ধ্বনিই কাব্যের আত্মা-ধ্বনিবাদীদের এ অভিমত বিশ্লেষণ কর।
অলংকারের দিক থেকে ‘ধ্বনি’ সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ধ্বনি ছাড়া কোন লেখা সাহিত্যের মূল্য পায় না। তার অর্থ হলো যে সাহিত্যে ধ্বনি নেই, সে সাহিত্য সাহিত্য নয়। পাঠকের নিকট ধ্বনিমাধুর্যের কারণে সাহিত্য দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে। তাহলে ‘ধ্বনি’ আসলে কী। এ বিষয়ে নানাজন নানা মত পোষণ করেন। ‘ধ্বনি’ নিয়ে অলংকার বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতামত নি¤েœ আলোচনা করা হলো-
‘ধ্বনি’ বলতে এখানে ব্যাকরণের ‘ধ্বনি’ বোঝায় না। ব্যাকরণ ছাড়াও কাব্যের ধ্বনি আছে। এই কাব্যের ধ্বনি অদৃশ্য কিন্তু পাঠকের হৃদয়ে দোলা দেয়, আলোড়ন তৈরি করে। সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা হলো কাব্য। কিন্তু ‘কাব্য’ কী এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রামায়ণের রচয়িতা আদি কবি বাল্মীকি থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত অনেক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি এ বিষয়ে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মধ্যে ভরত, দ-ী, বামন, আনন্দবর্ধন, জগন্নাথ, অভিনব গুপ্ত, বিশ্বনাথ কবিরাজ অন্যতম। এ সব ব্যক্তি সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্রে বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। তারা প্রায় সবাই বাংলা কাব্য সম্পর্কে নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেন রীতি কাব্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, কেউ বলেন, রস কাব্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আবার কেউ বলেন, ধ্বনি কাব্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যারা ধ্বনিকে কাব্যের আত্মা বলেছেন তাদেরকে ধ্বনিবাদী বলা হয়। এই ধ্বনিবাদীরা ধ্বনিই কাব্যের আত্মা বলে অভিমত দিয়েছেন।
এখন ধ্বনি প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। আসলে ধ্বনি কী। আমরা ধ্বনির পর ধ্বনি বসিয়ে শব্দ গঠন করি। শব্দের পর শব্দ বসিয়ে বাক্য গঠন করি এবং এভাবে মনের ভাব প্রকাশ করি। বাংলা কাব্যসাহিত্যেও তেমনই কিছু শব্দ থাকে। এ সব শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ থাকে। কিন্তু বাক্যের শব্দ কখনো কখনো আভিধানিক ও পারিভাষিক শব্দের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করে। এই অতিরিক্ত অর্থকেই অলংকারের ভাষায় ধ্বনি বলা হয়। ধ্বনিবাদীদের মতে এই অতিরিক্ত অর্থই কাব্যের প্রাণ। যে কাব্যের অতিরিক্ত অর্থ নেই, সেই কাব্য মূলত কাব্য নয়, তা দেখতে কাব্যের মতো মনে হলেও তা আসলে কাব্য নয়। এ রকম কাব্য পাঠক সাধারণের মনে কোন আলোড়ন তৈরি করে না। কাব্য মানেই সেখানে রহস্যময়তা থাকবে। কবি কাব্যচরণের বাইরে অতিরিক্ত কিছু অর্থ কাব্যের মধ্যে কৌশলে রোপণ করে দেন। এই অর্থই পাঠককে আলোড়ন করে। যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মানসী’ কাব্যের ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় বলেছেন-
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন গনঘোর বরিয়ায়
এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।
…. ….. ….. ……. …..
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এটি রবীন্দ্রনাথের প্রথম রোমান্টিক কবিতা। কাকে বলা যায়, কী কথা বলা যায়, কোন কথাটা এ জীবনে বলা হলো না-এ রকম অনেক কথাই এ কবিতায় সরাসরি বলা নেই। কিন্তু পাঠক কবিতা পাঠ করা মাত্রই বুঝে নিতে পারে যে ‘বর্ষার দিনে’ একটি রোমান্টিক প্রেমের কবিতা। এখানে নাবলা প্রেমের কথাই প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করে বলতে চায়। ধ্বনিবাদীদের কথা হলো শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক কিছু অর্থ থাকে। কিন্তু কাব্যে কবি এ সব অর্থের বাইরেও নানা রকম অতিরিক্ত অর্থকে বুঝিয়ে থাকেন। এটা কাব্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধ্বনিবাদীদের দাবি-ধ্বনিই কাব্যের আত্মা।
কবি শব্দ দিয়ে কাব্য সৃষ্টি করেন। এ সব শব্দের নানা রকম আভিধানিক অর্থ থেকে থাকে। পাঠক এ অর্থ নিয়ে সন্তোষ্ট থাকে না। কাব্যের ক্ষেত্রে শাব্দিক অর্থ মুখ্য নয়, গৌণ। অর্থাৎ কাব্যের শব্দার্থের আড়ালে আসল অর্থ ও তাৎপর্য লুকিয়ে থাকে। এই অর্থ ডিকশনারির জ্ঞান দিয়ে বোঝা যায় না। কাব্যবোদ্ধা ব্যক্তিগণ হৃদয় দিয়ে এই অর্থ উপলব্ধি করেন। কাব্যশরীরের বাইরে অদৃশ্যমান বাড়তি অর্থই কাব্যের আসল অর্থ। আর অলংকার শাস্ত্রের ধ্বনিবাদীরা এই অর্থের উপর গুরুত্বআরোপ করেছেন। তারমানে ধ্বনি বলতে কাব্যের বিশেষ অর্থ বোঝায়, যে অর্থ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কবিতা কোন শব্দার্থ নয়, কবি কবিতা দিয়ে শব্দার্থ বোঝাতে চান না। তিনি বিশেষ কোন তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ কবিতায় শব্দের মধ্য দিয়ে ইশারা-ঈঙ্গিতে প্রকাশ করেন। অর্থাৎ কবিতার মধ্যে গভীরতর ব্যঞ্জনা লুকিয়ে থাকে, এটাই কাব্যের সৌন্দর্য, কাব্যের মাধুর্য, ধ্বনিবাদীরা এই বিষয়টিকেই কাব্যের আত্মা বলেছেন।