রচনা করেছেন এবং বাংলা ছোটগল্পের ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বিপন্ন হয়েছে। নারীরা সম্ভ্রম হারিয়েছে। মানব বসতি জনশূন্য হয়েছে। এ যেন এক বিশাল বন্দীদশা। এই বন্দীদশায় মানবজীবনের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ও আনুষঙ্গিক নানাবিধ বিষয় গল্পকাররা বাংলা ছোটগল্পে উপস্থাপন করেছেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ইতহাসের অংশ। কিন্তু এ ছোটগল্পগুলো পড়লে ইতিহাস নয়, যেন জীবন্ত জীবন্ত-চিত্র পাঠকের সামনে ভেসে উঠে। বিষয়বস্তু নির্বাচন, কাহিনি বিশ্লেষণ, সমাজচিত্র নির্মাণ, ও চরিত্র গঠনে প্রত্যেক গল্পকারের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। সমকালীন সময়, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-প্রকৃতি এ সব গল্পে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭১ উত্তর বাংলা ছোটগল্পের ধারা ও বিষয় ভাবনায় গল্পকাররা নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন।