বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে গল্পের শিল্পমূল্য-আলোচনা কর। অথবা, (মধ্যবিত্ত জীবন / নিম্নবিত্ত জীবন / প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনচিত্র / হতদরিদ্র মানুষের জীবনযন্ত্রণার রুপকার / নাগরিক জীবন)
ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় শাখা। আধুনিক যুগে এ শাখার সৃষ্টি হয়েছে এবং বর্তমানে এ শাখা সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধি লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটগল্পের সার্থক স্রষ্টা। এরপর বাংলা সাহিত্যে অনেক লেখক এসেছে। এদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৩-১৯৮৮) একজন অন্যতম লেখক। বাংলা ছোটগল্প রচনায় তিনি বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর শিল্পসম্মত ও জনপ্রিয় গল্পের সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে ‘শুধু কেরানী’, ‘পুন্নাম’, ‘সাগর সঙ্গমে’, ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘মৃত্তিকা’, ‘মহানগর’, শৃক্সক্ষল’, ইত্যাদি অন্যতম। প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ গল্পে সমাজের আধুনিক মানুষের নিঃসহায়তার চিত্র ও জীবনযন্ত্রণা উপস্থাপন করেছেন। ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ একটি শিল্পসফল গল্প। নিম্নে গল্পটির শিল্পমূল্য আলোচনা করা হলো-
প্রেমেন্দ্র মিত্র সমাজসচেতন শিল্পী। তিনি সমকালীন সমাজে মানুষের শ্রেণিবিভাজন দেখতে পেয়েছেন। একই সমাজে একজন গাছতলায়, আবার একজন পাঁচতলায়। একজন দু’বেলার খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না, আবার আরেকজন অসংখ্য মানুষের খাবার মজুত করে রাখছে। সমাজে ধনী-গরীবের বৈষম্য এতটাই প্রকট। প্রেমেন্দ্র মিত্র এসব ব্যবধান দেখেছেন আর এগুলোকেই ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেছেন। চরিত্রগুলোও তিনি সমাজের প্রান্তিক মানুষ থেকে নির্বাচন করেছেন। তাঁর গল্পগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, অধিকাংশ গল্পের নারী ও পুরুষ চরিত্র সমাজের অল্প আয়ের ও নিচু তলার মানুষ। যেমন ‘শুধু কেরানী’ গল্পের নায়ক ছেলেটি, নায়িকা মেয়েটি, ‘পুন্নাম’ গল্পের ললিত, ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ গল্পের বেগুন ছদ্ম নামের মেয়েটি, ‘সংসার সীমান্তে’ গল্পের রজনী, অঘোর দাস ইত্যাদি। তারা সবাই সমাজের প্রান্তিক মানুষ। সমাজের ছোট পেশা তারা অবলম্বন করেছে, অল্প একটু উপার্জন করেছে, অনেকটা দিন আনে দিন খায় এ রকম। সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষের জীবনযšত্রণাকে প্রেমেন্দ্র মিত্র ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ গল্পে উপস্থাপন করেছেন। বিষয়টি আরো একটু বিশ্লেষণ করতে চাই।
‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ একটি অসাধারণ গল্প। নাগরিক জীবনে স্বল্প আয়ের মানুষগুলোর অসহায়তার চিত্র প্রেমেন্দ্র মিত্র এ গল্পে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ গল্পটিতে নাগরিক জীবনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের করুণ চিত্র বাংলা ছোটগল্পে উপস্থাপন করেছেন। একটি পতিতা মেয়ের জীবনকাহিনি নিয়ে এ গল্পটি গড়ে উঠেছে। কোন কল্পনা নয়, বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে এ গল্পের কাহিনি পরিণতি লাভ করেছে। লেখক এ গল্পে বেগুন নামের একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। এটিই এ গল্পের নায়িকা। জীবন বাঁচিয়ে রাখার মতো সম্পদও এ মেয়ের নেই। তাই পতিতাই তার একমাত্র পেশা। কিন্তু তবুও দু’মাস ধরে বেগুন কোন পুরুষকে রাতে অতিথি করতে পারে নি। কারণ তার যৌবন শেষ। কিন্তু পেটে ক্ষুধা আছে। তাই একমাত্র সিল্কের একটি সুন্দর শাড়িটি পড়ে সে সব সময় পুরুষকে কাছে টানার চেষ্টা করে। কিন্তু দু’মাস ধরে একজন পুরুষকেও কাছে পায় নি। তাই বাড়ির মাসির কাছে অনেক কথা শুনতে হয়। শেষ পর্যন্ত মাসির চাপে একটি আধলি খরচ করে নিজেকে সাজিয়ে নেয় এবং সাহেবদের মেলায় ঢোকে। কিন্তু একজন পুরুষকেও আকৃষ্ট করতে পারে নি। একজন কদাকার, কুৎসিত পুরুষ সে পেয়েছিল কিন্তু গ্রহণ করে নি। কিন্তু শেষে বাধ্য হয়েই বেগুন কদারকার পুরুষটিকেই কাছে টেনে নেয়। কেননা দুমুঠো ভাত ছাড়া বেগুন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না। তাই বেগুন কুৎসিত লোকটিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে, নিজের মধ্যে এক অসীম শূন্যতা ও হতাশা, তবু বেগুন লোকটিকে বলে ‘চল’। এমনই মানুষের নির্মম জীবনকাহিনি। নাগরিক জীবনে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের জীবন সংগ্রাম ও অসহায়তার চিত্র প্রেমেন্দ্র মিত্র আমাদেরকে দেখিয়েছেন। এইভাবে দেখা যায় যে, প্রেমন্দ্র মিত্রের ছোটগল্পের চরিত্রগুলো সমাজের প্রান্তিক মানুষ। পেশায় তারা কেউ কেরানী, কেউ পতিতা, কেউ চোর, আবার কেউ অন্য কোন ছোট ও অবহেলিত পেশার সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ তারা সবাই ছোট ও অবহেলিত পেশার সঙ্গে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনভাবে বেঁচে থাকে। প্রেমেন্দ্র মিত্র মানব জীবনের দীনতার বিশেষ দিক আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সমাজ ব্যবস্থার কিছু সমস্যা ও ত্রুটি আমাদেরকে দেখিয়েছেন, নিম্ন আয়ের মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করে। জীবনের মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত, এমনকি খাবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বস্তুটি তারা সংগ্রহ করতে পারে না। এমনই করুণ তাদের যাপিত জীবন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ভাষা বিষয়ে বেশ দক্ষতা ছিল। বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তোলার জন্য যে রকম ভাষার প্রয়োজন, প্রেমেন্দ্র মিত্র সে রকম ভাষা ব্যবহার করেছেন। সাধু ভাষায় গল্প লিখিত হলেও সহজ-সরল শব্দ দিয়ে বাক্যের পর বাক্য সাজিয়ে নান্দনিক উপস্থাপনাগুণে ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ গল্পটি শিল্পসফলতা লাভ করেছে। এ রকম শিল্পসফল গল্প বাংলা ছোটগল্পে খুব কম আছে।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, প্রেমেন্দ্র মিত্র একজন সমাজসচেতন শিল্পী। তিনি সচেতনভাবে ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁকে’ গল্পতে সমকালীন সমাজের অবহেলিত নি¤œমধ্যবিত্ত মানুষের জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-বেদনাময় চিত্র তিনি উপস্থাপন করেছেন। সমাজের কিছু মানুষ জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে জীবন সংগ্রাম করেছে। তারা কখনো অফিসের সর্বনিম্ন পদে, কখনো নদীতে, আবার কখনো পতিতাবৃত্তিতে নেমেছে, চেষ্টা করেছে দুটি পয়সা উপার্জনের। এভাবেই তাদের প্রতিদিনের সংগ্রাম চলে। তাই সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে বলা যায় যে, সাধারণ হতদরিদ্র মানুষের জীবন যন্ত্রণার অসামান্য রুপকার প্রেমেন্দ্র মিত্র। তিনি যেভাবে ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁকে’ গল্পে সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনের কথা উপস্থাপন করেছেন এভাবে আর কোন লেখক করতে পারে নি। বিষয়বস্তু নির্বাচন, চরিত্র নির্মাণ, কাহিনি বর্ণনা সর্বোপরি উপস্থাপনাশৈলীতে ‘বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে’ একটি শিল্পসফল গল্প।
সালেক শিবলু এমফিল, গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ।