বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারায় প্রমথ চৌধুরীর অবদান মূল্যায়ন কর।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল কবিতা নির্ভর। বাংলা প্রবন্ধসাহিত্য আধুনিক যুগের সৃষ্টি। ১৫৫৫ সালে কুচবিহারের রাজা আসামের রাজার নিকট একটি পত্র লেখেন। এটাই বাংলা ভাষার গদ্যের প্রথম নিদর্শন। বাংলা সাহিত্যে গদ্য প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে প্রবন্ধ সাহিত্যের উদ্ভব ঘটে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইংরেজদের প্রচেষ্টায় বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য আস্তে আস্তে উন্নতি সাধন করে। এ সময় বিচিত্র বিষয় অবলম্বনে প্রবন্ধসাহিত্য রচিত হয়। উনিশ শতকের প্রথম দিকে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের সূত্রপাত হলেও এই শতকের শেষের দিকে প্রবন্ধ সাহিত্যের যথার্থ বিকাশ ঘটে। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের উন্নতিতে যে সমস্ত বাঙালিরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬) অন্যতম। নিম্নে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারায় প্রমথ চৌধুরীর অবদান মূল্যায়ন করা হলো-
প্রমথ চৌধুরী কিছু ছোট গল্প ও কবিতা রচনা করেছেন। তবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি পরিচিত। প্রবন্ধ রচনায় তিনি মননশীল চিন্তা-ভাবনার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যে যুক্তিশীল মনের মানুষ এটা তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ পড়লে সহজেই বোঝা যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ হলো ‘তেল নুন লাকড়ী’, ‘বীরবলের হালখাতা’, ‘সনেট পঞ্চাশৎ’, ‘চার ইয়ারি কথা’, ‘নানা চর্চা’ ইত্যাদি। তার রচনার পরিমান অল্প মনে হলেও সাহিত্যের শিল্প বিচারে তা অনন্য মাত্রা লাভ করেছে। প্রমথ চৌধুরী একজন সংস্কারমুক্ত মনের মানুষ, এটা তার রচনাতেই পাওয়া যায়। তার ভাষা সহজ, সরল, প্রাঞ্জল, এবং বাক্যের মধ্যে অর্থের গতিশীলতা রয়েছে। প্রমথ চৌধুরী একজন ¯্রষ্টা। তিনি সব সময় অভিনব কিছু সৃষ্টিতে বিশ্বাসী। প্রচলিত বাংলা ভাষার সাধু রীতিতে তিনি আস্থা রাখতে পারেন নি। এই ভাষা রীতিতে মনের ভাব সম্পন্ন প্রকাশ করা বেশ কঠিন। সাধু ভাষারীতিতে তৎসম ও অর্ধ তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি। ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদগুলো লম্বা হয়, এবং এই ভাষারীতি বেশ গম্ভীর। তাই প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে চলিতরীতি প্রচলনের সিদ্ধান্ত নেন। চলিত রীতিতে সর্বনাম পদ ও ক্রিয়াপদগুলো ছোট হয়, বক্তার মনের ভাবটি খুব সহজেই প্রকাশ করা যায়। এই ভাষা রীতি যেমন বলা সহজ তেমনই শুনতেও মধুর। তাই তিনি বাংলা গদ্যে চলিত রীতি প্রবর্তন করেন। আর এ জন্য তিনি ‘সবুজ পত্র’ নামে একটি সাহিত্য পত্র চালু করেন। তিনি নিজেই এই সাময়িক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৯১৪ সালে মাসিক পত্রিকা হিসেবে এটি প্রকাশিত হয়। প্রমথ চৌধুরী নিজে এই পত্রিকায় চলিতরীতিতে প্রবন্ধ রচনা করেন। প্রমথ চৌধুরীর লেখা রীতি অনুসরণ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখক এই চলিতরীতিতে গদ্য রচনা আরম্ভ করেন। এমন কি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত এই চলিতরীতি অনুসরণ করে ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেন। খুব সংক্ষেপে বলা যায় যে, ‘সবুজপত্র’কে কেন্দ্র করে একটি লেখক গোষ্ঠী গড়ে উঠে যারা পরবর্তী সময়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নের্তৃত্ব দিয়েছেন।
প্রমথ চৌধুরী বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলায় কথ্যরীতিতে কেউ প্রবন্ধ রচনা করার সাহস পায় নি। প্রমথ চৌধুরী এই ক্ষেত্রে পথনির্দেশের ভূমিকা পালন করেছেন। প্রমথ চৌধুরীর ভাষাস্টাইল সম্পর্কে আসল কথা হলো, ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা করতে গেলে মানুষের মুখে কালি পড়ে। এই ছোট্ট একটি বাক্যের মধ্যেই প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ রচনারীতির বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে রয়েছে। তিনি মানুষের মুখের ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এবং এই ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। এতে করে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। সাহিত্য যেহেতু মানুষের জন্য রচনা করা হয়, তাই সেখানে মানুষের মুখের ভাষাই প্রাধান্য পাবে। এটাই যৌক্তিক কথা। প্রমথ চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে ‘বীরবল’ ছদ্মনামে লেখতেন। ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় যে সব ব্যাঙ্গাত্মক রচনা প্রকাশ হয় সেগুলো ‘বীরবল’ নামেই প্রকাশ পায়। তাই তাঁর গদ্যভাষাকে ‘বীরবলী’ গদ্য ভাষা হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাঁর মধ্যে কবিত্বশক্তি থাকলেও প্রবন্ধ রচনায় তিনি মননশীল মনের পরিচয় দিয়েছেন। ইংরেজি ও ফরাসি সাহিত্যে তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক। তাঁর রচিত গদ্যরীতি বাংলা ভাষায় চলিত ভাষার মর্যাদা লাভ করে।
বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীর যে প্রবন্ধ সংগ্রহ রয়েছে তা যে কোন দিক থেকে অতুলনীয়। এখানে প্রবন্ধ সংগ্রহ থেকে কিছু প্রবন্ধের নাম উল্লেখ করতে চাই। যেমন ‘বঙ্গ সাহিত্যে নবযুগ’, ‘সবুজপত্রের মুখপত্র’, ‘সাহিত্যে খেলা’, ‘বই পড়া’, ‘বীরবল’, ‘কথার কথা’, ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’, ‘আমরা ও তোমরা’, বর্ষা ইতাদি। এ সমস্ত প্রবন্ধে তিনি মননশীল চিন্তা-চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। কিছু কিছু প্রবন্ধে সাহিত্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনা করেছেন। ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে তিনি সাহিত্যের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। প্রাবন্ধিক বলেন যে, সাহিত্যের উদ্দেশ্য হলো আনন্দ দেওয়া, কারো মনোরঞ্জন করা নয়। ‘বঙ্গ সাহিত্যের নবযুগ’ প্রবন্ধে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা বলেছেন। ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে তিনি বই পড়ার গুরুত্ব ও সেই জন্য লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। ‘সবুজপত্র’ প্রবন্ধে তিনি বাংলার প্রকৃতি ও তারুণ্যের কথা বলেছেন। ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক যৌবনকে সুরক্ষার কথা বলতে চেয়েছেন। এইভাবে দেখা যায় যে, প্রমথ চৌধুরী প্রবন্ধ সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য উন্নতি সাধন করেছেন।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখা যায় যে, প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যভাষা ও প্রবন্ধ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনিই প্রথম বাংলা গদ্য ভাষায় চলিত ভাষারীতি প্রচলন করেছেন। এতে বাক্যে অর্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে সব বাধা দূর হয়েছে। বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে সুন্দর যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে এ ভাষারীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। প্রমথ চৌধুরী প্রথম পর্যায়ে বাংলা গদ্যভাষাকে আড়ষ্ঠতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। গদ্য ভাষার মধ্যে যে সজীব প্রাণশক্তি রয়েছে এটি প্রমথ চৌধুরী প্রথম আবিস্কার করেন। সুতরাং বিষয়টির সার্বিক বিবেচনা ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বলা যায় যে, প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার যথার্থ শিল্পী ও প্রাবসিন্ধক। এক কথায় বাংলা গদ্যভাষা ও প্রবন্ধ বিকাশে তার অবদান অপরিসীম।