বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে নজরুল ইসলামের অবদান আলোচনা কর।
কাজী নজরুল (১৮৯৮-১৯৭৬) ইসলামের প্রধান পরিচয় কবি। কবিতা রচনা করে তিনি তাড়াতাড়ি খ্যাতি লাভ করেন এবং বিদ্রোহী কবি বলে খ্যাতি লাভ করেন। তবে কবিতার ছাড়া প্রবন্ধ রচনায়ও তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মোট চারটি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলো হলো ‘যুগ-বাণী’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’, ‘রুদ্র-মঙ্গল’, ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’, ধূমকেতু ইত্যাদি । এ সব প্রবন্ধগ্রন্থে নজরুল ইসলামের দেশপ্রেম ও বিদ্রোহীসত্ত্বার পরিচয় ফুটে উঠেছে। বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে নজরুল ইসলাম স্বতন্ত্রমাত্রা যুক্ত করেছেন। বিষয়টি নিম্নে আলোচনা করা হলো-
কাজী নজরুল ইসলাম একজন মানবতাবাদী লেখক। পরাধীন ভারতবর্ষে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভারতবাসীর পরাধীন জীবন তাকে কষ্ট দিতো। প্রায় দুইশত বছর বৃটিশরা এ দেশ শাসন-শোষণ করেছে। নানা অত্যাচার ও অনাচারে ভারতবাসীর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। নজরুল এ গুলো নিজে দেখেছেন। মানুষের দুর্দশা দেখে তাঁর অন্তর কেঁদে উঠে। তিনি এ অন্যায় প্রতিরোধ ও প্রতিকারের লক্ষ্যে প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে তিনি এ ভারতবাসীকে জাগ্রত করবার জন্য কলম হাতে নেন। রচনা করেন অমর সাহিত্যকর্ম, যা পাঠ করে এ দেশের মানুষ সচেতন হতে পেরেছে, তাই বৃটিশরা নজরুলের বিরুদ্ধে রাষ্টদ্রোহের অভিযোগ আনে। এ অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয়। আলীপুর সেন্টার জেলে তাকে বন্দী রাখা হয়, তারপর তার বিচারকার্য শুরু হয়। আদালতে তিনি ১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি যে লিখিত জবাব দেন, তাই পরবর্তি সময়ে ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে প্রকাশিত হয়। তাই কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ রচনার মূলে রয়েছে দেশপ্রেম।
কাজী নজরুল ইসলাম মানবতার মুক্তির দূত হিসেবে ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রগতিশীল, মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার মানুষ, ভাবতেন দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে। কীভাবে ভারতবাসীকে পরাধীনতার শেকল থেকে মুক্ত করা যাবে এটাই ছিল তাঁর মৌলিক ভাবনা। তাঁর প্রবন্ধ রচনার মূল ভিত্তি হলো দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। কাজী নজরুল ইসলাম হলেন মানবতাবাদী লেখক। তিনি সত্যেকে ভালোবাসতেন, সত্য পথে থাকতেন, সত্য কথা বলতেন, সত্য বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনা করতেন। সত্যের পথে মানুষকে ডাকতেন। তার কাছে সত্যই সুন্দর। তিনি সব সময় সত্য ও সুন্দর পথের পথিক। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তিনি গ্রেফতার হয়েছেন, জেলে বন্দি থেকেছেন। কিন্তু সত্য থেকে এক বিন্দুও বিচলিত হোন নি। সব সময় সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকেছেন। এ দেশ ও দেশের মানুষকে গভীরভাবে ভালোবেসেছেন। নজরুল ইসলাম ‘আমার পথ’ নামক প্রবন্ধে বলছেন-‘আমার কর্ণধার আমি। আমার পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি-নমস্কার করছি আমার সত্যকে। যে পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ আর কোনো পথই আমার বিপথ নয়। রাজভয়, লোকভয় কোনো ভয়ই আমার বিপথে নিয়ে যাবে না।’ নজরুল ইসলাম কোন শক্তিকে ভয় করেন নি। কোন শক্তির কাছে মাথা নত করেন নি। অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধগ্রন্থে বাংলার স্বাধীনতা দাবি করেছেন। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে নজরুল ইসলামের মতো স্পষ্ট করে আর কোন প্রাবন্ধিক স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে নি। তিনি প্রবন্ধগ্রন্থে কোন ভণিতা করেন নি। বরং সরাসরি বাংলার স্বাধীনতা কামনা করেছেন। নজরুল ইসলামের কথা, স্বরাজ-টরাজ চাই না, বাংলার এক ইঞ্চি মাটিও বিদেশির অধীনে থাকবে না। এই হলো বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে নজরুল। তিনি ‘ধূমকেতু’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা ১৯২২ সালে প্রকাশ করেন। এ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি ভারতবাসীর স্বাধীনতা চেয়েছেন সরাসরি। তিনি নিঃশর্তভাবে দেশের জন্য কাজ করেছেন। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি সত্যের পূজারী।
রাষ্টদ্রোহ মামলায় নজরুলকে বন্দি করা হয়। আদালতে মামলার শুনানি হয়। কবি আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। এবং এর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। প্রাবন্ধিক বলেছেন যে, তাঁর পিছনে স্বয়ং ভগবান আছেন, তিনি ভগবানের নির্দেশেই এ কাজ করেছেন। ভগবানই তাঁকে এ কাজের জন্য পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলাম মনে করেন যে, তার সব কর্মকা-ের পিছনে রয়েছে ভগবান। প্রাবন্ধিক বলেছেন ‘ সুর আমার বাঁশির নয়, সুর আমার মনে এবং আমার বাঁশি সৃষ্টির কৌশলে। অতএব দোষ বাঁশিরও নয়, সুরেরও নয়; দোষ আমার, যে বাজায়, তেমনই যে বাণী আমার কণ্ঠ দিয়ে নির্গত হয়েছে, তার জন্য আমি দায়ী নই। দোষ আমারও নয়, আমার বীণারও নয়, দোষ তাঁর-যিনি আমার কণ্ঠে তাঁর বীণা বাজান। সুতরাং আমি রাজবিদ্রোহী নই; প্রধান রাজবিদ্রোহী সেই বীণা বাদক ভগবান’।
কাজী নজরুল ইসলাম একজন নির্ভিক সৈনিক। তাঁর মনে কোন ভয় ছিল না। তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। তনি ভাবতেন যে সত্য প্রকাশ করাই তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য। বৃটিশরা অন্যায়ভাবে এ দেশকে শাসন করছে, তারা সত্যকে মিথ্যা বানাচ্ছে, মিথ্যাকে সত্য বানাচ্ছে; তারা ন্যায়কে অন্যায় বলছে, অন্যায়কে ন্যায় বলছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ তা বুঝতে পারছে না। বুঝলেও কিছু বলছে না বা বলতে পারছে না। তাই তিনি শাসকদের মুখোশ খুলে দিতে চান। আর এ জন্য তিনি বিদ্রোহের সুর বাজান। তিনি বলছেন যে, ‘আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তক প্রেরিত’। সত্য উচ্চারণ করলে, সত্য পথে চললে, সত্য কথা বললে, সুন্দর ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করলে যদি বিদ্রোহ হয় তাহলে তিনি বিদ্রোহী। আর এ বিদ্রোহ ভগবানের কাছ থেকেই এসেছে। সুতরাং কেউ তাঁকে এ পথ থেকে এক বিন্দু পরিমাণেও সরাতে পারবে না। তিনি কাউকে দেখে ভয় পান না, কোন শক্তির কাছে মাথা নত করেন না, কোন লোভের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেন না। কেউ কোনভাবেই তঁকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে নাÑএই কথাগুলো তিনি ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন। তাই কবির যে কোন প্রবন্ধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রবন্ধ-সাহিত্য ভাবনা ও আত্মচেতনার মূলে রয়েছে দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম।
উপর্যুক্ত বিষয়ের আলোচনা-পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন প্রবন্ধের মূলে রয়েছে দেশের প্রতি তাঁর গভীর প্রেম আর মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। এই দেশপ্রেম ও ভালোবাসাই তাঁকে এ রকম অমর প্রবন্ধ সাহিত্য রচনায় প্রেরণা দিয়েছে। তিনি সব সময় সত্য ও সুন্দরের পূজারী। তিনি সত্য বলতে ভয় পান নি। লোভের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেন নি। বৃটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করাই্ ছিল তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্য রচনার একমাত্র লক্ষ্য। বিষয়বস্তু নির্বাচন, উপস্থাপনাশৈলি, ও শৈল্পিক বিচারে নজরুল ইসলামের প্রবন্ধগুলো অসাধারণ। এ রকম প্রবন্ধ বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে খুব কমই আছে। তাই সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণে বলা যায়, বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে তিনি বিশেষ মাত্রা সংযুক্ত করেছেন।
সালেক শিবলু, এমফিল গবেষক, বাংলা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর