বঙ্গদর্শনের পত্র সূচনা প্রবন্ধ অবলম্বনে বাঙালির মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থা ও সাময়িকপত্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বঙ্কিমের অভিমত আলোচনা কর।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৮৯৪) বাংলা ভাষার প্রথম সফল গদ্যশিল্পী। উপন্যাসের মতো বাংলা প্রবন্ধ রচনায় তিনি সফলতা দেখিয়েছেন। তিনিই বাংলা ভাষায় প্রথম তুলনামূলক সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থের সংখ্যা অনেক। তন্মধ্যে ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ অন্যতম একটি প্রবন্ধ গ্রন্থ । এ প্রবন্ধ গ্রন্থে ‘বঙ্গদর্শনের পত্র সূচনা’ নামে একটি প্রবন্ধ রয়েছে। বঙ্কিম এ প্রবন্ধে বাংলা ভাষা বিষয়ে বাঙালিদের অবস্থা, সাময়িকপত্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন। নিম্নে এ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য আলোচনা করা হলো-
একজন সার্থক উপন্যাসিক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরিচিত। তিনি একজন সার্থক প্রাবন্ধিকও । ‘বঙ্গদর্শন’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা ১৮৭২ সালে বঙ্কিমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যের সমালোচনা, জাতীয় সংস্কৃতি, সমাজ ও জীবন অবলম্বনে তিনি অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি অত্যন্ত সহজ সুন্দর ও স্পষ্টভাবে বক্তব্য প্রকাশ করেন। বঙ্কিমের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল। তিনি নিজের সময়, সমাজ ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে চিন্তা করতেন। তাঁর চিন্তার নানা দিক ‘বঙ্গদর্শনের পত্র সূচনা’ প্রবন্ধে প্রকাশি হয়েছে।
‘বঙ্গদর্শনের পত্র সূচনা’ প্রবন্ধে তিনি বাঙালির মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র লক্ষ্য করেছেন যে, এ দেশের কিছু মানুষ বাংলা ভাষাকে আর বিশ্বাস করছে না। তারা ইংরেজি ভাষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, ইংরেজি ভাষায় কথা বলছে, সংলাপ রচনা করছে। ইংরেজি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করছে, সভা, সেমিনার, সিম্পজিয়াম করছে, এমনকি মন্দিরে মন্ত্রও ইংরেজিতে পাঠ করছে। এবং রীতিমত ইংরেজি ভাষার ব্যবহার ও অনুশীলনের মাধ্যমে অনেকটা নিজেদেরকে ইংরেজতুল্য বানিয়ে ফেলেছে। ইংরেজি ভাষা জানা, বোঝা, চর্চা করা তাদের কাছে এক ধরনের গর্বের বিষয়। তারা বাংলাকে না জানা এবং বাংলা ব্যবহার না করাকে অনেকটা অহংকারের বিষয় মনে করে। এরা হলো নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায়, অনেকটা পাশ্চাত্য স্টাইলে নিজেদেরকে ভাসিয়ে দিতে পছন্দ করে। এ সমস্ত নব্য শিক্ষিত সম্প্রদায় বাংলা ভাষাকে অশিক্ষিত, মুর্খ বা কম শিক্ষিতের ভাষা বলে মনে করে। তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে, বাংলা ভাষায় উচ্চ মান সম্পন্ন কোন গ্রন্থ রচিত হতে পারে না। বাংলা ভাষার কদর অনেকটা কমে আসে। ইংরেজি না জানলে জ্ঞান অর্জন করা যায় না, অর্থ উপার্জন করা যায় না, সম্মান অর্জন করা যায় না, সামাজিক অবস্থান পাওয়া যায় না। তাই কিছু শিক্ষিত নব্য সম্প্রদায় ইংরেজি ভাষার কাছে নিজেদেরকে সঁপে দেয় এবং বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা ও অবহেলার চোখে দেখতে থাকে। এই হলো সমকালীন সময়ে বাংলা ভাষার অবস্থা। তাই এই পর্যায়ে যারা বাংলা সাময়িক পত্র প্রচার করে, তারা কিছুটা ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই সমকালীন সময়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন পাশ করেন, তিনি ইংরেজি ভালোই জানতেন। ইংরেজি ভাষা বিষয়ে তাঁর কোন বিদ্বেষ ছিল না। তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন যে, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির উন্নতির জন্য ইংরেজি ভাষা জানা দরকার। তবে বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। প্রয়োজনে ইংরেজির ব্যবহার করতে হবে, অপ্রয়োজনে নয়। বরং বাংলা ভাষার চর্চায় নিজেকে যুক্ত করতে হবে,্ আর যেখানে ইংরেজির প্রয়োজন সেখানে ইংরেজির ব্যবহার করতে হবে। এভাবে নিজের ভাষা ও বিদেশি ভাষার সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে নিজেদের উন্নতি করা সম্ভব। সমাজে বাংলা গ্রন্থ, বাংলা সংবাদপত্র, বাংলা সাময়িকপত্রে, বাংলা গবেষণাগ্রন্থে বাঙালির আগ্রহ কম। এর কারণ হিসেবে তিনি সমকালীন সাময়িক পত্রের স্বল্পতা ও নিচুমানকে দায়ি করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র বিশ্বাস করতে চান যে, মানসম্পন্ন সাময়িকপত্র প্রচার ও প্রসার ঘটলে পাঠকের অভাব হবে না। শিক্ষিত বাঙালি বাংলায় বই রচনা করে না, এজন্য বাঙালি বাংলা পাঠ করে না। উচ্চ শিক্ষিত সম্প্রদায় বাংলা ভাষায় মানসমপন্ন বই প্রকাশ করলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমাদর বাড়বে।
এ অবস্থার পেক্ষাপটে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাময়িকপত্র প্রকাশের উদ্যোগ করেন। তিনি বাংলা ভাষাকে সব পাঠকের নিকটে পৌঁছে দিতে চান। সাময়িক পত্রিকার উদ্দেশ্য কোন বিশেষ গোষ্ঠী নয়, কোন পণ্ডিত ব্যক্তিও নয়, বরং সর্বসাধারণ মানুষের জন্য সাময়িকপত্রের প্রকাশ। তাই এর ভাষা ও বিষয়বস্তুও হবে এমন যাতে সবাই পড়তে ও বুঝতে পারে এবং এ শিক্ষাকে দেশ ও জাতির উন্নতির জন্য কাজে লাগাতে পারে। অনেকে বলে থাকেন যে, বাংলা ভাষায় মানসম্পন্ন সাময়িকপত্রিকার অভাব রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র সেই অভাব দূর করতে চান। প্রাবন্ধিক মনে করেন যে, গুণগত লেখা প্রকাশ হলে পাঠক তা গ্রহণ করবেই। পাঠক যে রকম লেখা পছন্দ করে, সেই রকম লেখা লেখতে হবে। বাংলায় অনেক সাময়িকপত্র প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু কোন সাময়িকপত্র দীর্ঘদিন টিকতে পারে নি। বঙ্কিম মনে করেন যে, তবুও এর একটা আলাদা মূল্য রয়েছে। তিনি একটি পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করতে চান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বাঙালির পাঠ উপযোগী করে তুলতে চান। আর এমন একটি মহৎ উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিনি বাংলা ভাষায় একটি সাময়িকপত্র প্রকাশ করতে চান। অবশেষে তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবে সত্য হয়েছে। ১৮৭২ সালে বাংলা সাহিত্য সম্পকির্ত ‘বঙ্গদর্শন’ নামে একটি বাংলা সাময়িকপত্র প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিতে বেশ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘বঙ্গদর্শনের পত্র সূচনা’ প্রবন্ধে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য এ প্রবন্ধে তিনি কিছু যৌক্তিক মতামত ব্যক্ত করেছেন যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।
সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।